তিন দশক আগের কথা। ১৯৯২ সালের ২৫ নভেম্বর। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভার ডাক দিয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ এককভাবে। অর্থাৎ অবিভক্ত কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব তাঁর পাশে নেই। তাই তারা এবং তাদের গোপন দোসর সিপিএম ভাবল, এবার জব্দ হবে মমতা। কারণ, আর যা-ই হোক, ব্রিগেডে লোক ভরানোর ক্ষমতা তাঁর নেই!
কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! সেদিন কলকাতার ব্রিগেড নতুন রেকর্ড গড়েছিল। জনসমুদ্র বা জনবিস্ফোরণ— কী বলা যাবে? হ্যাঁ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তার ইতিহাস রচনা করেছিল। সেই ঐতিহাসিক সভা আরও একটি কারণে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সেটা হল ব্রিগেডে আমজনতার মাঝে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দেশের রাজনীতিতে যা আজও বিরল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিত্ব আমার পায়ের বেড়ি। সিপিএমের বিরুদ্ধে ময়দানের আন্দোলনের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।’
বাংলার মার্কসবাদীদের অপশাসনের যাঁরা অবসান চান, তাঁরা মমতার নেতৃত্বে আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তখন থেকেই ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধির উদ্ভাবন হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালক্ষেপ না করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। মহাকরণ অবরোধ। ২১ জুলাই ১৯৯৩ (21st July TMC Marty’s Day), ‘মহাকরণ অবরোধ’ কর্মসূচিকে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়লেন। তিনি তখন রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট নয়, গণকণ্ঠে দাবি কিন্তু দেশের মধ্যে প্রথম তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য জুড়ে বাম-সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ছড়াতে মহাকরণ অবরোধ কর্মসূচির প্রধান স্লোগান ছিল, ‘নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট।’ পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, এই ইস্যুতে নেত্রীর আন্দোলন কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল। সেই কার্ড চালু হতে সিপিএমের রিগিং কারচুপির কেরামতি খতম হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে লালেদের বিদায় সুনিশ্চিত হয়েছিল। প্রথমে ঠিক ছিল, ১০ জুলাই হবে মহাকরণ অবরোধ কর্মসূচি। তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের মৃত্যুতে দিন বদল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা ২১শে জুলাই 21st July TMC Marty’s Day) করে দেন।
বামফ্রন্ট সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাতের ঘুম ছুটে যায়। কারণ হল, মমতা! অগ্নিকন্যার জনপ্রিয়তা তখনই তুঙ্গে। তাঁর ডাকা কর্মসূচি ঘিরে যে কলকাতা অবরুদ্ধ হয়ে যাবে, সেটা তাঁরা আগাম টের পেয়েছিলেন। এমনকী আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তাব্যক্তিদের কারও কারও আশঙ্কা ছিল, ২১ জুলাই মানুষের ঢল রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দেও আছড়ে পড়তে পারে! তাই উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সব জেলার ডিএম এবং এমপিদের নিয়ে রোটান্ডায় বৈঠকেও বসেছিলেন। সেই বৈঠক হয়েছিল ১৯ জুলাই। বৈঠকের পর প্রশাসনের কাছে নির্দেশ গিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় যেন কোনওমতেই রাজপথে পৌঁছতে না পারে!
জ্যোতি-বুদ্ধর এই গোপন সার্কুলারের খবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানেও পৌঁছে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশের ডিজি এবং মুখ্যসচিবকে ফোন করে বললেন, ‘‘আপনারা জানেন, আমাদের এই আন্দোলন মানুষের স্বার্থে। আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েও আমরা সেকথা আপনাদের জানিয়েছি। মহাকরণ অবরোধ মানে তো আর জোর করে রাইটার্স দখল করা নয়। আমরা পাঁচটা জায়গায় জমায়েত হয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাব। কোন অধিকারে আপনারা এই আন্দোলন বন্ধ করতে চাইছেন?” প্রশাসনের দুই কর্তা জননেত্রীকে সেদিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘ম্যাডাম, আমাদের কিছু করার নেই। সরকারের নির্দেশ। আমাদের সেটা মানতেই হবে।’’
আরও পড়ুন: একুশে জুলাই: বিশেষ যান চলাচল ব্যবস্থা ট্রাফিক পুলিশের
সত্যি করেই প্রশাসন ২১শে জুলাই (21st July TMC Marty’s Day) জ্যোতি-বুদ্ধর নির্দেশ পালন করতে মরিয়া ছিল। সেদিন বেলা এগারোটায় কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পৌঁছে যাই। সেখানে তখন উপস্থিত তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান সংসদীয় দলের চিফ হুইপ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলা ১২টা বাজতে না বাজতে মমতা ভিতরের ঘর থেকে একেবারে রেডি হয়ে এলেন অফিসে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত। মহাকরণ অবরোধ কর্মসূচির বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে খবর আসছে, পুলিশ মারমুখী। কয়েক লক্ষ মানুষ শহরে পৌঁছে গিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে তাদের কোথাও কোথাও খণ্ডযুদ্ধ চলছে। আর কালক্ষেপ না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রওনা দিলেন। গাড়িতে সঙ্গী কল্যাণদা আর আমি। আছেন একজন নিরাপত্তারক্ষী, মাইতিবাবুও। মেয়াে রোডে যখন পৌঁছলাম সেখানে তখন যুদ্ধক্ষেত্র, একটা ম্যাটাডরে দাঁড়িয়ে বর্তমান মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাটাডরে উঠে মাইক ধরলেন। সবাইকে শান্ত এবং সংযত হতে বললেন। কিন্তু পুলিশ বেপরোয়া। তারা প্ররোচনা দিয়েই চলেছে। রেগেমেগে নেত্রী অভিযোগ করলেন, ‘‘পুলিশের ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না, বোঝা যাচ্ছে, রাইটার্স থেকে কর্তারা বিশেষ কোনও ‘নির্দেশ’ দিয়েছে।’’
মেয়ো রােড থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা চলে এলেন ব্রেবোর্ন রােডে। সেখানে ঘটল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। নেত্রী মঞ্চে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। তারপর কী ঘটেছিল সেটা জননেত্রীর বয়ানে শোনা যাক, ‘‘মঞ্চে উঠে খালি গলায় কিছু বলার চেষ্টা করেও পারলাম না। তার মধ্যেই পুলিশ দৌড়ে মঞ্চে উঠল। তারপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে সজোরে আমার কোমরে আঘাত করল। অন্য একদল পুলিশ তখন মঞ্চ লক্ষ্য করে ক্যাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়া শুরু করেছে। সহকর্মীরা জাের করে আমায় মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনল। … পুলিশ তখন গুলি চালাতে তৈরি। রাইফেলের নল তখন আমার দিকে তাক করা। চিৎকার করে বললাম, আমায় মেরে শান্তি পেলে মারুন। কিন্তু নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালাবেন না। রাইফেলের উদ্যত নল আমার দিকে দেখে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী মাইতিবাবু তাঁর সার্ভিস রিভলবার বার করে বললেন, বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এবার আমি কিন্তু বাধ্য হব গুলি চালাতে।” সত্যি কথা বলতে কি সেদিন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দেখেছি, মাইতিবাবু যদি রণংদেহি মূর্তি না ধরতেন, তাহলে কী যে ঘটে যেত তা একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন!
তারপর ২১শে জুলাই কী ঘটেছিল সবারই জানা। চিনের তিয়েন আনমেন স্কোয়্যারের মতো কমিউনিস্ট শাসকদের নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে নিরস্ত্র নিরীহ কংগ্রেস কর্মীদের সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ১৩ জন ‘শহিদ’ হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তিনি নিহত সহকর্মীদের পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য দিতে ‘২১শে জুলাই শহিদ স্মারক তহবিল’ গঠন করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল, প্রত্যেক পরিবারকে ১ লক্ষ করে টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়া। অর্থাৎ, ১৩ লক্ষ টাকা। কিন্তু নেত্রীর আবেদনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় সেই তহবিলে জমা পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা।
নিজের লেখা ‘পরিবর্তন’ বইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন : ‘‘একুশে জুলাই এখনও আমার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দুঃখের দিন। শোকের দিন। কিন্তু পাশাপাশি সমাজ এবং মানুষের সহমর্মী স্বরূপ জানারও দিন। যতদিন বেঁচে থাকব, মনে রাখব একুশে জুলাই।’’