প্রতিবেদন: আফগানিস্তানে যে এত দ্রুত ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে তা ভাবতেই পারেনি আন্তর্জাতিক মহল। রবিবার দেশের ক্ষমতা দখলের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কাঁপতে শুরু করছে কাবুল-সহ গোটা দেশ। রক্তক্ষয় এড়াতে দেশের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ক্ষমতা হস্তান্তর করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশ ছেড়েছেন। প্রতিটি সরকারি দফতরে উড়ছে তালিবানি পতাকা।
আরও পড়ুন- আফগানিস্তান নিয়ে সিদ্ধান্তের জেরে ক্ষোভ আমেরিকায়, তালিবানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায় চিন
দেশের হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছে। বিমানবন্দরে উপচে পড়া ভিড়। দেখে বোঝা যাচ্ছে না, কাবুল বিমানবন্দর না কোনও রেলওয়ে স্টেশন। পাসপোর্ট অফিসের সামনেও দীর্ঘ লাইন। তালিবানের নির্মম শাসনের হাত থেকে বাঁচতে সকলেই দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন। ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ তুলে নিতেও মানুষের বিপুল ভিড়। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ওমান হয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছেন। তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য এবং সরকারের শীর্ষ কর্তারা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ভারতে এসে পৌঁছেছেন বলে সূত্রের খবর। একই সঙ্গে ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকার মতো একাধিক দেশ আফগানিস্থানে থাকা দূতাবাসের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এদিন কাবুল বিমানবন্দরে এতটাই বিশৃংঙ্খল হয়ে ওঠে যে, নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি চালায়। ওই ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। জখম হয়েছেন অনেকেই। গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবন্দরে উপস্থিত মানুষ ছুটোছুটি শুরু করেন। ওই ঘটনায় পদপিষ্ট হয়ে, নাকি গুলিতে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। এছাড়াও কাবুলের বিমানে উঠতে না পেরে বিমানের টায়ার ধরে ঝুলে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনজন।
আরও পড়ুন- মিথ্যে অভিযোগে ধৃত তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা জামিন পেলেন, টুইট কুণাল ঘোষের
কিন্তু মাঝ আকাশে তাঁরা হাত ফসকে একটি বাড়ির ছাদে পড়ে যান। তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দেহগুলি উদ্ধার করেছে। কাবুল দখলের পর চেনাই যাচ্ছে না শহরকে। জনবহুল কাবুল যেন ধু ধু মরুভূমি। আর সেই মরুভূমিতে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে পৈশাচিক উল্লাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবানরা। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে এতদিন বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ কাবলে এসে ভিড় করেছিলেন। কিন্তু সেই শহরও তালিবানদের দখলে চলে যাওয়ায় মানুষ ভয়ে কাঁপছে।
দেখা গিয়েছে, মহিলারা দুধের শিশুকে কোলে আঁকড়ে ধরে ছুটে চলেছেন। পুরুষদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। দোকানপাট, বাজার সব বন্ধ। একটু খাবারও মিলছে না। বহু মানুষকে খিদের জ্বালায় ছটফট করতে দেখা গিয়েছে। আফগানিস্তানে চলতি পরিস্থিতির জন্য আমেরিকার কড়া নিন্দা করেছে আন্তর্জাতিক মহল। একাধিক দেশ আফগানিস্তানের ঘটনার জন্য আমেরিকাকে কাঠগড়ায় তুলেছে। তাদের অভিযোগ, আমেরিকা দ্রুত সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই এই ঘটনা। তালিবানদের ক্ষমতা কতটা সেটা বুঝতেই পারেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সে কারণেই বাইডেন সম্ভবত তালিবানদের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেছিলেন। আফগানিস্তান আজ তার মাশুল গুনছে। সেমবার ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, এই মুহূর্তে কোনওভাবেই তাঁরা আফগানিস্তানে ফিরবেন না।
আরও পড়ুন- খেলা হবে দিবসের দিনেই IFA-এর সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর
সেদেশে যে সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছে তাদের দ্রুত ফিরিয়ে আনবেন। পাশাপাশি বেশকিছু বিপন্ন আফগান নাগরিককেও তাঁরা ব্রিটেনে আশ্রয় দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেন। বরিস জনসন সরকার তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে কিনা সে বিষয়ে অবশ্য কিছু জানাননি তিনি। ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স- সহ গোটা বিশ্বের ৬০ টি দেশ ইতিমধ্যেই তালিবানদের কাছে আর্জি জানিয়েছে, তারা যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা যেন দেশের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করে। ভারত আরও জানিয়েছে কোনও অবস্থাতেই তারা তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তবে, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান সরাসরি তালিবানদের সমর্থন করেছে। স্থানীয় আলজাজিরা টিভিতে দেখা গিয়েছে, সদ্য-প্রাক্তন হয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট ঘানির প্রাসাদ ও সরকারি বাসভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সশস্ত্র তালিবান জঙ্গিরা। সমস্ত সরকারি দফতরেও জঙ্গিদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় আগামী দু’দিনের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে প্রত্যেক মার্কিন নাগরিককে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাইডেন।
আরও পড়ুন- সুভাষ সরোবরে জমজমাট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের খেলা হবে উৎসব
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে ন্যাটো বাহিনীর আক্রমণে তালিবানরা কাবুল থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। তবে বোঝা যায়নি যে, দীর্ঘ ২০ বছরে ভিতরে ভিতরে তালিবানরা এতটা শক্তি অর্জন করেছে। সে কারণেই মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই তারা আফগানিস্তানের দখল নিল। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০০১ সালে তালিবানরা ক্ষমতাচ্যুত হলেও সে দেশের বেশ কিছু জেলা ছিল তালিবানদের দখলে। ওই সমস্ত জেলায় বিপুল পরিমাণ আফিমের চাষ করত জঙ্গিরা। মাদক বিক্রি করেই তারা কোটি কোটি ডলার উপার্জন করেছিল। সেই টাকাতেই গড়ে তুলেছিল বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার। আফগানিস্তানে চলতি পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন নোবেলজয়ী সমাজ কর্মী মালালা ইউসুফজাই। এক টুইট বার্তায় মালালা সে দেশের শিশু মহিলা ও মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আফগানিস্তানের যে সমস্ত মানুষের তালিবানদের শাসন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। তাঁরা অভিযোগ করছেন, তালিবানদের আমলে বাড়ির মেয়ে ও বউদের সুরক্ষা বলে কিছু থাকবে না। মেয়েদের বাইরে বেরোনো, পড়াশুনা করার মত সমস্ত কাজই বন্ধ করে দেবে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের শাসন না মানলে মৃত্যু অবধারিত।
তাই এই মুহূর্তে আফগানিস্তান আর সামনে এগোবে না বরং পিছতেই থাকবে। গোটা দুনিয়া যখন উন্নয়নের স্বার্থে হাঁটছে তখন তালিবানদের শাসনে আফগানিস্তান হাঁটবে মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকে। এদিকে কাবুলে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে প্রেসিডেন্ট ঘানি দেশ ছাড়ার সময় চারটি গাড়ি ও একটি হেলিকপ্টার ভর্তি করে টাকা নিয়ে গিয়েছেন। কপ্টার ও গাড়িতে জায়গার অভাবে অবশ্য কিছু টাকা আছে পিছনে ছেড়ে যেতে বাধ্য হন ঘানি। একইসঙ্গে রাশিয়া জানিয়েছে, এই মুহূর্তে তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা তারা ভাবছে না। বরং তারা ধীরেসুস্থে পরিস্থিতি দেখে এগোতে চায়।