নির্জনতায় লুকিয়ে বড়দি পাহাড়ের সৌন্দর্য 

ছোট্ট, ফুটফুটে একটা পাহাড়। সবুজের চাদরে মোড়া পরিবেশে একাকী দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে মায়ের মতো বয়ে চলা কংসাবতী মাঝে-মধ্যেই তার গালে এঁকে দিচ্ছে সস্নেহ চুম্বন। এমনই সৌন্দর্যের হদিশ পেতে ঘুরে আসুন বাঁকুড়ার বড়দি পাহাড়ে। কেন যাবেন? জানাচ্ছেন চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

কংসাবতী নদীর তীরে ছোট্ট একটা পাহাড়। শাল- মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা সারেঙ্গার সেই বড়দি পাহাড়তলিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একবার ঘুরেই আসুন। কিন্তু যাতায়াতের সমস্যা আর পরিকাঠামোর অভাব অনেকটাই মিটে গিয়েছে। তাই পর্যটকদের বড়দি পাহাড়ে পৌঁছতে এখন সমস্যা হচ্ছে না।

একসময়ে মাওবাদী আতঙ্কে জঙ্গলমহলে (Jangalmohal) পর্যটকেরা আসতে ভয় পেতেন। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের প্রায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন । কিন্তু যাতায়াতের সমস্যা ও পরিকাঠামোর অভাব থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাটতি রয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ছিল পর্যটকদের। তাই পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রের পাশাপাশি স্বল্প পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নেও জোর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

অবশেষে জঙ্গলমহলের (Jangalmohal) এই পর্যটনকেন্দ্রকে সবার কাছে আকর্ষণীয় করতে এ-বার একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছে সারেঙ্গা ব্লক প্রশাসন। এই পর্যটন কেন্দ্রকে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

বড়দি পাহাড় যাবার রাস্তার দু’পাশে নানান ধরনের গাছের জঙ্গল ও চারচালা করোগেটেড ছাদ নিয়ে গ্রামসমূহের সহাবস্থান দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। গ্রামগুলোর কয়েকটি হল পাতাগড়া, ছোট-আমলাতোড়া, কৃষ্ণপুর, বড়-আমলাতোড়া, ডাঙাদেউলি, জামবনি, ছোট-গোয়ালডাঙা, চুয়াডাঙা আরও কত কী। বড়দি পাহাড় নেতুরপুর গ্রামপঞ্চায়েতের অন্তর্গত সম্প্রতি গড়ে তোলা এক প্রকৃতি পর্যটনস্থল। পর্যটন কেন্দ্রটিকে সাজিয়ে তোলা ও দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে সারেঙ্গা ব্লক প্রশাসনের হাতে। জঙ্গলের দায়িত্বে বাঁকুড়া দক্ষিণ বনবিভাগের পিড়োরগাড়ি বনাঞ্চল।

আসলে “কংসাবতী নদী তীরবর্তী বড়দি পাহাড় দেখতে পর্যটকেরা আসেন। শীতের মরশুমে চড়ুইভাতির জমাটি আসর বসে। কিন্তু পরিকাঠামোয় ঘাটতি থাকার জন্য অনেকে আসতে চান না। এখানে জানিয়ে রাখি, এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। পর্যটকদের সুবিধা বাড়ানোর জন্যই একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয়েছে।”

কীভাবে যাবেন?

বাঁকুড়া থেকে রাইপুরের রাস্তায় পড়ে পিড়রগাড়ি মোড়। সেখান থেকে খাতড়া যাওয়ার রাস্তায় ৬ কিমি দূরে চুয়াগাড়া মোড়। ওই মোড় থেকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা ধরে চার কিমি গেলেই পাওয়া যাবে নেতুরপুর পঞ্চায়েতের কালাপাথর গ্রাম লাগোয়া বড়দি পাহাড়। তার কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে কংসাবতী নদী। নদীর তীরে কালাপাথর গ্রামে রয়েছে একটি ঝর্না। স্থানীয় মানুষের কাছে তা কালাঝর্না নামে পরিচিত।

কোথায় থাকবেন?

পরিকল্পনামাফিক পাহাড়ে ওঠার চারদিকে চারটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকদের থাকার জন্য দু’টি ঘর, শৌচাগার, পাহাড়তলিতে একটি বাগান তৈরির কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। পানীয় জলের জন্য নলকূপের পাশাপাশি সাব-মার্সিবল পাম্প বসানো হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এখানে রোপওয়ে তৈরির ভাবনাও রয়েছে। তাই এখন সহজেই পর্যটকরা এখানে এসে স্বচ্ছন্দে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

বড়দি পাহাড়ে গেলে দেখতে পাবেন, পাহাড়ে ওঠার জন্য চারদিকে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পায়ে হেঁটে পাহাড় দর্শনের পাশাপাশি চারচাকা গাড়ি ওঠার রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকদের থাকার জন্য ঘর, শৌচাগার নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ। পাহাড়ের নিচে পিকনিক করার ব্যবস্থা আছে। “কংসাবতী নদীর তীরে বড়দি পাহাড় আর ঝর্না দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এত সুন্দর মনোরম একটা পরিবেশের দৃশ্যপট মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেবে। ভবিষ্যতে বাড়ির সবাইকে নিয়ে আবার আসতে ইচ্ছে করবে। শুধু পাহাড় আর নদীর অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করবেন।

বড়দিকে আসলে পাহাড় বলাটা ঠিক হবে না। কারণ এতে অন্য পাহাড়েরা একটু রাগ করতেই পারে। বাঁকুড়া জেলার অন্য পাহাড়গুলির তুলনায় আয়তন এবং উচ্চতায় বড়দি নস্যি। শ দুয়েক ফুট উঁচু বড়দির চূড়ায় উঠতে পরিশ্রম নেই বললেই চলে। কিন্তু চূড়ায় উঠে নদীর দিকে গেলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজের গালিচা পাতা, তারই মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে কংসাবতী। কাজলকালো জলে বড়দির ছায়া। পাথরের উপরে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই কেটে যায় অনেকটা সময়।

বড়দির পিছন দিকে শাল মহুয়ার জঙ্গল। নুড়ি পাথরে মোড়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেই পথে হাঁটতেও কিন্তু অপূর্ব লাগে। এখানেও পিছু ছাড়েনি নির্জনতা। এই নিরিবিলি নির্জনতাই বড়দি পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যে অলঙ্কার পাখ-পাখালির কুজন। শালের জঙ্গল দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে এসে এবার একটু বিশ্রাম। হয়তো তেমন কিছু নেই। কিন্তু আছে অনেক কিছু। চাইলে জলে নেমে স্নানও করে নিতে পারেন।

এখান থেকেই আপনি ঢুঁ মারতে পারেন সবুজ দ্বীপের দিকে। কংসাবতীর জল কম, তাই সহজেই পার হয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই সবুজদ্বীপ। না হলে ফের অনেকটা ঘুরে যেতে হয় সবুজ দ্বীপে। এই নাম অবশ্য বেশি দিন হয়নি। এটা এতদিন সবুজ কুমারীই ছিল। বছর পাঁচেক হল স্থানীয় প্রশাসন দ্বীপটির সৌন্দর্যায়ন করে সবুজদ্বীপ নাম দিয়ে একটা পিকনিক স্পট বানিয়েছে। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে সবুজদ্বীপ এখন কৃত্রিম সৌন্দর্যে বা মেক-আপ নিয়ে সুন্দর হয়েছে। এখানেও একটি থাকার জায়গা আছে।

Latest article