নবনীতা দেবসেন লিখেছিলেন, ‘গৌরকিশোর (ঘোষ) এমন একজন মানুষ, যিনি বিশ্বাসে, চিন্তায় এবং জীবনযাপনে কখনও ভাবের ঘরে চুরি করেননি।’ যা ভেবেছেন, তাই বলেছেন, তাই লিখেছেন এবং তাই করেছেন। যাঁর পরিপূর্ণ ভারতীয়ত্বে সাম্প্রদায়িকতার কোনও আবছা এবং হালকা ছায়াও পড়েনি কোনওদিন। সম্ভবত তিনিই আমাদের সময়ের প্রথম হিন্দু লেখক, যিনি মুসলমান সমাজের বিষয়ে বারংবার সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, যথাসাধ্য ‘ভিতর থেকে তাদের কথা বুঝতে, বোঝাতে এবং লিখতে চেষ্টা করেছেন।’
আজ গৌরকিশোর ঘোষের (Gour Kishore Ghosh) জন্মশতবার্ষিকীর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এই মানুষটিকে স্মরণ করা আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলির কর্তব্য গৌরকিশোর ঘোষের দিয়ে যাওয়া জীবনদর্শনকে পাথেয় করে এই ত্র্যস্ত সমাজজীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই শতবর্ষের সুযোগে আমরা যখন কোনও বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে চর্চা করি, তখন আসলে আমরা একটা পুরনো তোরঙ্গ যেন ঘাঁটি, সেই সব পুরনো রেখে যাওয়া জামাকাপড়ের মধ্যে যে অনেক সুগন্ধী স্মৃতি থাকে। আসলে গৌরদার অভাব এখনও যেন প্রতি পদে অনুভব করি আমরা। শুধুমাত্র সংবাদপত্রের পাতায় নয়, প্রাত্যহিক জীবনেও, প্রতিনিয়ত।
আমি তখন দিল্লিতে কর্মরত সাংবাদিক। গৌরদা (Gour Kishore Ghosh) এলেন। আনন্দবাজারের দিল্লির অফিসে এসেও আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন। সেবার কেন্দ্রীয় সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে, এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন ইস্যুতে তৎকালীন সিপিএম শাসনের দ্বারা লঙ্ঘিত মানবাধিকারের প্রতিবাদে মিছিল হয়েছিল। মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন আয়োজিত সে এক বিশাল মিছিল। বেশ মনে আছে, তখনও আনন্দবাজার পত্রিকার প্রয়াত সাংবাদিক খগেন দে সরকার জীবিত। গৌরদা ও খগেনদার সঙ্গে রাজধানীর ভোট ক্লাব থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত আমরা হেঁটে গেছিলাম। ওঁর পায়ে ছিল ক্যাম্বিসের জুতো আর সেই চিরপরিচিত অবয়ব। একটা চিত্তাকর্ষক চরিত্র, এই চরিত্রটিকে ব্যক্তিগত জীবনে আমার থেকে হয়তো অনেকেই বেশি দেখেছেন, আমি নানান গল্প শুনেছি তাঁর, কিন্তু সবচেয়ে বেশি পেয়েছি তাঁকে তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে। এখনও যখন রূপদর্শীর রচনা পড়ি, তখন মনে হয় তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গি, তাঁর স্টাইল— এটা কারওর পক্ষেই নকল করা সম্ভব না। গৌরকিশোর ঘোষের রচনা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে, এটা বড়ই আনন্দ সংবাদ।
গৌরদার সঙ্গে সেভাবে হয়তো আমার চেনাশোনা হওয়ার সুযোগ হয়নি, অল্প অল্প জেনেছি, কিন্তু যখন রূপদর্শীর নকশায় ‘ঈদ মোবারক’ পড়ি, আবার ‘রাসের নবদ্বীপের কাহিনী’ পড়ি রূপদর্শীর সার্কাসে, তখন মনে হয় এইরকম একজন মানবদর্শীর আজ বড় বেশি দরকার। গৌরদা নিজেই লিখে গেছেন— ‘দিনরাত্রি সতর্ক চোখে ঘুরেছি, যা দেখেছি, যেটা ভালো লেগেছে, সেটা তুলে ধরেছি।’ জীবনের রূপ দেখতে দেখতে তাই তিনি নিজেই রূপদর্শী। কখনও নকশা, কখনও বা সংবাদভাষ্য, কখনও আবার ঝাঁকি দর্শন, আবার কখনও কখনও সোচ্চার চিন্তায় ত্রিকাল দর্শন, জীবনের নানা রঙের ছবি তাঁর কলমে।
আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপেক্ষা করেই ত্রিপুরায় অভিষেক, আজ সুরমায় সভা
আমি যখন চুরাশি সালে ‘বর্তমান’ সংবাদপত্রে প্রবেশ করেছি সাংবাদিকতার মন্ত্র নিয়ে, তখন গৌরদা ব্যস্ত ‘আজকাল’ নামের সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করতে। ‘আজকালে’র ব্র্যান্ড ইকুইটি, ‘আজকালে’র আত্মপরিচয় নির্মাণে গৌরকিশোর ঘোষের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। গৌরদা এমন একটা সংবাদপত্র করতে চেয়েছিলেন, যেটি প্রাত্যহিকতার তুচ্ছতায় আক্রান্ত নয়। আজ সার্কুলেশন, টিআরপি, ডিজিটাল হিট, সেনসেশনের এক ভয়ঙ্কর ফাঁদে বন্দি সংবাদপত্র। কতবছর আগে তিনি সংবাদমাধ্যমকে সেই বাজারের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে, চেয়েছিলেন একটা নতুন বাজার তৈরি করতে। এখনও মনে আছে ‘আজকাল’ পত্রিকায় যখন সবাই অন্য কোনও খবরে ব্যস্ত, তখন তিনি উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে রিপোর্টারদের পাঠিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সিরিজ করাচ্ছেন। অথবা ‘আজকাল’ পত্রিকায় এক আধুনিক প্রজন্মের চলচ্চিত্র চিন্তা, সাহিত্য চিন্তা প্রকাশ করছেন। ‘আজকাল’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বর্তমান’ পত্রিকা প্রকাশের আগেই এবং তখন আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। এখনও মনে আছে, ‘আজকাল’ কাগজটি কিনে সেই সময় সহজ ভাষায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে ফিল্ম রিভিউ পর্যন্ত গোগ্রাসে লিখতাম। ঝরঝরে ভাষা, ঝকঝকে ছাপা, অথচ সেই সময় গৌরকিশোর ঘোষের নেতৃত্বে আজকালের যে এডিটরিয়াল প্যাকেজ, তা কিন্তু বাজার ধরতে খুব একটা পারেনি। চুরাশি সালে এসে ‘বর্তমান’ কিন্তু ক্রমে সেই বাজারের মার্কেট লিডার হয়ে উঠল। সে এক অন্য কাহিনি। কিন্তু গৌরকিশোর ঘোষ কখনও তাঁর নিজের মতাদর্শ থেকে সরে আসেননি। কখনও আপস করেননি।
আজ পশ্চিমবঙ্গে গৌরকিশোর ঘোষের মতো একজন অভিভাবককে আমাদের দরকার। রূপদর্শী ছাড়া আজ আর কারও পক্ষে সরলভাবে ধর্মপ্রাণ, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করা কি সম্ভব? আসলে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে গেলেও একটা বুদ্ধি এবং একটা রুচির প্রয়োজন হয়। এখন আমরা সস্তার প্রগলভতার শিকার। ব্রজদার গল্পসমগ্র থেকে হরিদাস পাল নামক একটি চরিত্র নির্মাণ তারই প্রমাণ। আর তাই গৌরদার জীবনকে স্মরণ করা আজ বিশেষভাবে প্রয়োজন।
গৌরকিশোর ঘোষের জীবনটা যেন রোমহর্ষক, দুঃসাহসিক এবং অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। কী না করেছেন তিনি? ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি তো সমানে পেশা বদলেছেন। আর সব শেষে ১৯৭৫ সালে ‘মিসা’ অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাংবাদিকদের অধিকার এবং স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের জন্য তিনি সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসের সেই রচয়িতাকে আজ ২০২২-এ দাঁড়িয়ে শতকোটি প্রণাম।