পাভেল আখতার: ‘ছোটগল্প’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত সংজ্ঞাটি অমোঘ ও বহুল চর্চিত। ‘নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ..’ যদি হয় ছোটগল্পের ‘শরীর’ তাহলে তার ‘প্রাণ’ হ’ল ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখকথা…’ কিংবা ‘সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারি দু’চারটি অশ্রু (Gras Gan Ashru) জল…।’ প্রতিদিন এই সংসারের হাটে অজস্র দুঃখ, আনন্দ কলকলিয়ে উঠছে। কালক্রমে সেসবই ‘স্মৃতি’ হিসেবে আমাদের কাছে চিহ্নিত হয়। হয়তো তা মধুর সুরভিনন্দিত, নয়তো বিষাদবিবশ। যেমনই হোক, ‘স্মৃতি’র মধ্যে মানুষ ‘দোল’ খেতে ভালবাসে। কিন্তু, স্মৃতির মণিকর্ণিকাগুলিকে শিল্পের কারুকার্যে ‘গল্পের’ অবয়ব দান করা সত্যিই একটি অভিনব ঘটনা। তাহলে কি ‘স্মৃতি সতত সুখের’ কি না সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে না-গিয়েও বলা যায় যে, অন্তত ‘স্মৃতি’র মধ্যেই থাকে শত-সহস্র ‘গল্প’, অথবা ‘গল্পের বীজ’? হ্যাঁ, সেই বার্তাই বহন করে নিয়ে এসেছে আলোচ্য বইটি। ‘গ্রাস গান অশ্রু’ (Gras Gan Ashru)। লেখক সা’আদুল ইসলাম। প্রকাশক ফারুক আহমেদ উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশন সংস্থার সম্পাদক ইতিমধ্যেই পাঠক দরবারে সমাদৃত হয়েছেন। নাতিস্থূল কলেবরের এই সংকলনটিতে যে দশটি ‘গল্প’ সজ্জিত হয়েছে, সেগুলি সাহিত্যের পরিভাষায় ‘ছোটগল্প’ হিসেবে কতটা শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে সে-নিয়ে চর্চা হতে পারে, কিন্তু গল্পগুলি যে ‘রসোত্তীর্ণ গল্প’ হিসেবে পাঠকের চিত্তজয়ে অনায়াস সক্ষম তা সন্দেহাতীত। সেটা সাহিত্যসৃষ্টি সাফল্যের একটা বড় দিক—‘পাঠকের চিত্তজয়’। তিনি অবলীলায় একটি গদ্যময় ‘আত্মস্মৃতি’ লিখতে পারতেন; যেমনটা অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু, সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান লেখক যে সেই চেনা পথে না-হেঁটে তাঁর স্মৃতিগুচ্ছকে গল্পের মনোরম মূর্তি দিলেন সেজন্য ‘বিশেষ কৃতিত্বের’ পুষ্পমালিকাটি তিনি অবশ্যই পাবেন। আসলে ‘গল্প’ বলতে যা বোঝায় তা তো সাহিত্যের অনেক আঙ্গিকেই লগ্ন হয়ে থাকে। ‘গল্প’ শব্দটির ব্যঞ্জনা ও ব্যাপ্তি বিপুল, গভীর। উপন্যাসে থাকে, নাটকে থাকে, এমনকী একটি উৎকৃষ্ট কবিতাতেও শেষপর্যন্ত যা থাকে তা হ’ল—‘গল্প’। কেবল ‘গল্পকে’ আমরা বিচ্ছিন্ন করি না এইসব থেকে এতটুকুই।
দ্বিতীয় গল্প ‘গ্রাস গান অশ্রু’ (Gras Gan Ashru) থেকে বইটির নামকরণ হয়েছে। বিচিত্র মানবজীবন এই তিনটি শব্দকে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করেই আবর্তিত হয়। জীবনে ‘গ্রাস’ (Gras Gan Ashru) বা ‘গ্রহণ’ থাকে, যেমন করে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয়। গানের সুরতরঙ্গে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে বা উল্লাসে বইতে থাকে জীবননদী। আবার তা কখনও কখনও বিষাদে, যন্ত্রণায় অশ্রুঅবরুদ্ধও হয়ে ওঠে। সেই হিসেবে প্রতিটি গল্পই এই নামের ছটায় দ্যোতিত বলা যায়। পেশায় অধ্যাপক গল্প-লেখক তাঁর ‘দ্যুতিপ্রিয়া’ কৃষ্ণার অনবদ্য সৃজনে ‘সূর্যগ্রহণ ও ডায়মন্ড রিং’ দেখে আপ্লুত হলেও তার ‘ব্যক্তিগ্রহণ’ ছাড়াতে না-পারায় বিষণ্নও হয়ে ওঠেন, যখন দাদার ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য সে নিজের একটি কিডনি বিক্রয় করতে চেয়ে স্যারের সাহায্যপ্রার্থী হয়, আর তিনি তাতে সম্মত হন না, এডুকেশন লোন নিতে বলেন। কৃষ্ণা চোখের জল ফেলে হয়তো পরে ঠিকই অনুভব করবে যে, স্যার এখানে কেবল তাঁর ‘শিক্ষক’ নন, হয়ে উঠেছেন একজন স্নেহার্দ্র, কন্যাঅন্তপ্রাণ, বিচলিত ‘পিতা’ ! আবার, আরেক ‘আলোর মেয়ে’ শর্মিষ্ঠা প্রায় নির্দেশের ভঙ্গিতে তাঁর বুক থেকে যখন মোবাইলটি সরিয়ে অন্যত্র রাখতে বলে এবং তিনি ‘দরজার আড়ালে সরে এসে রুমাল বের করতে বাধ্য’ হন এক অপার্থিব পুলকে, তখন সে-ও কি মানসপটে একজন ‘শিক্ষক’ নয়, বরং তাঁর ‘পিতা’-কে দেখতে পায়নি? এভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে তিনি ‘অন্য ভুবন’-এর শ্যামল ছবিটি পরম যত্নে উপস্থাপন করেন।
বস্তুত, প্রতিটি গল্পই লেখকের ‘হয়ে ওঠা’র গল্প। প্রথম গল্পটিতে ( ‘ক্লিওপ্যাট্রার কামিজ’ ) তিনি হয়ে উঠেছেন তাঁর ‘ভাড়াবাসার মালকিন’ জুন্না-র একান্ত আপনার, সহজ প্রতিবেশী, যে স্বহস্তে ‘পাকানো পিঠে’ নিয়ে হাজির হয় স্যরের ঘরে। এবং, একটি নিশীথে জুন্না ও তার প্রেমিকের নিবিড় অভিমান ও অনুরাগ পর্বের অবসানে স্যারও জানাতে ভোলেন না যে, জুন্নারও তো খাওয়া হয়নি! ক্লিওপ্যাট্রার মানসকল্পনায় জুন্নাকে আঁকতে গিয়ে এই গল্পে লেখক বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী উঠোনে রীতিমতো পাঠককে ভ্রমণ করিয়েছেন তাঁর অনবদ্য গদ্যশৈলীতে! এবং, সেখানে চকিতে ঢুকে পড়েছে তাঁর বিদগ্ধ গবেষণার বিষয়বস্তুর সংকেতসার, সুনিপুণ বাকভঙ্গিতে, ক্লান্তির ছাপ না-রেখেই। গল্পের এমন আঙ্গিক একেবারেই নতুন। এবং, আকর্ষকও।
‘ধলাসখির বাঁকাসোনা, পিয়ালি ও সুদীপ্তারা’ গল্পে ‘খেয়ালি মানুষ, রসিক’ বেঁকো বড়ভাইকে পিয়ালি নদীর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে গল্পকার লিখছেন : ‘পিয়ালির মতোই এঁকে বেঁকে তরতরিয়ে চলা তাঁর স্বভাবের অঙ্গ ছিল।’ এবং, নদীর সঙ্গে নারীর চিরাচরিত তুলনার গোত্রান্তরে যাওয়ায় লেখক দরদী স্বরে বলছেন—‘সুন্দরীরা দুঃখ করবেন না…’। ‘এই বড়ভাইকে কার না ভালো লাগবে, বলুন’—লেখকের এই কথনভঙ্গিটি বইয়ের বিভিন্ন গল্পের মধ্যে নানা বর্ণে ছড়িয়ে আছে। যেন আগেকার দিনের মঞ্চ থেকে কথক গল্প শোনাচ্ছেন আর শ্রোতার সঙ্গে এভাবে নিজের একাত্মতা গড়ে তুলছেন। অপূর্ব এই বয়নশিল্প! ‘বড়ভাই’-কে গল্পকার এঁকেছেন পরম মমতায়। বাস্তব যে এভাবে অঙ্কন-দক্ষতায় এত জীবন্ত, এত হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে তা না-পড়লে বোঝা যাবে না! কিশোরবেলায় একটি দুর্যোগে তাঁর ‘কাঁধে চেপে বাড়ি ফেরা’, আরও কিছু দৃশ্যকাব্য মনে করিয়ে দেয় সুনন্দা শিকদারের অনন্য স্মৃতি-আলেখ্য ‘দয়াময়ীর কথা’ বইটিকে। যে মুসলমান ভাগচাষিটির কোলে-পিঠে-কাঁধে চেপে লেখিকার কিশোরীবেলা কেটেছিল, তাঁর সঙ্গে চরিত্রগুণে, সুষমায় কী অনির্বচনীয় মিল গল্পকারের ‘বড়ভাই’এর ! এই গল্পেও একটি ‘দ্যুতিপ্রিয়া’ আছে—সুদীপ্তা ; সে-ও আলোর উৎসার নিয়ে এসেছে শিক্ষক-গল্পকারের জীবনচিত্রে।
‘খাট্টা ছিল, মিটঠা ছিল ; কিন্তু মির্চি ছিল না’ গল্পটি কি ক্রমশ শিথিল, অস্তমিত হতে থাকা শাশ্বত সহাবস্থানবাদী মূল্যবোধকে আভাসে চিনিয়ে দেওয়া? যে বাড়িতে সন্ধারতি হয়, আবার ভাড়াটিয়া শিক্ষক-গল্পকারের নামাজও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে থাকে, সেই বাড়ি থেকেই একসময় ভেঙে পড়া প্রমীলা কণ্ঠে ‘অন্য বাড়ি খুঁজে নিতে’ বলার কাতর আর্জি ধ্বনিত হয় ; নতুন প্রজন্মের কাছে ‘সহাবস্থান’ শব্দটি অর্থের গৌরব হারানোয় এবং সনাতন ও কাতর কণ্ঠটি সেই প্রজন্মকে ‘অতিক্রম’ করতে না-পারায়! খুব ইঙ্গিতময়, অন্তিমে বেদনাবহ গল্পটি !
আরও পড়ুন: মা
আরেকটি গভীর বেদনার্ত গল্প—‘একটি কান্নার ইতিকথা’; যেখানে লেখক একটি ব্যাঙের করুণ মৃত্যুদৃশ্য রচনা করেছেন আশ্চর্য এক দ্রষ্টার জ্যোতির্ময় অন্তর দিয়ে। ‘ঐ আর্তস্বরের মধ্যে দিয়ে সে যে জীবনের জন্ম রেখে গেছে, তার আনন্দধ্বনিও কি মিশে ছিল?’ এই অনুভবদীপিত বৌদ্ধিক কল্পনার কারণ, একটু আগেই তো ‘রমণক্লান্ত সহর্ষ’ ছিল সে। এই ‘দেখা’ অন্তরচক্ষু দিয়ে ‘দেখা’, যা আর সাধারণ, আটপৌরে চোখের ‘দেখা’ হয়ে থাকে না, বরং গভীর সংবেদনামিশ্রিত ‘অন্তর্দৃষ্টির আলো’ হয়ে ওঠে এবং পাঠককে পৌঁছে দেয় বাকরহিত এক আশ্চর্য মানবিক অনুভূতি ও বীক্ষার উপান্তে, যা একজন গল্পকারের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ‘আত্মবোধ’ গল্পটিতে ফুটে উঠেছে ‘অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী’ পেরিয়েও লেখকের চোখ দুটো ‘ঝাপসা’ করে দেওয়া ‘অভিমানী মেয়েটি’র স্মৃতি। সেই ‘মেয়েটি’ আপন কর্তব্যে বরাবর অবিচল থেকেছে, কিন্তু প্রবল ‘আত্মবোধ’ থেকে কখনও আর লেখকের বাড়ির ভেতরে সে ঢোকেনি। পাঠক চমকে যাবেন জানলে যে, লেখক যাকে তাঁর ‘অভিমানী মেয়েটি’ বলছেন সে একটি ‘কুকুর’! মনুষ্যতের প্রাণীর প্রতি এমন ‘সম্ভাষণ’ কে কবে শুনেছে! লেখক এভাবে নিজের সত্তাকে যেন বিশ্বের সবকিছুর সঙ্গেই সংযুক্ত করছেন অন্তহীন মমত্বের সূত্রে! আবার গল্পকার অতি-সরস, উপাদেয় ভঙ্গিতে তাঁর একটি ‘আক্কেল দাঁত’কে নিয়ে যখন ‘বেদনার মতো’ গল্পটি লিখছেন তখন সেটি প্রথমে পড়তে পড়তে মনে হবে যে, যেন একটি স্বাদু প্রেমের গল্প পড়ছি! কত বিচিত্র আর বর্ণিল তার রূপনির্ঝর ; অথচ, ব্যাপারটা যে মোটেই তা নয় সেই ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র মতো চমকটা তিনি রেখেছেন গল্পের শেষাংশে। সর্বশেষ ‘বুড়ো আঁবশ্যে, যুবতী শাড়ি ও ডাগরা শোল মাছ’ গল্পটিকে একটি চমৎকার আধিভৌতিক গল্প বলা যায়। রহস্যের অপূর্ব বুনোটে চোখের সামনে যে দৃশ্যপট রচিত হয় তাতে সত্যিই যেন গা ছমছম করে! আরও দুটি গল্প আছে। ‘পতিতপাওনজি কুছ কো ভি কিরপা সে ছোঢ়তে নহি’ আর ‘নক্ষত্র’। অসাধারণ দুটি গল্প।
প্রত্যক্ষ করা ঘটনা, দৃশ্যাবলি, নানা স্মৃতি লেখকের জীবনকে কীভাবে আন্দোলিত করেছে, নানা রঙের ও রূপের মানুষকে দেখে তাঁর মানবিক সত্তাটি কীভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সত্য ও সুন্দরের অনুভবে, আনন্দ ও বিষণ্নতার আবেগতরী বেয়ে, তারই অপরূপ বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে দশটি নিটোল, অনবদ্য ও সুখপাঠ্য গল্পে। একটি প্রত্যন্ত গ্রামে যাঁর শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত ও পরিব্যাপ্ত— এতটাই যে পরে পেশার সূত্রে বন্দরে বন্দরে নোঙর ফেলা নাগরিক জীবনের নানা স্মৃতি আর অভিজ্ঞতায় তিনি ‘বিবর্ধিত’ হলেও গ্রাম ও গ্রামের পথঘাট, বনবাদাড়, প্রান্তর, নদী এবং অতি-অবশ্যই গ্রামের মানুষজন তাঁকে এক-মুহূর্তের জন্যেও ‘ছেড়ে’ যায় না ; বরং প্রতি-মুহূর্তে জড়িয়ে রাখে মরমী লতার মতো, তারই বিমূর্ত ক্যানভাস সমগ্র গল্প-সংকলনটি। গ্রাম ও শহর-নগরকে তিনি যেন বিনিসুতোর মালায় গেঁথেছেন; একটি লয়েই যার অন্তর্গত সুরধারা ভেসে চলে —‘সর্বত্রই আমি কেবল জীবনের অপূর্ব সঙ্গীত বাজতে দেখেছি!’ লোকজ শব্দব্যবহারে ও মৌলিক গদ্যভাষার বয়নশিল্পে গল্পকার সিদ্ধহস্ত। বইটির প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়। মুদ্রণ-পারিপাট্যও চমৎকার।