ভারতীয় জনতা পার্টি এখন তার নির্বাচনী পরাক্রমের ওপর নির্ভর করে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। ‘ডবল ইঞ্জিন সরকারের’ অছিলায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করতে চাইছে। এই অবস্থায় আজ সব থেকে বেশি প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পরিসর। এই অবস্থায় তৃণমূল কংগ্রেস (All India Trinamool Congress) পাখির চোখের মতো অবিচল নিশানায় বিরোধিতা করে যাচ্ছে। এই বিরোধিতার জোর এতটাই যে ভারতীয় জনতা পার্টিকে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করে বক্তব্য পেশ করতে হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের (All India Trinamool Congress) একার লড়াই মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক সংগঠনের নেতা ভারতে কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস এ ডাঙ্গেকে। যিনি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ঐক্যবদ্ধ বিরোধী-পরিসরের কথা বলে ১৯৭০-এর দশক থেকে নিজের বামপন্থী দলের কাছেই ব্রাত্য হয়ে পড়েন। আজ যখন ফ্যাসিবাদী শক্তি শিখর ছুঁয়েছে-প্রায় তখন বামপন্থী দলগুলো এস এ ডাঙ্গের নাম ও কর্মকাণ্ডকে ব্রাত্য করেই রেখেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এস এ ডাঙ্গের নিরলস সাধারণ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জন্য আন্দোলনের রূপরেখাকে সামনে রেখে ২০২৪-এ ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মঞ্চ গড়ার আবশ্যিকতা অনুভূত হচ্ছে ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্রদের কাছে।
বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে পুরনো ভুলে যাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পুনর্মূল্যায়ন করার প্রবণতা চোখে পড়ছে। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্র ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (Indian Council of Social Science Research) এই প্রচেষ্টার নাম দিয়েছে ‘রিমেমবারিং আনসাং হিরোস অফ ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’। এই অছিলায় ভারতীয় জনতা পার্টি মদনমোহন মালব্য, সর্দার প্যাটেল, বীর সাভারকর, বিরসা মুন্ডা প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের গুরুত্ব তুলে ধরছে যাঁরা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করেছিলেন কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করেননি। এখানেই এস এ ডাঙ্গের প্রাসঙ্গিকতা। বর্তমানে ভারতীয় জনতা পার্টি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মকে মেলাতে চাইছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে এস এ ডাঙ্গে একমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে মেলাতে চেয়েছেন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে ফ্যাসিবাদী দক্ষিণপন্থী শক্তিকে পরাস্ত করতে বলেছিলেন, “ইন্দিরা ও জনসংঘের মধ্যে আমার পছন্দ ইন্দিরা” (between Indira and Jana Sangh, I prefer Indira)। পরবর্তী সময়ে অনেকেই এই বক্তব্যকে ইন্দিরা গান্ধীর স্তুতি বলেছিলেন। কিন্তু আসলে ডাঙ্গে বুঝিয়েছিলেন, সেই সময়ে ফ্যাসিবাদী দক্ষিণপন্থী বিরোধী শক্তি হিসেবে একমাত্র উপস্থিত ছিল ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। তাই সেটাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: হরর-থ্রিলার অন্তরদৃষ্টির দ্বৈত চরিত্র নিয়ে হাজির ঋতুপর্ণা
একইভাবে ২০২২-এ দাঁড়িয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের লড়াই সংগঠিত করার সময় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস একমাত্র ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শক্তি যারা সর্বতোভাবে ভারতীয় জনতা পার্টির ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে যাচ্ছে| আর তাই এস এ ডাঙ্গের সূত্র ধরে বলাই যায় আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি (যারা সেদিন কর জন সংঘের উত্তরসূরি)-র থেকে ভারতীয় রাজনীতিক কৃষ্টিকে এবং সংবিধানের মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখতে তৃণমূল কংগ্রেস অন্য যে কোনও রাজনৈতিক দলের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, জাতীয় স্তরেও অন্যান্য অবিজেপি দলের কাছে তাদের এই লড়াই শিক্ষণীয়। বামপন্থী আঁতলেমির অছিলায় এই নির্ভেজাল সত্যটাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
এস এ ডাঙ্গে বামপন্থী ছিলেন কিন্তু বামপন্থী দলীয় অন্ধত্ব তাঁর মধ্যে ছিল না। তাই বারংবার তিনি তাঁর সিপিআই দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এস এ ডাঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করেছিলেন। অনেকেই এর ফলে ডাঙ্গেকে গণতন্ত্র-বিরোধী বলে দেগে দিয়েছিলেন। এমনকী তাঁর নিজের সিপিআই দলেও তাঁর জোরালো সমালোচনা করা হয়। ইতিহাস আমাদের নিশ্চয়ই মনে করাবে যে সেই সময়েই ভারতীয় সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এই দুটি নীতি প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ডাঙ্গে বুঝেছিলেন উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজে শাসনক্ষমতা যে দলের হাতেই ন্যস্ত থাক, ক্ষমতার নিজস্ব ভাষা, আচরণ ও গতিপ্রকৃতি থাকে যা অনিবার্য। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন কোনও ব্যক্তি ভাল বা সম্পূর্ণ খারাপ হয় না তারা ভাল-মন্দ মিশ্রিত হয়| এই সূত্র ধরে বলা যায় যে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনের সমালোচনা করা সোজা, কিন্তু এই সরকারের শাসনকালেই বিভিন্ন প্রকল্প ও জন-পরিষেবামূলক কর্মসূচিতে বিশ্বের ও কেন্দ্রীয় সরকারের কুর্নিশ লাভ করেছে সেকথা অস্বীকার করাও কঠিন। তাই যেখানে লড়াইটা বৃহত্তর সেখানে আঞ্চলিক পরিসরে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় স্তরে বিরোধিতার বার্তা বহন এবং বিরোধী ঐক্যমঞ্চ গড়ে তোলার কাজ বিজেপি-বিরোধী দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হওয়া উচিত। আর এটাই তৃণমূল কংগ্রেস করছে।
এস এ ডাঙ্গে ১৯৭২ সালে যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তাতে ফ্যাসিবাদ দক্ষিণপন্থী শক্তির বিকল্প পরিসরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলি ছিল দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র, যদিও এই দুটি রাজনৈতিক দল ডাঙ্গের দেখানো পথে কোনওদিনই চলেনি। বর্তমানে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলি নিজেদের ভুল নীতি ও কর্মসূচির জন্য নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে| এমতাবস্থায় ভারতীয় জনতা পার্টির ‘আচ্ছে দিনে’র ফলে যখন বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং হিন্দুত্ববাদী জিগিরের জন্য সাধারণ মানুষের দমবন্ধ অবস্থা, তখন এস এ ডাঙ্গের রাজনৈতিক মন্ত্র প্রাসঙ্গিক— “চলুন আমরা আলাদা আলাদা ভাবে বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটি, কিন্তু রাজনৈতিক আঘাত একযোগে করি” (Let us march separately but strike together)। এটাই তাঁর দেখানো পথ, এটাই ডাঙ্গে লাইন। আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস সরকার দলের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেদের সরকারকে সাধারণের জন্য উৎসর্গ করে ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকার বলে অভিহিত করে। ঠিক যেমন করে ডাঙ্গে নিজেকে দলমতের ঊর্ধ্বে শ্রমজীবীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে তুলে ধরতেন। ২০২৪-এর নির্বাচনী রাজনীতি আর দৈনন্দিন রাজনীতি এবং তার কৌশল আলাদা হতেই পারে| কিন্তু সেজন্য এস এ ডাঙ্গের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিজেপি-বিরোধী ‘প্রকৃত’ রাজনৈতিক দল না হয়ে ‘প্রকৃত’ রাজনৈতিক মঞ্চ বা জোট গড়াই এখন প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত সমস্ত বিজেপি-বিরোধী গণতন্ত্রকামী প্রগতশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির। এটাই সময়ের দাবি।
যে বা যারা সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, জাতীয়তাবোধে আসক্ত হয়ে, রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা থেকে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জন্য নিবেদিত হয়ে ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সাংবিধানিক মূল্যবোধকে পাথেয় করে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে পরাস্ত করতে রাজনৈতিক কৌশল কার্যকর করতে ইচ্ছুক ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁদের আজ তাবৎ ন্যাকামি নস্যাৎ করে, এস এ ডাঙ্গেকে রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে মান্যতা দিয়ে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (All India Trinamool Congress- Mamata Banerjee) নেতৃত্ব ও আদর্শকে সামনে রেখে এগোতে হবে ২০২৪-এর পথে। তবেই জয় অবশ্যম্ভাবী।