চুপি চুপি অনেক দানধ্যান করতেন মহানায়ক উত্তমকুমার। তাঁর ডানহাত জানতে পারত না তাঁর বাঁ হাতের কথা। মানবদরদি এই মানুষটির সেলুলয়েডের হিরো, বাঙালির নায়ক নন মহানায়ক, দক্ষ অভিনেতা, রোম্যান্টিকতায় যিনি সেরার সেরা অথচ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়ার অন্ত ছিল না। নাম যশের,পাশাপাশি কুৎসা, অপবাদ, বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁরও ভয় ছিল, ব্যথা ছিল, ভালবাসা ছিল, আদ্যোপান্ত মন দিয়ে গড়া একটি মানুষ যিনি মানসিক আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন বারবার। কেরিয়ারের শেষের পর্যায় এসে হয়ত টিকে থাকার আকুতি ছিল তাঁর মধ্যেও। হয়ত নিজের ভুলত্রুটি নিয়ে আত্মখনন করেছেন, পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেবও কষেছেন। তা সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্যপ্রকৃতির। তাঁর জীবনের অজানা বর্ণময় নানা দিক নিয়ে ছবি ‘অচেনা উত্তম’ (Achena Uttam)।
আমাদের প্রাণের নায়ক তিনি। যুগের ঊর্ধ্বে ওঠা এমন কিংবদন্তিকে নিয়ে বায়োপিক তৈরি করা সহজ কাজ একেবারেই নয়। এই কাজে থেকে যায় অনেক দায়বদ্ধতা, আর থেকে যায় বড়রকম ঝুঁকি। কারণ যেখানে ছবির বিষয় উত্তমকুমার সেখানে ভাবপ্রবণ বাঙালির ভাবনাকে আঘাত করলে রক্ষে নেই। যাই হোক সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বড় পর্দায় সেই অসাধ্যসাধন করতে চলেছেন পরিচালক অতনু বসু (Atanu Bose)।
কয়েকদিন আগেই ট্রেলার লঞ্চ হল উত্তমকুমারের বায়োপিক ‘অচেনা উত্তম’-এর (Achena Uttam)। আগামী ২২ তারিখ মুক্তির দিন ধার্য। উত্তমকুমারকে নিয়ে বায়োপিক করার আগের প্রস্তুতি কেমন ছিল এবং হঠাৎ এমন একটা বিষয় নির্বাচনেরই বা কারণ কী— এই প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক চলে গেলেন সুদূর অতীতে সেই অতিমারির আগে। বললেন, ২০১৯-এ এই ছবি নিয়ে চিন্তাভাবনা। তবে আমার মাথাতে আসেনি প্রথমে। ‘ব্ল্যাক কফি’, ‘আত্মজা’ করার পর ‘বিপ্লব আজকাল’ ছবিটা করেছিলাম। কোভিডের জন্য ছবিটা এখনও রিলিজ হতে পারেনি এরপরেই আমি মুম্বই চলে যাই। ওখানে একটা কাজ চলছিল তখন, তার মাঝেই হঠাৎ একদিন একটি প্রোডাকশন হাউজ থেকে ফোন আছে। ‘অলকনন্দা আর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’— যারা এই ছবির প্রযোজনায় রয়েছে তারাই ডেকেছিল। তাদের অফিসে গিয়ে জানতে পারি মাত্র চারদিন আগে এই প্রডাকশন হাউস লঞ্চ করেছে। ওরা এর আগে অন্য ধরনের কাজ করত। বড়পর্দায় এই প্রথম হাতেখড়ি। সেখানে প্রযোজক প্রমোদ অনন্ত আমাকে উত্তমকুমারের বায়োপিকের অফার দেন। আমি শুনেই চমকে গেছিলাম। এমন একটা সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে ছবি যা করার সাহস এতদিন পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। সেই অফার আমার কাছে! এটা আমার একটা মিরাকল মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল মহানায়কের ইচ্ছে ছাড়া এটা হতে পারে না। আমি তখনই ভেবে নিয়েছিলাম যদি উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি করতেই হয় তবে তাঁর জীবনের জানা, চেনা, দেখা বিষয়গুলো নিয়ে নয়, তার বাইরে গিয়ে আমি মানুষ উত্তমকুমারের গল্প বলব। তাঁর জীবনের অজানা দিকগুলো তুলে ধরব। এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এক রক্তমাংসের মানুষ, তাঁর মনপ্রাণ, ভালবাসা, আবেগ, তাঁকে বোঝা না-বোঝা সবমিলিয়ে আমি তাই মানুষ উত্তমকুমারকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমার ছবির মাধ্যমে। তাই ছবির নাম ‘অচেনা উত্তম’ (Achena Uttam)। তাঁর জীবনের শেষ দুটো দিনের ঘটনা এই ছবির আর এক আকর্ষণ। কী ঘটেছিল? যা অনেকেরই অজানা। জানতে হলে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।
প্রচুর রিসার্চ ওয়র্কের ফসল এই ছবি। যার গুরুদায়িত্বে ছিলেন শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রনাট্যও তাঁরই করা। পরিচালকের কিছু পার্সোনাল টাচ অবশ্যই রয়েছে ছবির চিত্রনাট্যের বুনটে। চরিত্র চিত্রায়ণে পরিচালক রেখেছেন একঝাঁক তারকা এবং নতুন মুখ। এই প্রসঙ্গে পরিচালক বললেন— ‘একটা বড় এক্সপেরিমেন্ট তো বটেই কারণ এই ছবির কাস্টিংটাই আসল। কাস্টিংয়ের সময় দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রাখতেই হবে, সেই সঙ্গে একটা মিল তো দরকার চেহারা এবং অভিব্যক্তির।
মহানায়কের চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে কেন নির্বাচন প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক বললেন— অপুদা (অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, আমার দেখা সেরা একজন শিল্পী। ওই জায়গায় আমি অপুদাকে ছাড়া ভাবতেই পারিনি। আমি মনে করি ভাল শিল্পী হতে গেল একজন ভাল মানুষ হতে হয়। অপুদা ঠিক তেমনই মানুষ। এর আগে ‘ব্ল্যাক কফি’তে ওঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যা খুবই ভাল ছিল। অপুদাকে বলার পরেই বলেছিলেন, ‘খেপেছ নাকি? ফোন রাখো।’ তারপর দিল্লি ফেস্টিভ্যালে গিয়ে যখন দেখা হল আমি তাঁকে বোঝালাম যে কীভাবে আমি ভাবছি ছবিটা। এটা মনে হয় আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় রিস্ক ছিল। কিন্তু আমাকে ভরসা করেই অপুদা রাজি হয়ে যায়। শুরু থেকেই ভেবেছিলাম আমি কোনও আর্টিস্টকে রিপিট করব না। সেইমতোই কাস্টিং করেছি।’
ছবিটা করতে গিয়ে মানুষের ভাবাবেগকে সযত্নে লালন করেছেন পরিচালক। উত্তমকুমারের জীবনের অজানা তথ্য খুব সুন্দর করে সংযতভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি কিছু জানা ঘটনাও ছুঁয়ে গেছেন পরিচালক। এমন কিছু এক্সক্লুসিভ শট দেখতে পাওয়া যাবে এই ছবিতে যা হয়তো আগে কেউ দেখেনি বা আগামীতেও কেউ দেখবে না বলে দাবি পরিচালকের। ছবিতে উত্তমকুমারের অল্পবয়সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগত তীর্থরাজ বসু। অভিনয় নিয়ে পড়াশুনো করছেন তিনি। স্ত্রী গৌরী দেবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, ইয়ং গৌরীদেবী স্নেহা দাস। সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় দেখা যাবে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দিতিপ্রিয়া রায়, সুপ্রিয়া দেবীর চরিত্রে সায়ন্তনী রায়চৌধুরি, সুমিত্রা মুখার্জির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সম্পূর্ণা লাহিড়ী। শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করছেন নতুন মুখ রাতাশ্রী। যাকে দেখলে হঠাৎ মনে হবে আমরা আবার ‘নায়ক’ ছবিতেই ফিরে গেছি। তরুণ কুমারের ভূমিকায় রয়েছেন অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু, পরিচালক সলিল দত্তের ভূমিকায় রয়েছেন অরিন্দম বাগচী, শক্তি সামন্তর চরিত্রে অনিন্দ্য সরকার, লালু ডাক্তার যিনি শেষদিনেও মহানায়কের পাশে ছিলেন তাঁর চরিত্রে শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে রয়েছেন অভিনেতা প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি । এ-ছাড়া রয়েছেন আরও অনেকে। এই ছবির মেক-আপ এবং কস্টিউম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ওই সময়ের, ওই আবহের পরিচিতিই পোশাক-পরিচ্ছদে। কস্টিউম ডিজাইন করেছেন জয়ন্তী সেন, মেক-আপ করেছেন আজাদ আহমেদ যাঁর বাবা বসির আহমেদ নিজে ছিলেন উত্তমকুমারের মেকআপ ম্যান। ছবির সংগীত পরিচালনায় উপালি চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতে একটি কোরাস রয়েছে যে গানে উত্তমকুমারের ছবির নাম ছাড়া একটাও অন্য শব্দ নেই। এই ছবির ইকুইপমেন্ট এবং পোস্ট প্রোডাকশনে রয়েছে এস কে মুভিজ এবং গ্রাফিক্সে রয়েছেন রজত দোলুই। শুটিং হয়েছে টুংলিং, দার্জিলিং এবং কলকাতায়। কলাকুশলীদের সঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরিচালক জানান, কাজটা করতে গিয়ে সবার মধ্যে একটা আবেগ কাজ করেছে, তাই পেশাদার অভিনেতা হিসেবে নয় প্রত্যেকেই তাঁর বেস্টটা দেবার চেষ্টা করেছেন। কারণ এটা একটা ইতিহাস। আর দ্বিতীয়বার হবে না উত্তমকুমারের বায়োপিক (Achena Uttam) তাই সেকেন্ড চান্স আর নেই।