রূপা মজুমদার: বর্ষার রাত। মথুরা নগরীর সমস্ত মানুষ নিদ্রায় অচেতন। শুধু কংসের কারাগারে জেগে আছেন দুজন। প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন দেবকী। যন্ত্রণার আর্তনাদ যাতে কারাগারের দেওয়াল ভেদ করে বাইরের প্রহরীদের কানে না পৌঁছয় সেজন্য নিজের শাড়ির আঁচল গুঁজে রেখেছেন মুখে। পেশির সংকোচন-প্রসারণে একসময় গর্ভের বাইরে বেরিয়ে এল শিশু। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান। দৈবজ্ঞরা বলেছেন এই শিশুই তার মাতুলকে হত্যা করে হয়ে উঠবে মথুরার অধীশ্বর। কংস তাই জন্মমাত্রই একে মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে পরপর দেবকীর সাতটি সন্তানকে হত্যা করেছেন কংস। এই শিশু বড় হয়ে কী হবে সে তো জানা নেই। কিন্তু একটি পুত্রসন্তানের অন্তত প্রাণ রক্ষা করতে মরিয়া বাসুদেব আর দেবকী দুজনেই। নবজাতককে তাই সাবধানে কাপড় দিয়ে মুড়ে বুকে তুলে নিলেন বাসুদেব। প্রসবক্লান্ত দেবকী শুয়ে আছেন মাটিতে। একবার তার মুখের কাছে ধরলেন ছেলেকে। নিঃশব্দে ছেলের কপালে স্নেহ চুম্বন এঁকে দিলেন দেবকী। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তাঁর। ছেলেকে আবার কবে দেখতে পাবেন কিছুই জানেন না। কাপড়ের পুঁটলিতে জড়ানো ছেলে বুকের কাছে ধরে দৃঢ়পায়ে এগোলেন বাসুদেব।
কে তাঁকে কারাগারের দরজা খুলে দিয়েছিল আমরা জানি না। নিশ্চিত কংসের শিবিরের ভিতরেও ছিল বিশ্বাসঘাতক যারা চাইছিল বেঁচে থাকুক এই শিশু। ছেলেকে নিয়ে বৃষ্টির রাতে ভরা যমুনা সাঁতরে পেরিয়ে বাসুদেব এলেন নদীর ওপারে গোপ পল্লীতে। নন্দ গোপের বাড়ি। সেখানেও নাকি খোলা ছিল দরজা। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন আরেক সদ্য প্রসূতি, মা যশোদা। কোলের কাছে ঘুমোচ্ছিল শিশু সন্তান। নিজের ছেলেটিকে যশোদার বুকের কাছে শুইয়ে দিয়ে সেই শিশুটিকে তুলে নিলেন বাসুদেব। তারপর আবার সবার অগোচরে দ্রুত নদী পেরিয়ে ফিরে এলেন কংসের কারাগারে। নিরাপদ হল সেই ক্ষুদ্র প্রাণ, ভবিষ্যতে যিনি হবেন মথুরার রাজা শ্রীকৃষ্ণ। শত্রু নিধন করবেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলে একসময় নিয়্ন্ত্রণ করবেন সারা ভারতের রাজনীতি।
বর্ষার রাতে সেই পরম শক্তিশালী মানুষটি যে জন্মগ্রহণ করলেন সেই জন্মাষ্টমীকে পূণ্য তিথি হিসাবে স্মরণ করি আমরা। দেশজুড়ে পালিত হয় কৃষ্ণের জন্মোত্সব। মন্দিরে সেজে ওঠে নন্দলালার মূর্তি। কিন্তু তার পিছনে খুব নিঃশব্দে ঢাকা পড়ে যায় আরেকজনের কথা। আরও একটি শিশু যারও জন্ম এই একই দিনে। যশোদার যে সন্তানকে তুলে নিয়ে চলে গেছিলেন বাসুদেব সেই যোগমায়ার কী হল ?
মানুষের মুখে মুখে যে গল্প প্রচলিত তা হল পরদিন সকালে শিশুটিকে দেখেই কংস তাকে হত্যা করবেন স্থির করেছিলেন। দেবকী নাকী তাঁকে অনুনয় করে বলেছিলেন, বলেন, কন্যাসন্তানের তো সাধ্য হবে না কংসের মত বীর রাজাকে হত্যা করা, তাই শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখা হোক। কিন্তু কংস কোনওধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি সেই সদ্যোজাত মেয়েটির দুই পা ধরে তাকে পাথরে আছাড় মারেন। কৃষ্ণের জন্মসংক্রান্ত আরও অনেক অলৌকিক গল্পের মত এরপরেও বলা হয় মেয়েটিকে নাকি কংস মারতে পারেননি। সে শঙ্খচিল হয়ে উড়ে চলে গেছিল। তবে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবলে বুঝতে অসুবিধা হয় না সেদিন সেই শিশুকন্যাটিকে কংস হত্যাই করেছিলেন। আর এটাও অস্বীকার করা যায় না, মুখে যাই-ই বলুন না কেন এই হত্যায় ভিতরে ভিতরে আশ্বস্ত হয়েছিলেন বাসুদেব আর দেবকী। কারণ দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান হিসেবে চিহ্নিত এই মেয়েটি যদি মরে যায় তাহলে নিশ্চিন্ত হবেন কংস। তাঁদের সন্তানের প্রাণের আশঙ্কা কমে যাবে।
কিন্তু দেবকী আর বাসুদেব নাহয় নিজের সন্তানের স্বার্থে অন্যের সন্তানকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। কিন্তু যশোদা আর নন্দ গোপ কেন মেনে নিলেন শিশু বদল ? যশোদার সন্তান হয়েছিল অপরাহ্নে। তিনি তো জানতেন তাঁর কন্যাসন্তান হয়েছে। নন্দগোপও জানতেন তাঁর স্ত্রী একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছে। তাহলে পরদিন সকালে যখন দেখা গেল কোলের কাছে শুয়ে থাকা শিশুটি ছেলে তখন তাঁদের সন্দেহ হয়নি ? হৈচৈ করেননি তাঁরা ? কেন হাহাকার করে খোঁজেননি নিজের গর্ভজাত, ঔরসজাতকে ? তার বদলে যশোদা পরম আদরে কোলে টেনে নিলেন শিশু কৃষ্ণকে। স্তন্যদুগ্ধে পুষ্ট করলেন তাকে। চোখে হারাতেন তিনি তাঁর কানাইকে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে সেই মহাভারতের যুগেও সমাজে পুত্রসন্তানের কদর কন্যার থেকে এতটাই বেশি ছিল যে নিজের সন্তান নয় জেনেও শুধুমাত্র পুত্র পেয়েছেন বলেই আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলেন গোপ দম্পতি ?
আরও পড়ুন- জনজোয়ারে ভীত বিজেপির হামলা ত্রিপুরায়, রক্তাক্ত কর্মীরা
নাকী এর পিছনে ছিল কোনও রাজনীতি। কংসবিরোধী যে দল গোপনে খুলে দিয়েছিল কারাগারের দরজা, তাদের ষড়যন্ত্রেই সামিল ছিলেন গোপেদের প্রধান নন্দগোপ। নিজের কন্যাকে বলি দিয়েছিলেন ভবিষ্যত রাজাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে ? কিন্তু সন্তান হারানোর বেদনার কোনও গোপন বহিঃপ্রকাশের খবরও তো এই যুগ-যুগান্ত ধরে মুখে মুখে বয়ে আসা গল্পে আমরা পাই না। কৃষ্ণের ক্ষমতা, প্রভাবে অদৃশ্য হয়ে যায় যোগমায়া। তাকে মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। কে জানে হয়তো যে গল্প আমাদের জানা নেই, সেই কৃষ্ণ চিরকালের মত বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা চলে যাওয়ার পর হয়তো কোনওদিন একলা দাওয়ায় বসে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্য নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতেন যশোদা। হয়তো তাঁর মনে হত, কৃষ্ণ তো তাঁর নিজের সন্তান নয়। তাই অনায়াসে তাকে ভুলে চলে গেছে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার কাছে। আজ যদি যোগমায়া বেঁচে থাকত, সে তো নিশ্চয় মা-বাবাকে ছেড়ে যেত না। তাঁদের প্রাঙ্গন নতুন করে ভরে উঠতে পারত শিশুর কোলাহলে। রাত বাড়লে বুড়ো বাবা-মায়ের পায়ে তেল-মালিশ করে, তাদের শুইয়ে দিয়ে তবে হয়তো খেতে বসত সেই মেয়ে।
আরও পড়ুন- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করতে মুখ্যমন্ত্রীরা বৈঠকে বসুন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এতক্ষণ বললাম মুখে মুখে চলে আসা গল্পের কথা। আমাদের ভাগবতপুরাণ আর চণ্ডীতে কিন্তু যোগমায়ার উল্লেখ আছে। সেখানে যোগমায়াকে দুর্গা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে বিষ্ণুর ইচ্ছা অনুসারেই যোগমায়া যশোদার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। কংস যখন তাঁর পা ধরে আছাড় মারতে যাচ্ছেন তখন নাকি যোগমায়া তাকে নিজের অষ্টভুজা রূপ দেখান। তারপর তিনি চলে যান বিন্ধ্যপর্বতে। চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়েও আমারা পাচ্ছি,
নন্দগোপগৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা
ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলবাসিনী
অর্থাত্ যশোদাগর্ভজাত যোগমায়া পরে বিন্ধ্যাচলে আসেন এবং সেখানেই শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই অসুরকে বধ করেন।
আরও পড়ুন- টিকার শংসাপত্রে জাতীয় পতাকার ছবি দেওয়া হোক’, মোদী সরকারকে তোপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কিন্তু দেবী দুর্গার সঙ্গে তো বাঙালির নাড়ির টান। দুর্গার মত এমন একজন শক্তিরূপীণী, যোদ্ধাকেও আমরা রীতিমত ঘরের মেয়ে বানিয়ে ফেলেছি। তাই বোধহয় যোগমায়াকেও অন্যদের মত আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন মধ্যরাতে। জন্মাষ্টমীর উত্সব হয় যেদিন রাতে কৃষ্ণ জন্মালেন সেই দিন। অর্থাত্ যেদিন অপরাহ্নে যোগমায়া জন্মগ্রহণ করে গেছেন সেই দিনটিতে। আমাদের জন্মাষ্টমী তাই এক অর্থে যোগমায়ারও জন্মতিথি উদযাপন। সেজন্য সেই দিনটিতেই শুভ সূচনা হয় দুর্গাপুজোর। বহু বনেদী বাড়িতে এদিনে আয়োজন থাকে কাঠামো পুজোর। একসময় বেলুড়মঠে জন্মাষ্টমী থেকেই শুরু হত আগমনী গান গাওয়া। এখন অবশ্য সে প্রথা আর নেই। তবে খুঁটিপুজো হোক কিংবা কাঠামো পুজো, দুর্গার জন্মদিনে দুর্গাপুজোর সূচনার চল তো অবশ্যই আছে।