অগাস্ট মাস। স্বাধীনতার মাস। গোটা দেশ জুড়েই এ-সময়ে যখন বিভিন্ন উদ্যাপন কর্মসূচির পরিকল্পনা চলতে থাকে, ঠিক সেই সময়টা জুড়ে দেশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটি কোন চোখে তাকিয়ে দেখে এই স্বাধীনতার দিকে? ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরেই অগাস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলুপ্তি ঘোষণার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয় কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা। এই বছরে বিজেপি আয়োজিত ১৫ অগাস্টের অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী বেমালুম বলে দেন যে মাতঙ্গিনী হাজরা অসমের মানুষ। যেভাবেই হোক বাংলাকে তিনি গুরুত্ব দিতে নারাজ। ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সাধুসন্তদের সঙ্গে যোগ দিতে যান অযোধ্যার রামমন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে। দেশকে এক আশ্চর্য হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার আফিমে মজিয়ে তার ইতিহাস, তার ভূগোলকে নতুন কাঠামোয় ফেলতে চাওয়াটাই যেন বিজেপি-র কাছে স্বাধীনতার একমাত্র তাৎপর্য। কী প্রচণ্ড স্পর্ধায় স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের কাছে স্বাধীনতার এত বছর পরেও নাগরিকত্বের কাগুজে প্রমাণ দাবি করা হয়, স্বাধীন দেশের ‘অনুপ্রবেশকারী’দের ঠাঁই হয় ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়াবহ ঠিকানায়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির মুহূর্তেও কাঁটাতারের ছাপ যেন আর কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না ভারতের মানচিত্রকে।
আরও পড়ুন-‘জাগোবাংলা’য় লেখার জেরে অজন্তা বিশ্বাসকে সাসপেন্ড করল সিপিএম
অথচ, এই ভয়াবহ বিদ্বেষমূলক দেশপ্রেমের প্রতিষেধক যাতে কাঁচা বয়সেই শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে দেওয়া যায়, সে-কথা মাথায় রেখে এ-রাজ্যের পাঠ্যপুস্তকে খোলামনে দেশ চেনানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে একেবারে শিশুশিক্ষার স্তর থেকেই। যদি আমরা খেয়াল করি, তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘পাতাবাহার’-এঁর অন্তর্গত নবনীতা দেবসেনের ‘মনকেমনের গল্প’ লেখাটির কথা, সেখানে কিন্তু দেশ বা স্বাধীনতার কথা তেমনভাবে নেই। যেন বর্ষার দিনে ইশকুলে যাওয়ার আনন্দ আর সেই আনন্দের মধ্যেই একটা দিন পনেরোই অগাস্ট। আর “এমন ছায়াভরা আকাশে যখন ফ্ল্যাগটা উড়ল, আমরা ‘জনগণমন’ গান গাইলাম। তখনই কী আশ্চর্য, বিরাট একঝাঁক ধবধবে সাদা পাখি ঠিক তক্ষুনি আকাশ দিয়ে, ফ্ল্যাগের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। অনেক দূরদেশ থেকে আসছে হয়তো। আরও অনেক দূরের দেশে যাচ্ছে।” এখানেই আসলে ‘দেশ’ সম্বন্ধে ধারণার এক অন্য দিশার কথা বলা হচ্ছে, যা বিজেপি-র ‘দেশ’ সম্বন্ধে ধারণার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। একটি বিশেষ দেশের জাতীয় পতাকার ওপর দিয়ে যে পাখির দল উড়ে গেল, তাদের দেশ কোনটা? যে-দেশ থেকে উড়ে এল, সেটা? নাকি, যে-দেশে উড়ে গেল, সেটা? ভৌগোলিক সংকীর্ণতাকে ছাড়িয়ে মননে চিন্তায় গোটা পৃথিবীকেই নিজের বলে ভাবা, এখানেই এই রাজ্যের পাঠ্যপুস্তকের তাৎপর্য, এই পাঠ্যপুস্তকের আন্তর্জাতিক আবেদন।
বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদের মধ্যে থেকে মাঝেমাঝেই এমন হুমকি শোনা যায় যে, “ভারতে থাকা যাবে না, পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে চলে যেতে হবে।” তখন ‘দেশ’ অর্থে সংকীর্ণ ভৌগোলিক গণ্ডি আর তার সঙ্গে সম্পর্কিত সংকীর্ণ হিন্দুত্বের কথাই উঠে আসে। এমনকী, এই যে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের প্রসঙ্গ, তা-ও কিন্তু একেবারে দেশের বা ধর্মের ক্ষেত্রে এক বিপরীত শত্রুকে ভেবে নেওয়া। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের পাশে ফেলে নিজের দেশ ভারতকে মহান প্রতিপন্ন করার চেষ্টা প্রকারান্তরে ‘দেশ’-এর প্রতি চূড়ান্ত বিদ্বেষকেই সূচিত করে।
ইতিমধ্যেই বিজেপি কিন্তু নানা অজুহাতে তাদের এই বিভাজনের রাজনীতিকে ‘দেশ’-সংক্রান্ত পাঠপরিকল্পনার মধ্যে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিতে শুরু করেছে। মনে করিয়ে দিই, মহামারীকালে পাঠ্যক্রম সংকোচনের ছলে তাঁরা বাদ দেন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো-সংক্রান্ত অধ্যায়টি— যার ফলে ভারতীয়ত্বের মূল ধারণাটিই সম্পূর্ণত হারিয়ে যায়। এ ছাড়াও, কর্ণাটকের পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় টিপু সুলতানকে, মুছে ফেলতে চাওয়া হয় মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। রবীন্দ্রচেতনা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিরোধী— এই অভিযোগে এনসিইআরটি-র দশম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথকে ছেঁটে ফেলার দাবিতে সরব হন সংঘঘনিষ্ঠ দীননাথ বাত্রা। এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি! ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আবার যদি চোখ রাখি এ-রাজ্যের সপ্তম শ্রেণির বইয়ে, সেখানে পাবেন ‘দুটি গানের জন্মকথা’ নামে একটি লেখা। এই দুটি গানের একটি ‘জনগণমন-অধিনায়ক’, যা ভারতের জাতীয় সংগীত এবং আর-একটি ‘আমার সোনার বাংলা’, যে গানটি প্রতিবেশী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। অর্থাৎ কখনওই বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হচ্ছে না ‘দেশ’ বিষয়টিকে। স্বার্থপরতার কোনও স্থান সেখানে নেই। এক মহান উত্তরাধিকার যেন বড় হয়ে উঠছে উগ্র, ধর্মোন্মত্ত জাতীয়তাবাদের বিপরীতে।
আরও পড়ুন-তালিবানি আতঙ্ক, দ্রুত আফগানিস্তান ছাড়তে চাইছেন মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ
ছিদ্রান্বেষীরা যদি ভেবে বসেন, বিশ্বজনীনতার আবেগে গা ভাসিয়ে মাটির ইতিহাসকে ভুলে থাকছে রাজ্যের পাঠ্যপুস্তক, তাঁদের আশ্বস্ত করে বলি, এ বইয়ে একইসঙ্গে রয়েছেন সূর্য সেন আর সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন দাস, ননীবালা দেবী আর দুকড়িবালা দেবী। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ আর ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’-এর সঙ্গেই আছে অতুলপ্রসাদ সেনের ‘উঠো গো ভারতলক্ষ্মী’। রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটি নিয়ে, যে আদর্শটিকে মূল কেন্দ্রে রেখেই গোটা পাঠ্যক্রমের পরিকল্পনা। ‘দেশ’কে ক্ষুদ্র পরিসরে না দেখার শিক্ষা এ-রাজ্যের পর্ষদ প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে বারবার উল্লিখিত হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘সাহিত্যমেলা’য় তাই অন্তর্ভুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্লেম রেনেসাঁসের অন্যতম নেতা, কবি এবং সমাজকর্মী ল্যাংস্টন হিউজ, পাঠ্য হয় তাঁর কবিতা ‘স্বাধীনতা’। কালো মানুষের স্বাধীনতাও কিন্তু আমাদেরই স্বাধীনতা, যে-কোনও উপনিবেশের স্বাধীনতাও আমাদের স্বাধীনতা, তাঁদের সংগ্রাম আসলে আমাদেরও সংগ্রাম—
“যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া
জীবনের কথা বলা গানের মহড়া যেন
সব্বার জন্যে সব্বার জন্যে…”