আবহমান গ্রামবাংলার একমাত্র সর্বজনীন লোক উৎসব বাংলা নববর্ষ। শোভাযাত্রা, মেলা, মিষ্টিমুখে বাঙালির বাঙালিত্ব উদযাপন এই দিনে। একটা সময়ে নববর্ষ গ্রাম বাংলায় পালিত হত আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। সম্ভবত আকবরের সময়েই হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল— পরে তা বঙ্গাব্দ রূপে পরিচিত হয়। অনেকে আবার মনে করেন শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়। আর, ‘এই মাস হতে বঙ্গে বর্ষ শুরু হয় /সিদ্ধিদাতা জগানন গণেশ কৃপায়’। আসলে, সমগ্র চৈত্রমাস জুড়েই গ্রামবাংলায় বর্ষবরণের প্রস্তুতি। নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর ‘আমার শৈশবে নববর্ষ পয়লা বৈশাখ (Pahela Boisakh)’-এ বলছেন, ‘চৈত্র মাসের শেষের দিনে সারাদিন ঢাকের বাদ্যি শুনতাম। মা বলতেন চড়কের বাজনা।’ চৈত্রমাসের শেষ দিনে গ্রামবাংলায় তাই সঙ, গাজন, চড়ক উৎসবের আয়োজন। সন্ন্যাসীর বেশে যুবকদের দাপিয়ে বেড়ানো আমাদের লোকায়ত শিব সংস্কৃতির পরিচয়বাহী। ‘পাচন’ রান্না, মদনদীপ প্রজ্বলন কিংবা চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যায় এখনও লোকজ ছড়া কেটে কেটে আগুন মশাল উৎসবের মাধ্যমে নববর্ষের আবাহনী ঘোষণা করা হয়। বর্ষশেষের দিন টক ও তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে যেন পুরাতন অম্লতা ও তিক্ততা বর্জনের বার্তা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে ধরা পড়ে সেই প্রবহমান বাংলার কথকতা— ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা বিপুল নিঃশ্বাসে।’
একটা সময় জমিদাররা পয়লা বৈশাখে খাজনা আদায়ের সূচনা করতেন ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এখনও ‘হালখাতা’ সেই স্মৃতি উসকে দেয়। পয়লা বৈশাখে (Pahela Boisakh) তাই বাকিতে বিক্রয় হয় না— পুরনো ধার শোধ করেন ক্রেতারা। কৃষিভিত্তিক বাংলার গৃহস্থের ঘরে নববর্ষ উদযাপন এখনও জীবনচর্যার অনিবার্য অঙ্গ। তাই তো গ্রামের মানুষ পহেলা বৈশাখে নিজ নিজ চাষের জমি, বাস্তুভিটেতে খড়ের আঁটি দিয়ে আগুন জ্বালায়। ঘরে ঘরে শিলনোড়া দিয়ে নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ বাটা হয়। এই মিশ্রণ গৃহপালিত পশুদের মাখিয়ে স্নান করানো হয়। ছোটরা বড়দের আশীর্বাদ নেয় এই বিশেষ দিনে। বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসত বাপের বাড়ি এই দিনেই। অর্থাৎ যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক সংযোগে নববর্ষ উদযাপন গ্রামবাংলার অন্তর্গত রক্তে। মিষ্টিমুখের আয়োজন মোয়া, নাড়ু, মুড়কি, পিঠার উষ্ণতায় ভেঙে যায় সংকীর্ণতা। তাইতো, ‘সিগ্যাইদা পাতিল’ (চিত্রিত হাঁড়িতে)-এ হিন্দু পরিবার থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ুর হাঁড়ি মুসলিম বাড়িতে আসে স্বাভাবিকভাবে। আহমদ ছফা তাঁর ‘বাঙালির পহেলা বৈশাখ’ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে লিখেছেন— ‘আমার মা এ হাঁড়িগুলো যত্ন করে ছাদের ওপর রেখে দিতেন।… পহেলা বৈশাখের দিন ঘরবাড়ি যথাসাধ্য পরিষ্কার করা হতো। গোয়ালঘরে বিষকাটালির ধোঁয়া দেওয়া হতো।’ এভাবেই গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবকে গ্রহণ করেন আমজনতা।
এভাবেই বাংলা নববর্ষ গ্রাম বাংলায় অসাম্প্রদায়িক এক উৎসবের বাতাবরণ তৈরি করে। সর্বোপরি বৈশাখী মেলা। গ্রামকেন্দ্রিক এই মেলা তো পহেলা বৈশাখের নিত্য সহচর। রবীন্দ্রনাথের কথায়— ‘এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়— তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ।” সোনার গাঁওয়ের ‘বউ মেলা’, ‘ঘোড়া মেলা’ এমনই বৈশাখী মেলার দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি, লোকশিল্প, লোক ক্রীড়ার বর্ণময় উপস্থাপনা এই মেলায় সুলভ। বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, নৌকাবাইচ, পটচিত্র, মুর্শিদি, বাউল, জারিগান, পুতুলনাচ, যাত্রা, পালাগান, নাগরদোলা, মোরগের লড়াই, গরুর দৌড়, পান্তা ইলিশ… আবহমান বাংলার ঘ্রাণ এই মেলার অন্দরমহলে আজও অমলিন। তা ছাড়া, গ্রামীণ হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের লোকায়ত প্রদর্শনী হিসেবেও এই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই মেলা অনিবার্য অনুঘটকের কাজ করে। দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘পল্লীচিত্র’ গ্রন্থে গ্রাম্যমেলার বিকিকিনি ও লৌকিক বিনোদনের অসাধারণ বর্ণনা করেছেন— ‘সবার চেয়ে আনন্দময় /ওই মেয়েটির হাসি /এক পয়সায় কিনেছে ও/তালপাতার এক বাঁশি।’
এই আনন্দময় উদযাপন এবং যৌথ যাপনকথা তাই গ্রাম বাংলার নববর্ষের অন্দরে বাহিরে সক্রিয়। বৈশাখের রুদ্ররূপের দাবদাহে পল্লিবাংলা তাই উৎসবের সৃজনশীল প্রত্যাশায় নতুনকে স্বাগত জানায়।