তুচ্ছ ব্যাপার, তাই নিয়ে হইচই বাধাও। আর মূল বিষয়গুলো, আলোচ্য বিষয়গুলো, গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কগুলো এড়িয়ে যাও। এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাজপার নতুনতম রণনীতি। পিঠ বাঁচানোর নয়া কৌশল। তিলকে তাল করে দেখানো এই কৌশলের অন্যতম উপচার। তুচ্ছকে গুরুত্বপূর্ণ করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কোলাহলের চাদর দিয়ে জরুরি বিষয়কে মুড়িয়ে পেছনে ঠেলে সত্যটাকে মিথ্যের আঁচে সেঁকে ফেলার ব্যবস্থা করছে।
এই আচরণ, এই কৌশল, সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র বলে কোনও ব্যবস্থার অস্তিত্ব এ-দেশে লোপ পাবে। লোপ পেতে বাধ্য। নয়া ভারত নির্মাণের যে খেলায় মোদি-শাহ-যোগীরা নেমেছেন, তাতে এই দেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংসদীয় গৌরবের শিরোপা লোপ পেল বলে!
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এ আশঙ্কা যে মোটেই অমূলক নয়, তা ক্রমে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক। সংসদের (Parliament of India) সংক্ষিপ্ত অধিবেশন। আলোচনার বিষয়সূচিতে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকতে পারত। কিন্তু থাকল কই?
গত ৪০ বছরে এই পরিমাণ বেকারত্ব এদেশে দেখা যায়নি। রোজ যখন ৫৬ ইঞ্চি ছাতির ভক্তরা ভারতীয় অর্থনীতির দুর্দান্ত উড়ান নিয়ে প্রচারের ঢাক পেটাতে ব্যস্ত, তখন বেকারত্বের এই বিভীষিকাময় চিত্র নিঃসন্দেহে সবল, সতেজ, শক্তপোক্ত অর্থনীতির কথা বলছে না। অথচ, সেটা মানতে, তা নিয়ে আলোচনা করতে নারাজ এই গেরুয়া-পুজারিরা। গত তিন বছরে কতজন ভারতীয় অর্থনৈতিক ভাবে শরণার্থী হয়ে পড়েছেন, সেই সংখ্যাটাও কিন্তু একটা মারাত্মক পরিণতির ইশারা। বহু সংখ্যক ভারতীয় একেবারে তিন বছরের ধাক্কায় ইকোনমিক রিফিউজি হয়ে পড়ছেন, এটাও কোনও অর্থনীতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়।
গত ১৯ জুলাইয়েই সংসদে (Parliament of India) স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০১৯-এ ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ১৯ জন ভারতীয় এদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছিলেন। পরের বছর সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ৮৫ হাজার ২৫৬-তে। কিন্তু ২০২১-এ তা বৃদ্ধি পেয়ে আগের হিসাবকেও ছাপিয়ে যায়। ২০২১-এ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়েন ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩৭০ জন ভারতীয়— সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে অমিতবিক্রমশালী নরেন্দ্র মোদি ভারত সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর থেকে সর্বমোট ৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩৪৫ জন ভারতীয় নাগরিক এদেশ ছেড়েছেন। ছেড়েছেন মানে, একেবারে দেশত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
হাততালি দেওয়ার মতো কি ছবিটা?
গর্বে ছাতি ফোলাবার মতো কি?
প্রশংসায় মুখরিত হওয়ার উপযুক্ত চিত্র এটা?
গুলিয়ে যাচ্ছে। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
আরও গোলমাল হয়ে যায় যখন দেখি সংসদে এসব ইস্যুতে আলোচনায়, বিতর্ক করার কোনও অবকাশ নেই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। তাই নিয়ে আলোচনা করতে চেয়ে বিরোধী সাংসদেরা বহিষ্কৃত। কোন? খাবার জিনিসের দাম বেড়েছে মারাত্মক ভাবে। জ্বালানির অগ্নমূল্য। এমতাবস্থায় বধির সরকারকে শ্রবণক্ষম করতে হলে প্ল্যাকার্ড তো হাতে নিতেই হবে, তুলতেই হবে স্লোগান, নামতেই হবে ওয়েলে। এ-ছাড়া বিরোধী পক্ষের কাছে কি অন্য কোনও পথ খোলা আছে? আরও স্পষ্ট ভাষায় বললে, সরকার বাহাদুর কি বিক্ষোভ ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা রেখেছেন? রাখতে আগ্রহী? অতীতে দেখেছি, এখনও দেখছি, দেখে চলেছি, বিক্ষোভ আন্দোলন উত্তাল না হলে এই সরকারের টনক নড়ে না। তাঁদের বধির কর্ণকুহরে কোনও ন্যায়সঙ্গত কথাই পৌঁছয় না। এই প্রসঙ্গে একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে, সংসদের আলোচনার প্রতি সজাগ চোখ ও কান খুলে রাখা একজন সতর্ক ভারতীয় হিসেবে, এ ব্যাপারে আরও একটা কথা না বললেই নয়— লোকসভার অধ্যক্ষ যদি সংসদে অভ্যবতার জন্য শাসক শিবিরের কতিপয় মহিলা সাংসদকে বহিষ্কৃত করতেন তবে তাঁর নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি উন্নীত হত। সাধারণের চোখে অন্তত।
আরও পড়ুন: প্রতারণার অঙ্ক ৭০০০ কোটি, পলাতক গুজরাতি ব্যবসায়ী
সবচেয়ে হাসি পায়, অথবা বলা ভাল কান্না পায়, যখন দেখি বিজেপি সাংসদরা নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে সোচ্চার। দলিত কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হলে তাঁরা তো মৌনতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে গ্রহণ করেন। হাথরাসের ঘটনায় সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের হয়েছে। সেখানে তো মেয়েটি গণধর্ষণের শিকার হল, খুন হল এবং পুলিশ তাকে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়েও দিল। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে নারী-নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সেটা ভারতীয় নারীত্বের প্রতি অবমাননাকর, এমনটা তো কই বিজেপির মহিলা সাংসদদের কখনও মনে হয় বলে মনে হয়নি আমাদের। কেন সারা ভারতে রোজ যে নারীরা নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা সংসদে আলোচনার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে না? বিবেচিত হয় না?
সংসদ কি তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা দেখার জন্য? তা নিয়ে হইচই করে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ তৈরির জন্য? তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের আলো মুখে টেনে আনার জন্য? কেন সংসদে আলোচনার গভীরতার চেয়ে এইসব চাপল্য চটুলতা বেশি ফুটেজ খাবে?
বেকারত্ব কিংবা নারী নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো ভীষণ সাধারণ। ভীষণ সামান্য। কিন্তু আম-আদমির কাছে সবচেয়ে দরকারি বিষয়। আম-আদমি এসব নিয়ে আলোচনা শুনতে চায় বলেই টিভির টকশোতে এগুলো বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। অথচ এগুলো নিয়ে সংসদে আলোচনার কথা আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা ভাবেন না, ভাবতেই পারেন না। নয়া ভারত নির্মাণ হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে। অমৃত মহোৎসবে।
সেখানে হিন্দুত্বের জায়গা আছে উপচার হিসেবে। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের দাপাদাপি আছে ভিত গড়ার প্রয়োজনে। অথচ সাধারণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ সংসদে (Parliament of India) আলোচিত হওয়ার সময় পায় না। তুচ্ছ কারণে বিতণ্ডা তৈরি হয়। সব ভণ্ডুল হয়ে যায় কিংবা করে দেওয়া হয়। বিরোধীদের বহিষ্কার করে সরকারপক্ষ একক স্বর হয়ে উঠতে চায়।
সময়টা একেবারেই সুবিধার নয়।
সংসদটা কেন আছে, তবে!