ধর্ম কি আমাদের পরিচয়? আমরা মানুষ এটাই আমাদের পরিচয়! রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ছবি ধর্মযুদ্ধ-এর (Dharmajuddha) এটাই ট্যাগ লাইন বলা যায়। এটা শুধু তাঁর ছবির কথা নয় এটা আপামর মানুষের কথা, মানবতাবাদের কথা। ধর্মকে নিয়ে যুগে যুগে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসছে সেই ধর্মভীরু মানুষই। শুভবুদ্ধি দিয়ে সামাল দিয়েছে বড় বিপদও সেই কারণেই দাঙ্গা মিটেছে ফিরেছে শান্তি।এই ছবির উপজীব্য বিষয় কতকটা এমনই।
পরিচালক রাজ চক্রবর্তী সব সময় তাঁর ছবিতে বিনোদনকে গুরুত্ব দিয়ে এসছেন। তাঁর ছবি মানেই ভরপুর মনোরঞ্জন, ধামাল, নাচ -গান,সুখ -দুঃখ হাসিকান্না, পারিবারিক পারিপাট্যে মোড়া সুন্দর উপহার। তবে সেই চেনা ছক ভাঙছেন রাজ বিগত কয়েকবছর ধরেই। একটু অন্য ধারার বিষয়ভিত্তিক ছবি করছেন। সবরকম দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বহুমুখী বিষয়বস্তু যা সমাজকে একটা সুস্থ বার্তা দেবে এমন ধারাকে নিজের কাজের মধ্যে নিয়ে আসছেন। রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত তেমনই একটি বিষয়ভিত্তিক ছবি হল ‘ধর্মযুদ্ধ’ (Dharmajuddha)। আগামী এগারো আগস্ট পেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে এই ছবিটি।
ছবিটি প্রসঙ্গে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বললেন, ‘২০১৯ -এ পরিণীতার পরে আমি ভাবছিলাম কী ধরণের ছবি করা যায় তখন আমার স্ত্রী শুভশ্রী আমাকে বলে আমারই একটি টেলিফিল্মের কথা যার নাম ‘দাবী’। ২০০৬ আমি ওই টেলিফিল্মটা বানিয়েছিলাম। ওর গল্পটা ওই সময়ের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ছিল। তখন শুভশ্রী বললো দেখ যদি এই গল্পের উপর একটা সিনেমা তৈরি করা যায়। তখন দিল্লিতে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়েছিল। ধর্ম নিয়ে এই যে যুদ্ধ এটা কিন্তু বহুযুগের এবং হয়তো আগামী বহুদিন এই যুদ্ধ চলবে। তখন সেই গল্পের উপর ভিত্তি করে আমি ছবি করার সিদ্ধান্ত নি। ছবির গল্পটা আমার এবং পদ্মনাভ দাশগুপ্তর ব্রেন চাইল্ড বলা যেতে পারে। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছে পদ্মনাভ দাশগুপ্ত।’
আরও পড়ুন: অর্ধেক আকাশ জুড়ে উড়ান, তিনিই ডানা জুগিয়েছেন
একগুচ্ছ তারকার মেলা রয়েছে ছবিতে। ছবির গল্প প্রসঙ্গে পরিচালক বললেন, ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমি।সেখানে দুটো সম্প্রদায়ের মানুষ লড়ছে। বাইরে এই হানাহানি কাটাকাটির মাঝেই হিন্দু ও মুসলিম পরিবার তাঁরা আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে একটি বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বৃদ্ধা কে ? কী তাঁর ধর্ম ? তা কিন্তু কেউ জানেনা। তখন বৃদ্ধা তাঁদের বলে যে সে তাঁদের আশ্রয় দিতে পারে একটিই শর্তে যদি তাঁরা নিজেদের জাত ধর্ম ভুলে এখানে থাকতে পারে এবং ঘরের ভিতর কোনও হানাহানি, মারমারি আর না করে। না হলে মৃত্যু তাঁদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। এমতাবস্থায় প্রাণে বাঁচতে তাঁরা রাজি হয় কিন্তু এতক্ষণ তো তাঁরা বাইরে মারামারি করছিল তাহলে ঘরের ভিতরে কীভাবে নিজেদের সংযত রাখবে? এটাই তো তাঁদের প্রবৃত্তি। এটাই তো তাঁরা জেনে এসছে যে জাত পাত ধর্মই সব !মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, মানব ধর্ম বলে কিছু হয়না। সেই একটা রাত তাঁরা ওই বাড়িটার ভিতরে থাকবে কী হবে সেখানে ! কী ঘটবে সেই রাতে !এটাই দেখার জন্য পেক্ষাগৃহে আসতে হবে সিনেমাপ্রেমীদের। ‘ধর্মযুদ্ধ’ (Dharmajuddha) মানবতার গল্প, উত্তরণের গল্প। এই গল্প দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে যায় অনায়াসে। আমরা যখন জন্মেছি তখন কোনও ধর্ম নিয়ে জন্মাই নি। আমাদের বাবা মা পরিচিত জন ঠিক করেছে আমরা কোন ধর্মের। কিন্তু আমরা সর্ব প্রথম রক্তমাংসের মানুষ। এটাই ভুলে যাই। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠি। মারামারি , হানাহানিতে লিপ্ত হই। এটা একটা স্ট্রং পলিটিক্যাল ছবি কিন্তু এই ছবিতে আমি কোনও দলের হয়ে কথা বলিনি এটা ইউনিভার্সাল একটা সাবজেক্ট।
এই ছবির প্রোটাগনিস্ট পাঁচজন। সেই পাঁচটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, পার্ণ মিত্র, সোহম চক্রবর্তী এবং ঋত্ত্বিক চক্রবর্তী। এই পাঁচজনেরই গল্প ‘ধর্মযুদ্ধ’ (Dharmajuddha)। এটি তাঁদের অতীতের গল্প এবং বর্তমানের গল্প। এটি একটা রাতের বেঁচে থাকার গল্প।ছবির প্রযোজক রাজ চক্রবর্তী এবং শ্যামসুন্দর আগরওয়াল। ক্যামেরায় রয়েছেন শমীক হালদার। পরিচালক উচ্ছসিত হয়ে জানালেন, অসাধারণ ক্যামেরা করেছেন শমীক। তাঁর ক্যামেরার দক্ষতা অবশ্যই একটা ম্যাজিক তৈরি করবে এই ছবিতে। ‘ধর্মযুদ্ধ’ এর সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রজিৎ দাশগুপ্ত। লিরিক লিখেছেন ঋতম সেন। ছবিতে গান গেয়েছেন শ্রেয়া ঘোষাল। শ্রেয়ার গানটা ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় কারণ গানটি অনেক আগেই রিলিজ হয়ে গেছে। এছাড়াও এই ছবিতে গান গেয়েছেন দেব-অরিজিৎ। আর গান গেয়েছেন সৌরেন্দ্র সৌমজিৎও। ছবির এডিটিংয়ে রয়েছেন কালাম। ছবির শুটিং হয়েছে দুটো ভাগে পুরুলিয়া এবং কলকাতায়।
২০১৯ এর শেষের দিকে শুটিং হয়েছিল ধর্মযুদ্ধর (Dharmajuddha)। তারপর অনেক অপেক্ষা, অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে রিলিজ করতে চলেছে এই ছবি। এই প্রসঙ্গে পরিচালক বললেন, ধর্মযুদ্ধ রিলিজের কথা ছিল ২০২০-র ২০ মার্চে। কিন্তু সেই সময় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। অতিমারির প্রকোপ চলছে। ২২ মার্চ লকডাউন ঘোষণা হয়। তখন আমরা ঠিক বুঝিনি লকডাউন কী। কতদিন চলতে পারে। কী হতে চলেছে। তারপর দুবছরে তিনবার আমরা ছবিটা রিলিজ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম কিন্তু তিনবারই পারিনি। ফার্স্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ এবং থার্ড ওয়েভ এসেছে পর পর। ফলে বার বার বাধা পেয়েছি। তখন এর মাঝে আরো একটা ছবি ছিল আমার নাম ‘হাবজি গাবজী’। সেটা রিলিজ হয়। এবার সামনেই পনেরোই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। এই সময়টা এই ছবির জন্য খুব উপযুক্ত তাই এগারোই আগস্ট রিলিজ করছি।
২০১৯ এর রাজ চক্রবর্তী এবং ২০২২ এর রাজ চক্রবর্তী অনেকটা পরিবর্তিত তাঁর অবস্থান। তখন রাজনীতির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিলনা তাঁর। এখন তিনি বিধায়ক। সক্রিয় রাজনীতির মঞ্চে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে কতটা তফাত হয়েছে তাঁর জীবনে মননে, ব্যালান্স করছেন কীভাবে এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, রাজনীতি আমার জীবনের আর একটা অংশ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা রাজষিক সত্তা থাকে বলে আমি মনে করি। সেই সত্তা নিয়ে সে রাজনীতি কীভাবে করবে সেটা তাঁর উপর নির্ভর করে। আমি প্রথমে একজন ফিল্ম মেকার, ছবি তৈরি করি, এটাই আমার পেশা। আমি আজ রাজনীতির মঞ্চে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। তিনি আমাকে নিয়ে এসছেন তাই। আমার সেই দায়িত্ব আমি আলাদাভাবে পালন করছি। যখন ভোট হয় তখন আমি রাজনীতির কথা বলি কিন্তু সারাটা বছর ধরে যখন আমাকে মানুষকে পরিষেবা দিতে হয় তখন আমি রাজনীতির কথা বলিনা। আমি যখন পরিষেবা দি তখন ভাবিনা সামনের মানুষটা কোন দলের। তাই আমার ছবি পরিচালনা হোক বা রাজনৈতিক দায়িত্ব দুটো কাজই মানুষের জন্য করা তাই চেষ্টা করি দুটোকেই ব্যালান্স করতে। আমি আমার বেস্টটা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি দায়বদ্ধ সেটা করতে।
পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিচালক জানালেন, পরিকল্পনা প্রচুর। ওয়েব সিরিজ, বড়পর্দা দুটো নিয়েই কাজ চলবে। ছবির ক্ষেত্রে এখন প্রাসঙ্গিক বিষয়কেই গুরুত্ব দেব। মনোরঞ্জনের পাশাপাশি, সামাজিক বার্তাও থাকবে সেই ছবিতে। আর বিধায়ক হিসেবে মানুষের পাশে থেকে আরো বেশি কাজ করব।