সন ১৮৬০। ইন্ডিয়ান পেনাল কােডে একটা সংশোধনী আনা হল। সংযোজিত হল ১২৪এ ধারা।
এই ধারার মাধ্যমে বলা হয়, যারাই রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সে-সবেরই বিধান যুক্ত হয়েছিল এই ধারায়। এই ধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের দমন সুনিশ্চিতকরণ।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা (Sedition Law) সংক্রান্ত এই আইন বলবৎ হওয়ার পর যাঁকে প্রথম গ্রেফতার করা হল, তিনি হলেন লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক (Bal Gangadhar Tilak)। ‘কেশরী’ পত্রিকায় কয়েকটা নিবন্ধ লিখেছিলেন তিলক। তারই একটিতে তিনি সমর্থন করেছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডকে। মজফ্ফরপুরে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কিংসফোর্ডকে খতম করার লক্ষ্যে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই অগ্নিময় কাজটিতে অন্যায় কিছু দেখেননি তিলক। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হল এই ১২৪এ ধারায়, সিডিশন চার্জে। তিন বছর জেল খাটতে হয় তাঁকে। এই ধারা একবার নয়, দু-দুবার প্রয়োগ করা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধেও। মিতভাষী, শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন গান্ধী। তিনিও বিরক্ত হয়েছিলেন এই ধারা প্রয়োগের ধরনধারণ দেখে। ক্ষুব্ধ বিরক্ত গান্ধীও বলে উঠেছিলেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ১২৪এ ধারায় আইনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তাঁর সংক্ষুব্ধ হৃদয়ের বাঙ্ময় প্রকাশ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এই ধারায়। সংক্ষেপে, ভারতবর্ষের সকল স্বনামধন্য বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কোনও না কোনও সময় এই ধারায় কারাগারে প্রবিষ্ট হতে হয়েছে। বহু সাধারণ মানুষকেও নেহাতই সন্দেহের বশে এই ধারায় জেল খাটানো হয়েছে।
এজন্যই, স্বাধীনতার আগে থেকেই এই কালা কানুন বাতিলের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতা-উত্তর পর্বেও এই আইন বাতিল হয়নি উলটে, যে সরকার যখনই দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হয়েছেন তাঁরা সযত্নে এই আইনটিকে লালনপালন করেছেন। যখনই যেখানে কেউ সরকারের সমালোচনা করেছেন, সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত করেছেন, তখনই তাঁকে এই ধারা প্রয়োগ করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কারাবাস নিশ্চিত করে দমন করা হয়েছে প্রতিবাদী কণ্ঠ। সরকার বিরোধী আন্দোলন রুখতে বারংবার হাতিয়ার করা হয়েছে এই কালা কানুনকে। ফলত, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার। এই সংক্রান্ত ভূরি ভূরি নজির যদি লিপিবদ্ধ করা হয় তা হলে একটা বিশালাকৃতির বই হয়ে যাবে। সেসব বিস্তারিত আলোচনার পরিসর এটি নয়।
শুধু এক্ষেত্রে এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, মোদি-জমানার আগে এই কালা কানুনের এমন তীব্র স্বৈরতান্ত্রিক অপব্যবহারের সাক্ষী স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ দেখেনি।
উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরের খেরিতে কৃষক নিধনের সেই নৃশংস ঘটনাটি ঘটল। সেই সংবাদ জনসমক্ষে প্রকাশের তাগিদে ছুটলেন যে সাংবাদিক তাঁকে মাঝরাস্তায় পুলিশ গ্রেফতার করল। কালাকানুন প্রয়োগ করে তাঁকে কয়েদ করা হল। এখনও কারান্তরালে দিন কাটছে তাঁর।
ভারভারা রাও একজন বৃদ্ধ কবি। অসুস্থ। ক্যাথিটার ছাড়া চলাচল করার শক্তিটুকুও নেই তাঁর। সেই মানুষটির বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন, ১২৪এ। মুমূর্ষু এই মানুষটিকেও কারাবাস করতে হচ্ছে এখনও, সেই কারণেই।
এরকম অসংখ্য নজির সৃষ্টি করেছেন নরেন্দ্র মোদি সরকার। গণকণ্ঠ রুদ্ধ করতে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করেছেন এই কালা কানুন।
দেশের অভ্যন্তরে নানাস্তরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আওয়াজ উঠেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এই কালা কানুন বাতিলের জন্য শীর্ষ আদালতে আবেদন জানিয়েছেন। একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও এরকম আবেদন একাধিকবার নানা পর্যায়ে জানানো হয়েছে।
দেশের বাইরেও এই সরকারের মানবাধিকার হরণ নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে। এই কালা কানুনের যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং আমেরিকার সেনেটে ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হয়েছে। সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনাকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়টি তুলেছেন।
আরও পড়ুন: তৃণমূল ভবনে নতুন রোস্টার
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে এরকম তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন (Sedition Law) নেই। আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম এবং কানাডায় সিডিশন ল বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন (Sedition Law) আছে। কিন্তু সে-আইন সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য নয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশে কোনওরকম বিদ্রোহ দেখা দিলে তা প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে ওই আইনটি ওই দেশগুলোতে রয়েছে। এর বাইরে সিডিশন ল ব্যবহারের কোনও অজুহাত ওই দেশগুলোতে নেই। এর বাইরে অধিকাংশ দেশে হয় এই কানুন প্রত্যাহৃত কিংবা তার অস্তিত্বই নেই।
এই প্রেক্ষাপটে ১১ মে ২০২২ একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। বলেছেন, সরকার আইনটি নিয়ে বিবেচনা পুনর্বিবেচনা করুন।
শীর্ষ আদালত যদি আইনটিকে সরাসরি বাতিল ঘোষণা করতেন, তবে হয়ত সেটিই কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ হত। তা না করে, সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, সরকার আইনটি নিয়ে বিচার বিবেচনা করুন। যতদিন না সেই বিচার বিবেচনার কার্যটি শেষ হচ্ছে এবং সরকার এ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারছেন, ততদিন এই আইনটি কোথাও কোনওভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। তদুপরি, যাঁরা ইতিমধ্যে এই আইনের অধীনে কারারুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁরাও সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দেখিয়ে জামিনের আবেদন করতে পারবেন। যেহেতু নিজেদের পিঠ বাঁচাতে আদালতে হলফনামা দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন নিয়ে পুনর্বিবেচনার কথা কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিলেন, সেহেতু তাঁদের আরও একবার সুযোগ দিলেন সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতিরা বারবার বলেছেন, অন্যান্য আইনে রাষ্ট্রবিরোধিতা করলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এই কালা কানুনটিকে জিইয়ে রাখার আবশ্যকতা কোন যুক্তিতে? সে-প্রশ্নের কোনও সদুত্তর কেন্দ্রের তরফে সলিসিটর জেনারেল মহোদয় দিতে পারেননি।
একরাশ গুমোটের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায় এক পশলা বৃদ্ধির মতো। এতে যে গুমোট একেবারে কেটে যাবে, তা কিন্তু নয়।
নয় এই কারণেই যে, সরকার পক্ষ বিস্তর বিবেচনা পুনর্বিবেচনার পর আইনটিকে বহাল রাখার সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারেন। নতুন কোনও বিধি এনে, ঘুরপথে এই কালা কানুন টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে পারেন।
এজলাসে সরকারের ভূমিকাতেই স্পষ্ট যে পুনর্বিবেচনার অছিলায় তারা আইনটিকে পুনর্বহাল রাখার অজুহাত খোঁজার জন্য সময় কিনছে। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তৃণমূল কংগ্রেস সেই অপচেষ্টা সর্বপ্রকারে রুখবে। এ-ব্যাপারে আমরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।
সাময়িক স্বস্তিতে আমরা পুরোপুরি আশ্বস্ত নই। কারণ, এই সরকার আর যা-ই হোক জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত নয়।