ফলহারিণী কালীপুজোর সুলুকসন্ধানে

যিনি আমাদের কর্মফল হরণ করেন এবং মুক্তি প্রদান করেন তিনিই ফলহারিণী কালী। আমাদের সমস্ত বিপদ, দৈন্য, ব্যাধি এবং সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ করে তিনি ঐশ্বর্য্য, আরোগ্য, বল, পুষ্টি ও গৌরব প্রদান করেন।​ বিশ্বাস, ফলহারিণী কালীপুজো করলে পূজারির ও ভক্তের কর্ম ও অর্থভাগ্যে উন্নতি ঘটে। সাংসারিক নানা বাধা দূর হয়। জীবনে সুখ-শান্তি লাভ হয়। আগামিকাল, অমাবস্যা তিথিতে এই পুজো হবে৷ তা নিয়েই বিশদে জানালেন ড. জয়ন্ত কুশারী

Must read

আয় মন বেড়াতে যাবি।
কালীকল্পতরুমূলেরে মন, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি।।
সাধক রামপ্রসাদ এমনটাই বলছেন, স্বরচিত ও সুরারোপিত শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে। সাধকের কথায় মা তো ফলহারিণী (Phalaharini Kali Puja) হলেন না। উল্টে তিনিই ফল দিচ্ছেন! অর্থাৎ তিনি ফলদায়িনী। কেননা, গানের দ্বিতীয় চরণে তিনি বলছেন, ওরে মন, কালীকল্পতরুমূলে গেলে চারটি ফল কুড়িয়ে পাবি। এই চারটি ফল পরমা প্রকৃতি মায়ের দেওয়া। প্রকৃতির সেরা চারটি রসাল ফলের চেয়েও কোটিগুণের অধিক রসাল ও সুস্বাদু। কারণ, এই ফল চারটি কালীকল্পতরু-তে ফলেছে। এই চারটি অপার্থিব ফল হল— ১. ধর্ম। ২. অর্থ। ৩. কাম। ৪. মোক্ষ। যাকে শাস্ত্রে চতুর্বর্গ বলা হয়েছে। শাস্ত্রে এ-ও বলা হয়েছে, কল্পতরুর কাছে আমরা যা চাইব। আমরা সেটাই পাব। তাই তো ভেবেচিন্তে চাইতে হবে। নইলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। সেই যে পথিক। যে চারদিক ঘুরে এসে ঘেমেনেয়ে একশা হয়ে অজান্তেই বসেছিল কল্পতরুর মূলে। বুকফাটা তৃষ্ণায় অস্ফুটস্বরে চেয়ে বসল ঠান্ডা শরবত-জল। তৎক্ষণাৎ সে পেয়ে গেল। এরপর একে একে সব কিছুই সে পেল। চাওয়া মাত্রই। অবশেষে সে বলে বসল, এই চারদিক খোলা ফাঁকা জায়গায় যদি বাঘ এসে আমাকে খেয়ে নেয়! আর বলামাত্রই সত্যি-সত্যিই বাঘ এল আর তাকে খেয়ে নিল। আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি আমরা। দৈনন্দিন জীবনে। প্রত্যক্ষ করছি লোভের (পড়বেন প্রবৃত্তির) ছাগল কীভাবে আস্ত বাগানকে মুড়ে খেয়ে নিচ্ছে। নিবৃত্তির বেড়া ঠিকমতো দেওয়ার জন্য তাই রামপ্রসাদ বলছেন, প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি। অর্থাৎ প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি নামে তোমার দুটি বউ আছে। নিবৃত্তি নামের বউ-কে সঙ্গে নিয়ে এস, কালীকল্পতরুমূলে। তবেই ওই দুর্লভ চারটি ফল কুড়িয়ে পাবে।

এখন প্রশ্ন হল, মা যদি শুধুই দান করেন। তাহলে তিনি কি কিছুই নেন না? তবে যে মায়ের নাম ফলহারিণীকালী (Phalaharini Kali Puja)?
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, আদানং হি বিসর্গায় সতাং বারিমুচাদিব। অর্থাৎ সজ্জন, সহৃদয় সামাজিক ব্যক্তিরা সহস্রগুণে ফিরিয়ে দেন। এক ষষ্ঠাংশ নেওয়া (হরণ)-র পরিবর্তে। যেমন, সূর্য, নদী-সাগর-পুকুর— যাবতীয় জলাশয় আর জমি থেকে জলকণাকে বাষ্প আকারে নিয়ে মেঘ সৃষ্টির মাধ্যমে সহস্রগুণে সেই জল ফিরিয়ে দেন। আমরা তো দিতে জানি না। আমরা শুধু নিতে জানি। কোনও দিন উপুড়হস্ত করি না। তাই মা আমাদের সহবৎ শেখানোর জন্য আমাদের কর্মফল হরণ করেন সহস্রগুণে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক কিছু পেতে গেলে। অল্প কিছুও তোমায় দিতে হবে। এটা তোমার সংসারের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, বিশ্বের প্রতি আর আরাধ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। এর মধ্যে আনুগত্যও নিহিত আছে। অন্যদিকে একে Give & Take policy-ও বলা যেতে পারে। মায়ের দেহের ভাষাতেও এমন কথাই বলা হয়েছে। মা কালীর ডান দিকের দুটি হাত। একটি বর। অন্যটি অভয়। দুটি হাতেই তিনি কিছু ধারণ করেননি। নিচের হাতে তিনি হরণ করছেন। কিছু সময়ের জন্য। ওপর হাত দিয়ে মা আমার সদাসর্বদা দিয়ে চলেছেন। সন্তানদের চাহিদা অনুযায়ী। প্রয়োজন মতো। এ দেওয়ার কোনও বিরাম নেই। কে এই কালী? কেনই বা তাঁর পুজোর তিথি দীপান্বিতা অমাবস্যা? কিংবা মৌনী অমাবস্যা? অথবা ফলহারিণী (Phalaharini Kali Puja) অমাবস্যা? শাস্ত্রে এ-বিষয়ে কী বলা হয়েছে সে-বিষয়ে এখন শুনব আমরা।

সংসারে তিনটি ভাব। উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়। যিনি উৎপত্তির ব্যবস্থা করেন, তিনিই স্থিতির ব্যবস্থা করেন। আবার তিনিই লয়েরও ব্যবস্থা করেন। এই তিন রকমের ঘটনা একই সঙ্গে ঘটে চলেছে নানাভাবে। আসা। যাওয়া আর থাকা। সংসার মানেই হল এই তিনটি ঘটনা। এই যে তিন রকমের ঘটনা নিয়ত ঘটছে বিশ্ব জুড়ে, যাঁর দ্বারা ঘটছে তিনি হলেন কাল (পরমপুরুষ) এবং তিনিই কালী (পরমা প্রকৃতি)। এই দুই তত্ত্ব এক। যিনি কাল। তিনিই কালী। কালের যে প্রকাশ তাই কালীভাব। প্রকাশ যাঁকে নিয়ে তিনিই কাল। যেখানে প্রকাশ অর্থাৎ কালীভাব সেখানে কাল যেন অপ্রকাশ। যখন কাল স্বরূপে তখন প্রকাশরূপ কালীভাব থাকে কতকটা অপ্রকাশ। আসলে দু’জনেই প্রকাশ বা অপ্রকাশ। আমরা ব্যবহারে এইরকম বলি। বস্তুত মহাকালকে নিয়েই তাঁরই প্রকাশ কালীভাব। তাই মহাকালের শবরূপ। অর্থাৎ স্তব্ধরূপ এঁরা কল্পনা করেছেন। কালকে প্রকাশ করতে গেলে কালীরূপ পাওয়া যায়। ইনি মহামায়া, চৈতন্যস্বরূপিণী, অসুরদলনী, পাপধ্বংসকারিণী। সৃষ্টিতে মহাকালী। স্থিতিতে মহালক্ষ্মী। প্রলয়ে মহাসরস্বতী।

এই কালী শিবমহিষী। শিব ও শক্তিতে কোনও তফাত নেই। বিনা আধারে প্রকাশ হয় না। সেই আধার শবরূপী মহাদেব। প্রকাশে নানা বৈচিত্র এই বৈচিত্রের প্রকাশ মহাকালীস্বরূপ। যেমন বীজের মধ্যে উদ্ভিদের সত্তা ধরা থাকে। সেইরূপ বৈচিত্রের প্রকাশের মধ্যে ধরা থাকে মহাকালরূপ। যদি কেউ বৈচিত্র চায় তাহলে তাকে কালীর আরাধনা করতে হবে।
অনন্ত বৈচিত্রের মধ্যে জড়িয়ে থেকেও যেখানে সব সম্ভাবনা স্থির হয়ে আছে সেখানে পৌঁছতে চাইলে তো শিবভাবে সাধনা করতে হবে। প্রকাশেই আমাদের জন্ম। এই প্রকাশেই আমাদের পক্ষে সহজ হবে মাঘর সঙ্গ। বহুরূপে বৈচিত্রের বিলাস যেখানে সংহত অবস্থায় আছে যোগীরা সেখানে দৃষ্টি চালনা করেন।

পড়ুন: তথ্যচিত্রে পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, এমন তরণী বাওয়া

আকাশের মতো রং তাই শ্যামা। যাঁর ষোলো বছর পূর্ণ হয়েছে। ষোলোকলায় পরিপূর্ণ। পনেরো পর্যন্ত কলা ধ্বংসকলা। বাড়ে-কমে । ষোলো যে কলা সেটা বাড়েও না কমেও না। সেটা স্থিরকলা। নিত্যকলা সেটি। সেটি অমাকলা। যেমন শিবের ওপর শক্তির প্রকাশ। তেমনই অমাকলায় তাঁর স্থির ভাব। তখন শিব আর শক্তি এক হয়ে যায়। গভীর অমানিশায় যখন কালো একেবারে ঘনিয়ে আসে, মধ্যরাত্রে নিবিড়, নিথর ঘন সূচিভেদ্য কালো অন্ধকার, তখন কেবল নিত্যকলা আছে। সেই অবস্থায় শিব ও শক্তির সামঞ্জস্য হয়। যাঁরা শক্তিসাধক, তাঁরা এই মুহূর্তে এই অমাকলায় ধ্যান করে শিবশক্তির সামঞ্জস্যে স্থিত হয়ে যান। অমাকলাতে যখন শিব ও শক্তির সামঞ্জস, তখন সেই ভাবেতে লীন হয়ে যাওয়াই কালীপুজো সমস্ত বিলাস ও ঐশ্বর্যের মূর্তি হয়েও সমস্তটা শিবভাবে সংহত।
বিশ্ব সৃষ্টির আগে একমাত্র কালীই বর্তমান ছিলেন এবং এঁর দ্বারাই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসূত হয়েছে। এজন্য এঁকে ‘আদ্যা’ বলা হয়ে থাকে। যে মহাশক্তি মহাকালের সর্বসংহারক শক্তির নিয়ন্ত্রক তিনিই কালী। উপনিষদের ঋষি এই মহাশক্তির স্বরূপ বর্ণনায় মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন—
‘ভাষাহসমাদ্বাতঃ পবতে।
ভীষোদেতি সূর্য্যঃ।
ভাষাহস্মাদগ্নিশ্চেকন্দ্রশ্চ।
মৃত্যু ধাবতি পঞ্চমঃ।’
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২/৮)
অর্থাৎ ব্রহ্মের ভয়ে বাতাস বইছে। সূর্য উঠছে। তাঁর ভয়ে অগ্নি, ইন্দ্র ও পঞ্চম মৃত্যু (কাল) নিজ লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছে। এই মহাশক্তিকে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে— ‘মহদ্ভয়য়ং বজ্রমুদ্যতম্’ অর্থাৎ উদ্যত বজ্রের মতো অতি-ভীষণ বলে বর্ণনা করেছেন।

কালশক্তি মহাপ্রলয়ে সমুদয় ধ্বংস করে কালীতে লীন হয়ে যায়। ডখন তমোরূপিণী কালীই একমাত্র বর্তমান থাকেন। সৃষ্টির পূর্বে তমোরূপে একমাত্র তিনিই বর্তমান ছিলেন। মহাদেবীর সেইরূপ অরূপ অবাঙ্-মানসগোচর।
মৈত্রায়ণী শ্রুতিতেও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই তমোগুণই আদ্যাশক্তি কালিকা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অতি সরলভাবে দেবী কালিকার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন— ‘ব্রহ্মাণ্ড উদরা মা জগদ্ধাত্রী’। তিনিই ব্রহ্মময়ী সিদ্ধিদাত্রী, শক্তিস্বরূপিণী, নির্গুণ, নিরাকার হলেন ব্রহ্ম। তাঁর তরঙ্গ হলেন শক্তি। শক্তিতেই এই জগৎ সৃষ্টি হচ্ছে। স্থিতির সম্বল শক্তি। শক্তিই ধারণা। এই শক্তিতেই ব্রহ্মের লীনের প্রকাশ। শক্তির দর্পণে ব্রহ্ম প্রতিবিম্বিত। দর্পণস্বরূপা শক্তি সহায় না হলে ব্রহ্মতত্ত্ব, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে না। মহাকালী সেই শক্তিস্বরূপা।

তিনি নানাভাবে লীলা করেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী, সিদ্ধেশ্বরীকালী, রটন্তীকালী আবার ফলহারিণীকালী (Phalaharini Kali Puja)। মহাকালী এবং নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে রয়েছে। যখন সৃষ্টি হয়নি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও পৃথিবী ছিল অস্তিত্বহীন জগৎ ছিল সুনিবিড় আঁধারে মগ্ন। তখন কেবল ‘মা’ নিরাকার মহাকালী মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করেছিলেন। তন্ত্রের দৃষ্টিকোণে ‘কালী’ শব্দের আরও এক তাৎপর্য দেওয়া যেতে পারে। ‘কলন’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে ‘কালী’ শব্দ। যার অর্থ ক্ষেপ ও জ্ঞান। কলন সামর্থ্যের মধ্যে যে নামের সার্থকতা। পরাগতির দিক দিয়ে শিবের পাঞ্চকৃত্যকে কলনা বলে। সেই পাঞ্চকৃত্য হল—১. ক্ষেপ। ২. জ্ঞান। ৩. প্রসংখ্যান। ৪. গতি। ৫. নাদ। একে পঞ্চকলা বা কলনাও বলে।

এখন একনজরে দেখে নেওয়া যাক, সারা দেশ জুড়ে শক্তিবাদের বা শক্তি উপাসনার ধারাটি ঠিক কেমন? এক্ষেত্রে অন্যান্য উপাস্যদের অবস্থানই বা ঠিক কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, সারা দেশের প্রতিটি ঘরে আজও কোনও না কোনও দেবতার পুজো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্গা-কালী অথবা রাধাকৃষ্ণ কিংবা রাম-সীতার পুজোয় মগ্ন হন সকলে। শিব-দুর্গা পুজোর প্রচলনও উপাসনার ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো। প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে দেবদেবীর বা কুলদেবতার পূজার্চনা করার বিধিও শাস্ত্রসম্মত। কালীপুজো মুখ্যত বাঙালিরই পুজো। যদিও কালীপুজোর সময় ভারতের অনেক প্রদেশে দীপাবলি বা দেওয়ালি উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয়। রোজ সকালে বাড়ির বউয়েরা বা মায়েরা ঠাকুরঘরে বসে গুরু ইষ্টনাম স্মরণ করেন। কেউ বা নবগ্রহ স্তোত্রপাঠ করেন। আবার কেউ হনুমান চালিশা পাঠ করে নিজের মনকে পবিত্র করে চা পান করেন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি অঞ্চলে লোকে কালী বা শক্তিদেবীর পূজার্চনা করলেও বঙ্গদেশেই কালীর আরাধনা মহাসমারোহে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সেদিক থেকে বলা যায় শাক্তপ্রধান পশ্চিমবঙ্গে কালীর নিয়মিত উপাসকের সংখ্যা অসংখ্য।

দক্ষিণাকালী বিগ্রহই সমধিক প্রচলিত। দেশের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রসিদ্ধ কালীমন্দিরের অধিকাংশ দেবীপ্রতিমাই দক্ষিণাকালী প্রতিমা এবং ওইরূপ প্রতিমা সকলই শিলাময়ী। ‘তন্ত্রসার’ ও ‘শ্যামারহস্য’ গ্রন্থে দেবীপুজোর নানারকম মন্ত্র ও ধ্যান সংকলিত আছে। সমস্ত শক্তির আধার মাতৃশক্তি।
আবালবৃদ্ধবনিতা কালীকীর্তন বা শ্যামাসংগীত বা ভক্তিমূলক কালী-বিষয়ক গান শুনলে পরিতৃপ্তি লাভ করে। বাঙালির রক্তে ভাববিহ্বলতা প্রবল। কলিযুগে ভক্তিমার্গই মানুষের অধ্যাত্মসাধনার প্রকৃত পথ। ভক্তিপথেই সহজে ঈশ্বর লাভ হয়। বাঙালি তাই বিশ্বজনীনকে ভক্তি অর্থে অর্চনা করতে চান। শব্দই ব্রহ্ম। ব্রহ্মজ্ঞানই সচ্চিদানন্দের বহিঃপ্রকাশ।

বাঙালির ধর্মজীবন হতে দেখা যায়, প্রধান ভিত্তি মূর্তিরহস্য বা পুজো-পদ্ধতি। এখন আসা যাক ফলহারিণী কালীপুজোর সঙ্গে জড়িত আছে আরও একটি আলোকোজ্জ্বল দিকে। বাঙালিজীবনে ফলহারিণী কালীপুজোর (Phalaharini Kali Puja) তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে। ঠাকুর এই তিথির মহানিশায় সকলের অজান্তে পুজো করলেন শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীকে ষোড়শীরূপে। সালটা ছিল ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে, বাংলার ১২৮০ সনে। জগতের কল্যাণের জন্য। আর জাত চিনিয়েছিলেন শ্রীশ্রীমায়ের ভক্ত-সাধারণের কাছে। এ-কারণে আজও রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমে এই পুজো ষোড়শী পুজো নামে পরিচিত। এই পুজোতে ঠাকুর তাঁর সর্বস্ব দিয়েছিলেন মা সারদার শ্রীচরণকমলযুগলে। এমনকী তাঁর জপের মালাটিও নিবেদন করেছিলেন শ্রীশ্রীমাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এই পুজোয় নানাপ্রকার মরশুমি ফল, যেমন আম, জাম, তরমুজ, কলা, কাঁঠাল, ডাব, জামরুল, লিচু ইত্যাদি ফল আর নানারকম মিষ্টি মাকে নিবেদন করেন। একদিকে ফলহারিণী মাকালী ভক্তদের কর্মফল হরণ করেন। অন্যদিকে ওই মা-ই পূরণ করেন তাদের অভীষ্ট। আর তাঁদের জীবনের সমস্ত বিপদ-আপদ, দুঃখ-দৈন্য, রোগ-ব্যাধি এবং সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করেন তিনি। ঐশ্বর্য-আরোগ্য, বল-পুষ্টি, কীর্তি-যশ, বংশগৌরব অর্থাৎ যা কিছু শুভ সবই তিনি প্রদান করেন। এককথায় পার্থিব ও অপার্থিব উভয় সম্পদই লাভ করা যায়, ঠাকুরের ভাষায়, যদি শুদ্ধা ভক্তি দিয়ে মা-কে আত্মনিবেদন করা যায়। আর তিথির মাহাত্ম্য হল ভক্তের মনে অধ্যাত্ম চেতনার দ্রুত বিকাশ ঘটে। সেই কারণেই ঠাকুর বেছে নিয়েছিলেন এই তিথিটিকে মাতৃ আরাধনার জন্য।
লেখক : সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা আকাদেমির অধ্যক্ষ

Latest article