কংগ্রেস (Indian National Congress) পথ খুঁজছে। পথের খোঁজে শতাব্দীপ্রাচীন দলটি এখন মাঝে মাঝে ঘটা করে চিন্তনশিবির বা এই রকম গালভরা নাম দিয়ে কিছু একটা করে থাকে। তাতে অবশ্য গন্তব্যের হদিশ মেলে না। গোলকধাঁধায় ঘোরাফেরাই সার হয়। কংগ্রেসের এই হালভাঙা, পালছেঁড়া অবস্থা দেখে দুঃখ হয়।
কংগ্রেসের (Indian National Congress) চিন্তনশিবিরের মতো কিছু একটা হলেই সিপিএমের প্লেনামের কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সিপিএম বাংলার সুবেদারি পেয়েছিল। তখন জ্যোতি বসু, প্রমােদ দাশগুপ্ত, বাসবপুন্নিয়া, নাম্বুদিরিপাদ প্রমুখ সিপিএম-এর মাথারা ভাবলেন, অল্পে খুশি হতে নেই। দরকার, দেশের শাহেনশা হওয়া। কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব হবে তা ঠিক করতে হাওড়ার সালকিয়ায় খুব ধুমধাম করে সিপিএম-এর প্লেনাম হয়েছিল। সেই প্লেনামে পার্টির তত্ত্বাবধানে নেতারা প্রচুর মাথা খাটিয়ে পথ চিনে নিয়েছিলেন। সেই পথটি ছিল ত্রিপুরা, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি থেকে বেরতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতিবাবুর সরকার অনেক ভাল ভাল কাজ করছে। সেইসব দৃষ্টান্ত দেখিয়ে প্রতিবেশী ওড়িশা, বিহার, অসমের মতো রাজ্যে লালদুর্গ গড়ে তুলতে হবে। তার প্রভাব উত্তরপ্রদেশ এবং হিন্দি বলয়ে পড়বে। ব্যাস। আর দেখতে হবে না। সিপিএমের দিল্লির লালকেল্লা ফতে করা তখন সময়ের অপেক্ষা।
সালকিয়া প্লেনামের লক্ষ্য ছিল, সারা দেশে কংগ্রেসের (Indian National Congress) একমাত্র বিকল্প হয়ে ওঠা। তাহলেই কংগ্রেস খরচের খাতায়। সালকিয়া প্লেনামের ওইসব সাধ এখন ধুলায় ধূসরিত। আর তাদের লালপার্টি জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে কাটা সৈনিকের ভূমিকায়।
সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের ভূমিকা সিপিএমের থেকে সামান্য ভাল। এইটুকু পুঁজি নিয়ে তাদের আস্ফালনের শেষ নেই। উদয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তনশিবির থেকে সেই হুঙ্কারই শোনা গিয়েছে। তা শুনে মোদি-শাহের বুক ধড়ফড় করছে কিনা জানা নেই। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দল প্রচুর আমোদের খোরাক পেয়েছে।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রের বকেয়া থেকে পেট্রোপণ্যের অগ্নিমূল্য নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়
কংগ্রেস তো এখন কার্যত জমিহীন জমিদার। পায়ের তলায় মাটি বলতে আছে রাজস্থান আর ছত্তিশগড়। এই নিয়ে উদয়পুর থেকে তাঁরা আস্ফালন করেছেন, তাঁদের নেতৃত্ব না মানলে বিজেপি-বধ সম্ভব করার সাধ্য কারও হবে না। বলাই বাহুল্য, কংগ্রেসের এই হাঁকডাক শূন্যগর্ভ। অবাস্তব। কাণ্ডজ্ঞানহীন। কথায় আছে না শূন্য কলসির আওয়াজ বেশি!
যে উদয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তনশিবির হল, সেই রাজস্থানেরই মাউন্ট আবুতে আজ থেকে ২০ বছর আগে একই আসর বসেছিল। তখন দেশের ১৪টি রাজ্যে কংগ্রেসের শাসন ছিল। পরবর্তীকালে দলের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ২০১৭ সালে রাহুল গান্ধীর মতো তরুণ তুর্কিকে দলের সভাপতি করে সামনে আনা হয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস মুখ থুবড়ে পড়ল। তারপর থেকে ঘুরে দাঁড়ানো দূরের কথা, কংগ্রেস এখন মাত্র দুটি রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে। কংগ্রেসের এই করুণ হাল নিয়ে আলোচনা করতে হলে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। নরসিমা রাও তখন প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার। নরসিমার নিজের রাজ্য অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতিতে বসেছে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সংগঠন এআইসিসি-র অধিবেশন। লোকসভার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেসের ছিল না। কিন্তু কৌশলে ডান এবং বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে দিব্যি সরকার চালাচ্ছেন নরসিমা রাও।
সেই প্রথম নেহরু-গান্ধী পরিবারের হাতে কংগ্রেসের লাগাম নেই। সোনিয়া গান্ধী পর্দার অন্তরালে। স্বামী রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর শোকে তখনও তিনি মূহ্যমান। নেহরু-গান্ধী পরিবার ছাড়া স্বাধীনতোত্তর ভারতবর্ষে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তিনি বেশিদিন সেই চেয়ারে বসার সুযোগ পাননি। জহরলাল নেহরুর পর ইন্দিরা গান্ধী ফের পরিবারের হাতে নেন দেশ শাসনের দায়িত্ব। দীর্ঘদিন তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ইতিমধ্যে কংগ্রেসে ভাঙন ধরে। কিন্তু তাতেও ইন্দিরার জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতা খর্ব হয়নি। বরং বৃদ্ধি পায়। কারণ, তাঁর নেতৃত্বের গুণ। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দেশে ইন্দিরারাজ চলে। সেই বছর আবার লোকসভার ভোটে জনতা পার্টি উড়িয়ে দেয় কংগ্রেসকে। ইন্দিরা ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু দেশের প্রথম অকংগ্রেসি সরকারের আয়ু ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯৮০ সালে ফের দিল্লির মসনদে স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করেন ইন্দিরাজি। ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবরে আততায়ীর হাতে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হলেও, কংগ্রেস বেঁচে যায়। তাঁর প্রতি সহানুভূতির হাওয়ায় বিরোধীপক্ষকে ধরাশায়ী করে কংগ্রেস দিল্লি শাসনের অধিকার পুনরায় অর্জন করে। ১৯৮৪-র ভোটে লোকসভায় কংগ্রেস কেবল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাই পায়নি, ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে অভিষেক হয় রাজীব গান্ধীর। তবে রাজীবের আমল থেকেই বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় হতে শুরু করে। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ। দক্ষিণ ভারতে আজ কংগ্রেস চারটি রাজ্যেই ক্ষমতা থেকে দূরে চলে গিয়েছে। অথচ, অন্ধ্র এবং কর্নাটক ছিল তেরঙ্গার দুর্ভেদ্য দুর্গ। অন্ধ্রে সেই আমলে বিধানসভা ভোটের মাত্র ৮ মাস আগে নতুন দল তেলুগু দেশম গড়ে অভিনেতা এন টি রামা রাও কংগ্রেসকে গোহারা হারান।
আসলে নেতৃত্বের অক্ষমতা রাজীবের অকালমৃত্যুর পর থেকেই প্রকটা হয়। নরসিমা রাও থেকে মনমোহন সিং— এই দুই প্রধানমন্ত্রীর ১৫ বছরের রাজত্বেও কিন্তু কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না। কেন্দ্র সরকার চলেছিল শরিকদের সাহায্যে। তিরুপতি অধিবেশনেও কংগ্রেস বলেছিল, একলা চলতে হবে। এমনকী ১৯৯৮ সালে মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারি চিন্তন শিবিরেও কংগ্রেস নেতাদের কণ্ঠে একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দিল্লির সরকার পরিচালনা করতে কংগ্রেসকে নির্ভর করতে হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর সোনিয়া কিছুটা দেরিতে এলেও, দলের কান্ডারি হয়েছেন বটে তাতে কংগ্রেসের কোনও লাভ হয়নি। আঞ্চলিক দলগুলিকে উদয়পুর চিন্তনশিবির থেকে বস্তুত উপেক্ষার ডাক দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু কংগ্রেসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করছে, এই মুহূর্তে এর চাইতে কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা আর কিছু হতে পারে না। বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক ফলাফলে প্রমাণিত, কংগ্রেসকে অক্সিজেন জোগাতে পারে তথাকথিত আঞ্চলিক অ-বিজেপি দলগুলিই। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের পরীক্ষা আগেই হয়ে গিয়েছে। তার ফল হল, বিজেপির বাড়বাড়ান্ত! জাতীয় পর্যায়ে কংগ্রেস নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন, এভাবে চললে দলের অন্তর্জলি যাত্রা সময়ের অপেক্ষা।
২০১৭ সালে দলপতি হওয়ার পরেও এই রাহুল গান্ধী মনে করেছিলেন এককভাবেই কংগ্রেস দেশে বিজেপি-বিরোধী লড়াই করতে পারবে। সেই স্বপ্নের সলিলসমাধি হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। কোনও ধারাবাহিক লড়াই ছাড়াই রাহুল নিজেকে মস্তবড় নেতা মনে করতে পারেন, কিন্তু বাস্তব বলছে এখনও তিনি যথেষ্ট অপরিণত। আর অপরিণত নেতৃত্বের হাতে দলের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে কংগ্রেসেরই সর্বস্তরে।