সদ্য ৫ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হতেই বঙ্গ বিজেপির কর্মী-সমর্থক নেতা-নেত্রীরা আবির খেলায় মেতে উঠেছিল। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের (Uttarpradesh) ভোটে দলের জয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা। মনে হচ্ছে, পদ্মফুল যেন পশ্চিমবঙ্গেও ফুটতে চলেছে। দলের এক কর্তা তো বলেই দিলেন, ‘২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখবেন, এরাজ্যেও ‘গেরুয়া ঝড়’ বয়ে যাবে!’
বিগত বিধানসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপ-নির্বাচন, পুরভোটে একের পর এক হারতে হারতে এরাজ্যে বিজেপির (BJP) পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। কোনও মানুষ যখন জলে ডুবে যায়, বাঁচার জন্যে হাতের সামনে যা পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে। বঙ্গের পদ্ম শিবিরের হয়েছে সেই হাল। আসলে যারা বাংলার একটা জনপ্রিয় প্রবাদের কথা বোধহয় ভুলে গিয়েছে। ‘বেল পাকলে কাকের কি?’
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বাংলার ভোটে ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন জিতেছিল পদ্মফুল। নিঃসন্দেহে সেটা ছিল রাজ্য রাজনীতিতে মস্ত বড় চমক। আর তাতেই বিজেপির (BJP) এ রাজ্যে অস্তাচলে যাওয়ার রাস্তা পরিস্কার হয়েছিল। কারণ তখন থেকেই গেরুয়া শিবির ধরে নিয়েছিল, তাদের নবান্ন দখল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও রাজ্য বিজেপির (BJP) কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছিলেন। রাজ্যপাটে বসার স্বপ্নে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। ফল কী হয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবারের প্রেক্ষাপট আলোচনার আগে উত্তরপ্রদেশের (Uttarpradesh) নির্বাচনী বিশ্লেষন প্রয়োজন। ৪০৩ আসনের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির কিন্তু আসন কমেছে। তাদের ছিল ৩২২। এখন কমে হল ২৭৪। একটা দুটো নয়, আসন কমেছে ৪৮টি। কিন্তু বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টির সদ্য ভোটে অগ্রগতি চমকপ্রদ। ৫ বছর আগে তাদের আসন ছিল ৪২। এবার সেটা তিন গুণ বেড়েছে। ১২৫টি আসনে অখিলেশের প্রার্থীরা জিতেছেন। উত্তরপ্রদেশের (Uttarpradesh) রাজনীতির আর এক চর্চিত চরিত্র মায়াবতী। তাঁর দল বহুজন সমাজবাদী পার্টির ছিল ১৮ জন এমএলএ। এবার সেটা কমে মাত্র একটিতে এসে ঠেকেছে। অনেকেই বলাবলি করছে, মায়াবতী তলে তলে বিজেপির সঙ্গে মিতালি করে নিজেরই বিপদ ডেকে এনেছেন। তাঁর দলিত ভোটের একটা বড়সড় অংশ সমাজবাদী পার্টির ঝুলিতে চলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন – দেশের মধ্যে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে শীর্ষে বাংলা, টুইটে কৃষকদের শুভেচ্ছা বার্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
একটা জিনিস পরিস্কার। সদ্য সমাপ্ত ৫ রাজ্যের ভোটে বিজেপি-বিরোধীরা এককাট্টা হলে, গেরুয়া শিবির ধরাসায়ী হত। উত্তরপ্রদেশে (Uttarpradesh) পদ্মফুলের পক্ষে গিয়েছে ৪১.৩% ভোট। আর বিরোধীরা পেয়েছে ৪৮.৫% ভোট। উত্তরাখণ্ড নিয়েও বিজেপির যথেষ্ট দুশ্চিন্তা রয়ে গেল। তারা পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেছে ৪৪.৩৩% ভোট পেয়ে। কংগ্রেসের পক্ষে রয়েছে ৩৮.৩% ভোট। আম আদমি পার্টি পেয়েছে ৩.৪% এবং বহুজন সমাজ পার্টির পক্ষে গিয়েছে ৪.৯% ভোট। অর্থাৎ বিরোধীদের ভোট ৪৬ শতাংশেরও বেশি। মণিপুরেও তাই।
গোয়া নিয়ে প্রথম থেকেই খুব সোরগোল হচ্ছিল। তার প্রধান কারণ, ওই রাজ্যের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) উপস্থিতি। মাত্র ৩ মাসের প্রচারে জোড়াফুল সেখানে প্রায় ৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আদায়ে সমর্থ হয়েছে। ৪টি আসনে দল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তৃণমূল নেত্রী ভোটের আগে কংগ্রেস-সহ বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে এক ছাতার তলায় আসার ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শ শুনে মহাজোট তৈরি হলে গোয়ায় ফলাফল কী হত একবার দেখে নেওয়া যাক। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৩৩.৩১%। কংগ্রেস ২৩.৪৬%। তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) ও মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি যথাক্রমে ৫.২১% এবং ৭.৬০%। আর আম আদমি পার্টি ৬.৭৭%। মোট বিরোধী ভোট ৪৩.৪%। অর্থাৎ ক্ষমতায় ফেরা বিজেপির চেয়ে বিরোধীদের ভোট প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। পাঞ্জাবে তো পদ্মফুল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে।
পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল বেরনোর পর গোয়েবলসীয় কৌশলে নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে েগরুয়া শিবিরের ছোটবড় অনেক নেতাই ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনকে সহজভাবে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু দলের অন্দরমহলে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির অভ্যন্তরে অন্তর্দ্বন্দ্ব বেআব্রু হয়ে পড়ছে। উত্তরাখণ্ডে তো এক বছরে তিন তিনজন মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে (Uttarpradesh) পিছড়িবর্গের দলীয় নেতা এবং প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য-সহ যোগী আদিত্যনাথের মন্ত্রীসভার এক ডজন সদস্য ধরাশায়ী হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির (BJP) আবির খেলা নিছক ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রায় এক বছর আগে বিধানসভার নির্বাচনে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে। তারপর থেকে কলকাতা সহ রাজ্যের ১১৩টি পুরসভার ভোট পর্যন্ত পদ্মশিবিরের হালটা রাজ্যবাসী দেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল বিজেপি (BJP)। ভোটের দিন দেখা গেল, অধিকাংশ বুথে তাদের এজেন্টই নেই। প্রায় জমানতই জব্দ হতে বসেছিল তাদের।
৫ রাজ্যের ভোটের ফল ঘোষণার পরের দিনই দিল্লিতে গিয়ে গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে দলের বিশিষ্ট নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেবল জয়প্রকাশ মজুমদার নয়, বিজেপির (BJP) অনেক নেতা-নেত্রী দলত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।’ আর দলের সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বিধায়কদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসে নিদান দিলেন, ‘জেলায় জেলায় বিজেপির (BJP) ঝগড়া থামাতে জনপ্রতিনিধিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে!’ এক বিধায়ক বৈঠকের পর একান্তে বলেছেন, ‘কমিটি গড়বেন ওরা, আর ঝামেলা সামলাব আমরা?’ আসলে রাজ্য বিজেপি এখন ঘরোয়া কাজিয়ায় ক্ষত-বিক্ষত। বিধানসভা ভোটে যে জনসমর্থন তাদের সঙ্গে ছিল তার গ্রাফ এখন অর্ধেকের নীচে নেমে গিয়েছে। ইপিএফের সুদ যত কমবে, পেট্রোপণ্যের দাম যত বাড়বে, ততই পিছু হটতে হবে পদ্মফুলের ধ্বজাধারীদের। আর জনকল্যাণমুখী প্রকল্পকে সামনে রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৌড়বেন দেশজুড়ে। আওয়াজ উঠবে, —‘জোট বাঁধো, তৈরি হও।’ ‘বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও।’