কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এসে বলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের প্রশ্নই নেই। কেউ কেউ ভাবতে পারেন পদ্ম-শিবিরের (BJP- WB) এই কর্তা কত মহান সেটা প্রমাণ করে দিলেন। কিন্তু আদতে বিষয়টি তা নয়। রাষ্ট্রপতি আসলে ‘না’ বলাটা অমিত শাহর মহানুভবতা নয়, বাধ্যবাধকতা। সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের হাত আগেই বাঁধে দিয়েছে। বিজেপি চাইলেই পারবে না গায়ের জোরে মমতা বন্দ্যোপাধায়কে ক্ষমতাচ্যুত করতে।
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের সরকার। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। জনতা দলের এস আর বোম্বাই কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে। কয়েকজন বিধায়ক দলত্যাগ করেছিলেন। তাঁরা জনতা দলের বিধায়ক ছিলেন। তাতে রাজ্যপালের মনে হয়েছিল, বোম্বাই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ওই সুপারিশ মেনে কেন্দ্রীয় সরকার কর্নাটকে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছিল।
বোম্বাইয়ের বক্তব্য ছিল, রাজ্যপালের ধারণা সঠিক নয়। কংগ্রেসের হাতে তামাক খেয়ে এই ‘অপকর্ম’ করা হয়েছে। বিধানসভায় ভোটাভুটি হলে তিনি প্রমাণ করতে পারতেন, সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। কিন্তু রাজ্যপাল তাঁকে সে সুযোগ দেননি। তাই রাজ্যপালের কাজ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের বিরোধী। এই অভিযোগের বিচার চেয়ে বোম্বাই সুপ্রিম কোর্টে ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
সুপ্রিম কোর্ট বোম্বাইয়ের পক্ষে রায় দিয়েছিল। তাতে বলেছিল, ‘‘কোনও সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিনা তা যাচাই করার একমাত্র জায়গা হল বিধানসভা। কারও বৈঠকখানা নয়!’’ সুতরাং তৃণমূল কংগ্রেসের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকারের গায়ে হাত দেওয়ার মুরোদ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের নেই। সেই স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সুপ্রিম কোর্ট আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন: বিচিত্র সৃষ্টির রহস্য
বাংলায় এর আগে দু’বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ঘটনা ঘটেছিল। কী কারণে সেটা হয়েছিল, তা কি বঙ্গ বিজেপির নেতারা ভুলে গিয়েছেন? ১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এ-রাজ্যে কংগ্রেস হেরে যায়। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দু’বছর যেতে না যেতেই যুক্তফ্রন্টের শরিকি বিরোধে অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার ভেঙে যায়। কারণ, ফ্রন্টের শরিকদলের বেশ কিছু বিধায়ক সিপিএমের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ তুলে বেরিয়ে যান। সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হারিয়ে ফেলে। রাজ্যপাল ধরমবীর বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের সুপারিশ করেন।
দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি শাসন কায়েম হয় কার্যত একবছরের মধ্যেই। অজয়বাবু মুখ্যমন্ত্রী থেকেও সিপিএমের বল্গাহীন সন্ত্রাস মেনে নিতে পারেননি। সেই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ছিল না। পুলিশমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তাই অজয়বাবু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘অসহায়’ ছিলেন। অবশেষে নিজের সরকারকে ‘অসভ্য’ এবং ‘বর্বর’ বলে মুখ্যমন্ত্রী কার্জন পার্কে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করেন। সেবারও যুক্তফ্রন্টের শরিকি বিরোধ চরমে ওঠে। সরকার ভেঙে যায় এবং রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
ইতিহাস বলছে, সেই পরিস্থিতি আজ নেই। আর নেই বলেই, প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষকর্তা অমিত শাহকে বলতে হচ্ছে, ৩৬৫ কিংবা সিবিআই দাওয়াই নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে চাই লাগাতার আন্দোলন। যেমনটা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সিপিএমের বিরুদ্ধে। যথার্থ বিশ্লেষণ। সকালে ঘুম থেকে উঠে, খবরের কাগজ পড়ে, টিভির খবর দেখে, গোটাকতক ঝান্ডাধারী লোক নিয়ে একটা মিছিল-মিটিং করে বঙ্গ বিজেপির নেতা-নেত্রীরা আন্দোলনের দায় সেরে ফেলেন। টিভির পর্দায় টিকে থাকার লড়াই, আর আমজনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা, সংগ্রাম করা অন্য জিনিস। যে জিনিস ১৯৮৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত করে দেখিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের অত অত্যাচারও তাঁকে দমাতে পারেনি।
কোথায় বিজেপির সেই নেতৃত্ব? কাণ্ডজ্ঞানহীন নেতা-নেত্রীদের হাতে লাগাম চলে দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের (BJP- WB)। তা না হলে কাশীপুরের ঘটনায় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সেখানে সরাসরি হাজির করানো হয়! অর্জুন চৌরাসিয়ার ঘটনাকে হাতিয়ার করে অমিত শাহকে সামনে রেখে বিজেপি ভেবেছিল বাজিমাত করবে। কিন্তু কাশীপুরের সেই কেস এখন তাদের দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। শাহ-মোদি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছেন, বঙ্গ বিজেপি (BJP- WB) এখন তাঁদের কাছে মস্তবড় বোঝা।
দু’দিনের বাংলা সফর শেষ করে অমিত শাহ ফিরে যেতে না যেতেই পদ্ম শিবিরের বিদ্রোহের আগুন ফের জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। একাধিক জেলায় বিরোধীরা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এই দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, বঙ্গ বিজেপির হাল ধরার কেউ নেই। দলটি পাল ছেঁড়া নৌকায় পরিণত হয়েছে। এতটাই হতাশা তাদের গ্রাস করেছে যে, বিভিন্ন জেলার নেতারা সোশ্যাল মিডিয়ায় খোদ অমিত শাহকেই টার্গেট করে একাধিক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ-রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প বিজেপি হতে পারে না।