‘দুয়ারে সরকার।’ রাজ্যের একটি জনমুখী প্রকল্প। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই প্রকল্প শুধু জনমুখীই নয়, জনপ্রিয়ও বটে। জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলি প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়িত করছে দুয়ারে সরকার। একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধনে এ-এক অভিনব এবং অভূতপূর্ব প্রয়াস। এই সম্পকের্র মধ্যস্থতা করছে রাজ্য সরকার। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য।
এবার দুয়ারে সরকারের দ্বিতীয় পর্ব চলছে। মাত্র কয়েক দিনেই আবেদনকারীর সংখ্যা ১ কোটি ২২ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রথম পর্বে কোটিতে পৌঁছতে ১৯ দিন লেগেছিল। যেখানে ‘স্বাস্থ্যসাথী’র জনপ্রিয়তা ছিল সবার ওপরে। এবার সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। সরকার সত্যি সত্যি পৌঁছে গিয়েছে মানুষের দুয়ারে। শুধু কি তাই? দুয়ারে সরকার শিবিরে এই বিপুল জনসমাগমকে সুশৃঙ্খল রাখতে সরকার সদা-সচেষ্ট। বিশেষ করে করোনাকালে সরকারি ব্যবস্থা একেবারে যথাযথ। পান থেকে চুন খসেলই বিরোধীরা রে-রে করে তেড়ে আসছে। এ-এক মস্ত রোগ! বিরোধী রাজনীতি এতই অসহিষ্ণু যে, ভাল কাজের কদর করার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পর্যন্ত হারিয়ে বসেছে।
ভাল কাজকে ভাল এবং খারাপ কাজকে খারাপ বলাটাই গণতন্ত্রে বিরোধীদের ধর্ম। বিরোধী সমালোচনায় তথ্য থেকে সত্যে পৌঁছনোর যথাযথ চেষ্টা না থাকলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে সত্যিই খুব ক্ষতিকর। এই প্রক্রিয়াকে বলে, ‘Seeking truth from facts’। দায়িত্বশীল বিরোধীপক্ষ এ কাজে সফল হয়। বিরোধীপক্ষের সঠিক ও দায়িত্বশীল সমালোচকের ভূমিকা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচার থেকে গণতন্ত্রকে যেমন রক্ষা করতে পারে তেমনই বিরোধীদের মিথ্যা ও অসততার বেসাতি গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন : ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ বহু নেতাকর্মীর, চাপে বিজেপি
বাস্তবে, রাজ্য সরকারের, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, জাতিগত শংসাপত্র, শিক্ষাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষকবন্ধু, কন্যাশ্রী, সবুজশ্রী-র মতো প্রকল্পগুলি খুবই জনকল্যাণকর। এগুলির জনপ্রিয়তা প্রধানত প্রকল্পগুলির প্রয়োজনীয়তার কারণে। মানুষের চাহিদা এত বেশি যে, সরকারি দফতরগুলির চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ রাখলে মানুষ দ্রুত এই পরিষেবাগুলি পাবেন না। এটা বুঝেই দুয়ারে সরকার কর্মসূচি। যা মানুষকে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, গ্রামে গ্রামে, কোণে কোণে। এই প্রক্রিয়া সরকারের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়।
আধুনিক সংসদীয় ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত শাসন পরিচালনার শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে স্বীকৃত। মানুষ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন। নির্বাচিত সরকার শেষ বিচারে কোনও দলের হয় না। সরকার হয় মানুষের। তাই মানুষের পাশে থাকাই একটি নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। ভারতীয় সরকার মানে ভারতীয় জনগণের সরকার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার মানে এই রাজ্যের মানুষের সরকার। সরকার দু’ধরনের হয়। জনবিরোধী ও জনমুখী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনবিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জনমুখী সরকার গড়ে তোলাই মানুষের লক্ষ্য। জনমুখী সরকারকে কাজের সুযোগ দেয় মানুষ। এই প্রক্রিয়াকেই বলে ‘a government by the people, of the people, for the people.’ জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার।
যেমন গত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী কাজের পক্ষে এবং বিজেপি-র জনবিরোধী কাজের বিপক্ষে মানুষ ভোট দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস দলকে সরকার গড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। শুধু সেটাই নয়। ২০২৪ সালে বিজেপি-র অপশাসনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে একটি বিকল্প সরকার গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন :রাজ্যের উপনির্বাচন নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ বৈঠক আজ
আমরা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে। এই ব্যবস্থায় সরকার জনকল্যাণকামী, জনহিতকর ও গণ-উন্নয়নমুখী দিশায় কাজ করে, এই কাজের ভাল দিকগুলি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নতি ঘটায়। কাজ করতে থাকলে তার মধ্যে কিছু খারাপ দিক দেখা দিতেই পারে। সেগুলিকে নিয়ন্ত্রিত ও নির্মূল করেই এগোতে হয়। অথচ আমরা দেখলাম, বামফ্রন্টের মতো বিরোধীরা, কিছু বাম তাত্ত্বিকেরা এবং কংগ্রেস বা বিজেপি-র মতো বিরোধী শক্তি, রাজ্যের কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দান-খয়রাতির রাজনীতি’ বলে বারবার কটাক্ষ করছেন। উন্নয়নমুখী অর্থনীতিবিদরা কিংবা তাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞানীরা বহুবার জনহিতকর কর্মসূচিগুলির পক্ষে মত ব্যক্ত করলেও দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচকরা সে-সব কথায় কান দেননি।
এই বিরোধীরা এটা বুঝতে চাননি যে, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র (Participatory Democracy) বিকাশে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। মানুষের কর্মক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগছে। মানুষের সক্ষমতা বাড়ছে। কাটাচ্ছে বিচ্ছিন্নতা ও হতাশা। মানুষ বুঝতে পারছে— সরকার চাইলে অনাহার দূর করতে পারে; শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পারে; প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সংখ্যা বাড়াতে পারে; অপুষ্টির অভিশাপ দূর করতে পারে; নারীশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের সংকীর্ণ পথকে প্রশস্ত করতে পারে। আজকের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে এ সব সত্য বলেই প্রতিভাত হবে। মিথ্যার অন্ধকার দিয়ে সত্যের আলোকে বেশিদিন আড়াল করা যায় না।
যাঁরা এই প্রকল্পগুলিকে ‘দান খয়রাতি’ বা ‘ভিক্ষা’ বলে গর্ববোধ করছেন, তাঁরা আসলে ভুলে গেছেন ভারতীয় সংবিধানের ঘোষিত নীতি। ‘সামাজিক সমতা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়’-এর ধারণা আত্মস্থ করতে না পারলে সমাজনীতির মূল্যবোধ জন্মায় না। বাংলার সরকার যে সমাজনীতি গ্রহণ করেছে তা সাংবিধানিক মৌলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুরোধ, সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে ‘We the people of India …’ একটু ভালভাবে পড়ে নিন। এর অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারলে, বোঝা যাবে, সরকারি সহায়তা-প্রকল্পগুলি, ভিক্ষা নয়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিমাত্র। কেউ কেউ বলছেন, এ সবের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারের টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। সরকারের টাকা, মানুষেরই টাকা। আগেও বলেছি, আবারও বলছি। দুয়ারে সরকার শিবিরগুলিতে বিপুল জনসমাগমই বলে দেয় যে, এই ধরনের প্রকল্পগুলির কতখানি প্রয়োজন ছিল। নগদ আর্থিক সহায়তার কথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ— অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে রঘুরাম রাজন, কৌশিক বসু— সাম্প্রতিক কালেও বারবার বলেছেন। যে কাজটি কেন্দ্রীয় সরকারের করার কথা ছিল, রাজ্য সরকার তা করেছে বলে কাজটি অকাজ হয়ে যায় না। আসলে এ-রাজ্যের বামফ্রন্ট বিকল্প উন্নয়ননীতির কথা বারবার বলেছেন, অথচ কিছুই তেমন করতে পারেননি। বিজেপি এবং তার চাটুকার অর্থনীতি বিশারদরা ‘মোদিকোনমিক্সে’র গুণগান করছেন। বাস্তবে সেই অর্থনীতির বেহাল অবস্থা আমরা সকলেই দেখছি। বিরোধীরা যেটা দেখতে বা বুঝতে পারছেন না তা হল, গত কয়েক বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতনভাবেই একটি বিকল্প উন্নয়ন নীতির পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন। যার মূল ভিত্তি হল, অতি-দরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত-সহ বিপুল মানুষের পরিবারগুলির ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর ফলে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন-অভিঘাত ক্রমশই বাড়ছে। বিরোধীর এই কঠিন সত্যটা মানতে পারছেন না। এটা বুঝতে চাইছেন না যে, কেন্দ্রের আর্থিক অবস্থা যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে, নানা অসহযোগিতা সত্ত্বেও বাংলা তখন কীভাবে নানা দিকে উন্নতি করে চলেছে।
প্রকৃত সত্য হল, মানবোন্নয়নের নিরিখে বাংলার উন্নতি ঘটছে। রাজ্য সরকারের জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলি তার মাধ্যম। আর দুয়ারে সরকার হল সেই প্রকল্পগুলিতে মানুষকে টেনে আনার বিপুল কর্মোদ্যোগ।
পরিশেষে বলব, ‘ভিক্ষা’ আর ‘অধিকার’-এর পার্থক্য যাঁরা বোঝেন না সেটা তাঁদের ‘দর্শনের দারিদ্র’ (Poverty of Philosophy)। এ দারিদ্র ঘোচানো প্রায় অসম্ভব। চোখ থাকতেও যদি কেউ অন্ধ হয়ে থাকতে চায়, তবে আর কী করা যাবে!