প্রতিবেদন : বিজেপির (BJP) জন্য বিশ্ব দরবারে মুখ পুড়ল ভারতের (India)। দীর্ঘদিন ধরে অসহিষ্ণুতা আর বিভাজনের নীতিকে জল-হাওয়া দিয়ে বাড়িয়ে এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবমূর্তি মোদি জমানায় এতটাই বিপন্ন যে এখন একাধিক দেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের আওয়াজ পর্যন্ত উঠছে। কূটনৈতিক স্তরেও চরম অসন্তোষের বার্তা। খোদ সরকারের শীর্ষ কর্তাদের প্রশ্রয়ে গেরুয়া বাহিনীর মাতব্বররা এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছেন যাতে বহির্বিশ্বে ভূলুণ্ঠিত ভারতের মর্যাদা।
ঘরে-বাইরে মুখ পুড়িয়ে, বাধ্য হয়ে নিজেদের দুই নেতা-নেত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারের ঘোষণা করেছে বিজেপি (BJP- India)। এদের একজন জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা। অন্যজন দিল্লি মিডিয়া শাখার প্রধান নবীন কুমার জিন্দল। সপ্তাহখানেক আগে নূপুর টেলিভিশনে বসে পয়গম্বর সম্পর্কে কদর্য মন্তব্য করেন। দিন কয়েক পরে নূপুরের সুরেই নবীন ট্যুইট করেন। তখন থেকেই কোনও প্রতিবাদ বা উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি মোদি-শাহ-নাড্ডাদের। তারপর ঘটনার অভিঘাতে যখন উত্তরপ্রদেশে সংঘর্ষের পরিস্থিতি এবং বিদেশে কূটনৈতিক স্তরে ঝড় শুরু, তখন নাম কা ওয়াস্তে দুজনকে শাস্তির ঘোষণা ভারতীয় জনতা পার্টির। নূপুর সাসপেন্ড, নবীন বহিষ্কৃত। সেইসঙ্গে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে এঁদের মন্তব্যকে সমর্থন না করার বিবৃতিও প্রকাশ্যে এসেছে।
আরও পড়ুন: ভারতে জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যার জনক বীরেশচন্দ্র গুহ
প্রশ্ন, কী এমন হল যে পয়গম্বর সম্পর্কে কটু মন্তব্য করায় বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল দু’জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিল, বলা ভাল নিতে বাধ্য হল? আসলে বেলাগাম মন্তব্যে অভ্যস্ত বিজেপি নেতারা তাল-জ্ঞান দুটোই হারিয়েছেন। তাই দুই নেতার দুটি মন্তব্যের পরেও দলের অন্য কোনও নেতা, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেউই টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। নিন্দা তো দূরের কথা। আর তারপরই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির। এদেশে তো বটেই, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতেও শুরু হয় ভারতের (BJP- India) বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়। শুধুমাত্র নিন্দাসূচক বিবৃতি হলে না হয় বোঝা যেত। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পণ্য বয়কট, কূটনীতিকদের ডেকে পাঠানো, ক্ষোভ প্রকাশ, প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ছবিতে কালি মাখানো সহ নানা ঘটনা। দিল্লি এই অনৈতিক কাজকে নীরবে সমর্থন করে ভেবেছিল কিছুই হবে না। কারণ, দলের রাজনৈতিক স্বার্থ তো আগে দেখতে হবে! ২০২৪ এগিয়ে আসছে। লোকসভা ভোটের আগে তীব্র মেরুকরণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সে পথে যেতে গিয়ে শুধু মোদি সরকারের মুখই পোড়েনি, পশ্চিম এশিয়ায় মাত্র কয়েক দিনেই প্রবলভাবে কোণঠাসা হয়েছে ভারত।
কীভাবে মুখ পুড়ছে?
ইরান, কাতার, কুয়েত সে দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে। সবচেয়ে ক্ষুব্ধ কাতার। তারা বলেছে এর জন্য ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এই মুহূর্তে উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু কাতার সফরে। তার মাঝে মোদি সরকারের এই কাজে বেজায় অস্বস্তিতে ভারত। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তালকে ডেকে কাতার একটা নোট ধরিয়েছে। পরিষ্কার বলেছে, এই ধরনের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য শুধু উত্তেজনা ছড়াবে তাই নয়, সার্বিকভাবে মানবাধিকারের পক্ষেও বিপজ্জনক। এইসব মন্তব্য ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞানতার ফসল। এর পাশাপাশি আরবের দেশগুলিতে প্রতিবাদের ঝড়। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইরান, ওমান, বাহরিনের বিভিন্ন সুপার মার্কেট থেকে সব ভারতীয় জিনিস সরিয়ে ফেলে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কুয়েতের জঞ্জাল ফেলার ভ্যাটে পাওয়া গিয়েছে কালিমাখা মোদির ছবি। পরিস্থিতি সামাল দিতে দীপক মিত্তাল বিবৃতি দিয়ে জানান, এসব ফ্রিঞ্জ এলিমেন্টের কাজ, শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এদের মন্তব্যের কোনও গুরুত্ব নেই। অথচ ঘটনা হল, এর মধ্যে একজন দিল্লি মিডিয়া সেলের মাথা, অন্যজন জাতীয় মুখপাত্র এবং দিল্লির ভোটে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে প্রার্থী!
শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, রাজস্থান, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল। সম্প্রতি মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও ভারতের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ভয় দেখানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিদেশে থাকা ভারতীয়রাও আতঙ্কে। ফলে সমস্যা ক্রমশ বেড়েছে। দেশ-বিদেশের রাজনীতিকরা লক্ষ্য করেছেন, মোদি সরকার বিগত কয়েক মাস ধরে কাশী, মথুরা, আগ্রা সহ নানা জায়গায় পরিকল্পিতভাবে মন্দির-মসজিদ বিবাদ প্রকাশ্যে আনছে। অতীতের ইস্যু অপ্রয়োজনীয়ভাবে তুলে খুঁচিয়ে ঘা করা হচ্ছে। এভাবেই জ্ঞানবাপী মসজিদে শিবলিঙ্গ বিতর্ক, তাজমহলে তেজোলয় নাম দিয়ে হইচই এবং সর্বশেষ বিজেপি নেতানেত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন কটু মন্তব্য।
অতীতে প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, গান্ধী হত্যাকারী গডসের প্রশংসা করা সাধ্বী প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, বিজেপি থেকে তাড়ানো হবে। সে তো হয়ইনি, সাধ্বী এখনও গরম গরম কথা বলে চলেছেন। নূপুর বা নবীনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। মাস ছয়েক পড়ে তাঁরা ফের সগর্বে দলে ফিরবেন এবং ফের কটু কথা বলবেন। এটাই বিজেপির চাল। আর তাই নূপুর-নবীন কাণ্ডে বিজেপির ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপি নত হওয়া শিখেছে ভাবলে ভুল হবে। আসলে এখন ঠেলায় পড়ে বাবাজি বলছে। এক মন্তব্যেই ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক, পশ্চিম এশিয়ায় ব্যবসা, বিশাল সংখ্যক ভারতীয়র চাকরি, সমস্ত কিছু অনিশ্চয়তার মুখে। তাই নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। কিন্তু এতে চিঁড়ে ভিজবে ভাবলে ভুল হবে। কারণ পশ্চিম এশিয়া সহ অন্যান্য দেশ বেশ বুঝতে পারছে, ন’শো ইঁদুর মেরে বেড়াল এখন হজে চলেছে!