দেবাশিস পাঠক: “বাদ মরনে কে ভি মাতম কি সদা আতি রহি / লোগ হরত সে মেরি জলতি চিতা দেখা কিয়ে” (আমার মৃত্যুর পরেও ইমাম হুসেনের শহিদত্বের কারণে বিলাপের আওয়াজ যাবে শোনা, লোকে আমার জ্বলন্ত চিতা দেখতে থাকবে শ্রদ্ধাভরে)। কবি ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু। কিন্তু নিজের মৃত্যুশোকেও লেপ্টে দিয়েছেন মহরমের বিলাপের রঙ। কারণ, কারবালা প্রান্তরের ইতিহাস ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন শোকগাথা। মনুষ্যত্বের অবমাননায় কেঁদে ওঠার দিন। হিংস্রতার বিপরীতে অনবদমিত প্রত্যয়ে সামিল থাকার স্মরণ।
আরও পড়ুন- আল-কায়েদা ঘনিষ্ঠ হাক্কানি জঙ্গিরাই এখন কাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্বে
উমাইয়া খলিফা এজিদের সঙ্গে লড়াই করেছিল হজরত মহম্মদের নাতি ইমাম হুসেন, স্রেফ অত্যাচারিত মানুষদের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে, ইসলামের মূল্যবোধের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার প্রণোদনায়। কারবালা প্রান্তরে টানা দশদিন নিষ্ঠুর অত্যাচার আর অন্যায় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল ইমাম হুসেনকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে টানা তিনদিন ইউফ্রেটিস নদীর জলটুকুও কেউ নবীর নাতিকে দেয়নি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মা ফতিমা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শোকপালনের অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছিল এজিদের লোকজন। ইমাম হুসেনের সঙ্গে থাকা মহিলা আর শিশুদের দশদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আর এসবই ঘটেছিল ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহররমে। এই মাসেই ইহুদিরা দশম দিন আশুরার উপবাস পালন করে। এই দিনেই আদি পিতা আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন আল্লাহ। নোহ রক্ষা করেছিলেন জীবনকে মহা প্লাবনের লগ্নে। এমন সব কথা ভেসে থাকে মানুষের মনে। এদিনই মুসার সমসাময়িক ফেরাউন আর তাঁর সেনাদের নীলনদের জলে ডুবিয়ে মেরেছিলেন আল্লাহ, লেখে মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস। সুন্নি মুসলমানেরা এদিন রোজা রাখে হজরতের দেখানো পথে। আর, এই আশুরার দিনটাতেই কারবালার প্রান্তরে শহিদত্ব অর্জন করেছিলেন ইমাম হুসেন।
আরও পড়ুন- পিছিয়ে পড়েও এএফসি কাপে মধুর জয় এটিকে মোহনবাগানের
তারই স্মরণে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরা পালন করেন মহরম। মা ফতিমা, বোন জয়নব সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যে শোক পালন করতে পারেননি এজিদের অত্যাচারের কারণে, সেই শোক পালনের জন্য ফি বছর আশুরার দিনটাতে শিয়া সম্প্রদায়ের খুশি ত্যাগ করে মাতমে ভেঙে পড়া।
আর এই গোটা ঘটনায় নিহিত থাকে যে বার্তা, তা হৃদয়ে ধারণ করেন মহাত্মা গান্ধীর মতো হিন্দু ধর্মালম্বীও। তিনি হুসেনের কাছ থেকে শিখে নেন, “কীভাবে নিপীড়িত হয়েও বিজয় অর্জন করা যায়।” মহরম তখন আর কেবল শোক পালনে ফুরিয়ে যায় না। মহরম তখন জোগান দেয় মনুষ্যত্বের সমিধ।
মহরম তাই বেড়া ভাঙার পরব। মহরম তাই বুনে চলে সম্প্রীতির তাঁত।
আরও পড়ুন- ৭ বিধানসভা করোনা শূন্য, উপনির্বাচনের জন্য কমিশনকে রিপোর্ট তৃণমূল কংগ্রেসের
লখনউয়ের তখতে তখনও ওয়াজেদ আলি শাহ। সেবার মহরম আর হোলি পড়েছিল একই দিনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নবাব দেখলেন, রাস্তায় কোনও হিন্দু প্রজা নামেননি আবির আর পিচকারি নিয়ে। নবাবের শোকের পরবে নিজেদের খুশির উৎসব পালনে মন সায় দেয়নি তাঁদের। কথাটা জানতে পেরেই আবেগে মেদুর নবাবের মন। নিজে হাতে আবির ছুঁড়লেন তিনি শোকের পরবের দিনেও আনন্দের প্রহর রচনার প্রণোদনায়। সেবার নাকি সকাল দশটা পর্যন্ত লখনউ রঙ খেলেছিল। তারপর তাজিয়া নিয়ে শোকের মিছিল নেমেছিল রাস্তায়।
এভাবেই বিষাদের সময়ে আনন্দের রঙ ধরিয়েছিল সম্প্রীতির মূল্যবোধ। এটাই গোমতী থেকে গঙ্গা, সর্বত্র জাপটে থাকা ভারতবর্ষের অকৃত্রিম আত্মা। নওয়াদা। ঝাড়খণ্ডের গিরিডি জেলার একটা গ্রাম। রাঁচি থেকে দূরত্ব প্রায় ২৩০ কিমি। সে গ্রামে এক ঘর মুসলমানেরও বাস নেই এখন। কিন্তু মহরম পালনে কোনও ছেদ নেই। ঠাকুরদার মুখে কেউ কেউ শুনেছেন, একদা এ গ্রামে বাস করতেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। তারাই পালন করতেন মহরম। তাঁরা সব কাজের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। সে সব কতদিন আগেকার কথা। কিন্তু ঠাকুরদাদের দেখানো পথে তাঁদের নাতিরা আজও চার কিলোমিটার দুরের গ্রাম থেকে মৌলবি ডেকে এনে মহরম পালন করেন। আশুরার দিন রোজা রাখেন। বরুণ যাদবের মতো চাষি পরিবারের ছেলেরা নিজেদের চাবকে চাবকে গা থেকে রক্ত বের করেন, ইমাম হুসেনের কষ্ট নিজেদের শরীরে টের পাওয়ার জন্য। কোভিডের কারণে তাজিয়া নিয়ে মিছিলের আকার ছোট হয়েছে। কিন্তু আবেগে ভাটা পড়েনি এতটুকু। খুশির উৎসব হলে তাও না হয় মানা যেত, কিন্তু শোকের পরবে এমন আবেগঘন অংশগ্রহণ কেন? মহরম পালিত না হলে নাকি গ্রামের অমঙ্গল হবে, বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে শোনা কথা আজও জেগে এই গ্রামের মন-মসজিদে। তাই, তাই-ই। এবং নওয়াদা কোনও ব্যতিক্রমী চিত্রের নাম নয়।
আরও পড়ুন- পার্টির বিরুদ্ধে কিছু না বলেও ছমাসের জন্য সাসপেন্ড অজন্তা
গোদাবরীর তীরে মহারাষ্ট্রের নাসিক। পঞ্চবটীর সূত্রে রামায়নী ঐতিহ্য এ শহরের পরান কথা পুরাণ গাথায়। সেখানেও, পুরনো নাসিকের ইমামশাহী এলাকায় আশুরখানাতে প্রায় ৪০০ বছর ধরে হিন্দুরা ‘মানাচা তাজিয়া’ বানাতে হাত লাগান মুসলমান সহ-নাগরিকদের সঙ্গে। তার পর মহরম পালনের সপ্তম দিনে হিন্দুরা কাঁধ লাগান সেই তাজিয়া বহনে। দশম দিন অর্থ্যাৎ আশুরার দিন ‘হালোকা তাজিয়া’ নিয়ে শোভাযাত্রার দিনেও হিন্দুদের কাঁধ লাগে মুসলমানের সঙ্গে, তাজিয়া বহনের পরম্পরা মেনে। গোদাবরীতে সেই তাজিয়া বিসর্জনের সময়েও হিন্দু-মুসলমান একসাথে। কোনও জোর জবরদস্তি নেই এই রেওয়াজের পেছনে। তাজিয়ার সামনে মানত করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়, একথা মানেন হিন্দুরা। সেই বিশ্বাস থেকেই এই প্রথা।
২০১৪। ‘জয় মাতাদী’র ‘জাগরণ দিবস আর মহরম পড়েছিল একই দিনে। ময়ূর বিহার থানার কাছ থেকে দুপুর আড়াইটে নাগাদ বের হয় মহরমের মিছিল। পৌনে চারটের ভেতর শেষ। তারপর সেই মিছিলে অংশ নেওয়া মুসলমান যুবকরা হাত লাগিয়েছিল জাগরণ দিবসের প্রসাদ বিতরণে। সম্প্রীতির ভারত, ভারতের সম্প্রীতি এটাই, এমনটাই।
সাকিন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ। লালবাগে এশিয়ার বৃহত্তম ইমামবাড়া। সেখানে মহরমের দিন অনুষ্ঠিত হয় ‘আগুনে মাতম’। জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যান মানুষেরা। মুসলমানরা তো বটেই, সঞ্জয় মণ্ডল, সন্তোষ মণ্ডলের মতো হিন্দু ভক্তরাও। নবাবি আমল থেকে চলে আসছে এই প্রথা।
এই বাংলারই হাওড়া জেলার আমতা। সেখানে খোড়পের জমিদার বাড়ি। বসু বাড়ি। এই বাড়ির চাতালেই মিলিত হয় বালিপোতা, বটতলা, দক্ষিণপাড়া, ধাঁইপুর থেকে আসা মহরমের মিছিলগুলো। শুরু হয় ‘মাতম’ আর ‘জারিগান’। বসু বাড়ির অন্দরমহল থেকে জল বাতাসা শরবত আসে তাঁদের আপ্যায়নের জন্য।
এভাবে, এভাবেই, হিংস্র রাত্রি চুপিসারে এসে মিলনের আগল ভেঙে জীবনের গৌরবের রূপ চুরি করতে না-পেরে থমকে দাঁড়ায় মহরমের দিন। শোকের আবহে সম্প্রীতির আবির উড়তে থাকে ভারতাত্মার আসমানে।