তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা—।
বধুঁ, স্বাধীনতা কারে কয়,
সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে
এমন দুখের আশ।
নাহ্! রবিঠাকুর এমন পঙক্তি লেখেননি। এটা যতটা সত্যি, ততটা সত্যি এটাও যে, এই পঙক্তিনিচয়ে ধরা পড়েছে ভারতের আম-আদমির সাধারণ জিজ্ঞাসা, তাদের দীর্ঘশ্বাস, তাদের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকার কষ্ট।
আরও পড়ুন-যেভাবে ৭৫ পূর্তি পালন করবে বাংলা
ভারতের গণতন্ত্র স্রেফ নির্বাচনী গণতন্ত্র (election-only democracy)। বেশ কয়েক বছর আগে কথাটা বলেছিলেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। ৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সে কথাটাকেই ভীষণ ভীষণ সত্যি বলে মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, কারণ, এখনও এদেশে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মমাফিক সময়সারণি অনুসরণ করে ভোটটা হয়। কিন্তু দুটো ভোটের মাঝখানে সে সময়টা, সেখানে নির্বাচিত শাসক পক্ষের কোনও দায়বদ্ধতা মোদি-শাহর গেরুয়া জমানায় দেখা যাচ্ছে না। সংসদের প্রতি, সংবাদমাধ্যমের প্রতি, সামগ্রিকভাবে নির্বাচক জনগণের প্রতি কোনওরকম দায়বদ্ধতার প্রকাশ এই সরকারের পক্ষ থেকে প্রদর্শনের কোনও ইচ্ছা আছে বলেই মনে হচ্ছে না।
আরও পড়ুন-সার্বিক মূল্যায়নে স্বাধীনতা ৭৫
মনে হচ্ছে না, কারণ এখনও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘জুমলা’ প্রতিশ্রুতিমাফিক কোনও নাগরিকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা পড়েনি।
মনে হচ্ছে না, কারণ প্রধানমন্ত্রী যেমনটা বলেছিলেন, সেই মতো, কালো টাকা বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেনি।
মনে হচ্ছে না, কারণ, ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে যে কথা দেওয়া হয়েছিল, তদনুসারে ফি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ন্যূনতম লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মনে হচ্ছে না, কারণ, ১৫ অগাস্ট, ২০২২-এর মধ্যে সকলেই ঘরে ২৪x৭ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি, কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়নি, অপুষ্টির অবসান ঘটেনি, মুম্বই-আমেদাবাদ বুলেট ট্রেন চালু হয়নি, জাতপাত আর সাম্প্রদায়িকতার অবসান হয়নি। অথচ, আগামিকালের মধ্যে এতগুলো ঘটনা, অগ্রগতির এতগুলো লক্ষণ-চিহ্ন স্পষ্ট হওয়ার কথা ছিল। মোদিজি এমনটাই বলেছিলেন। ২০২২-এ নয়া ভারত নির্মাণের স্বপ্ন ফেরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন-কিছু উপলব্ধি কিছু বেদনা
মনে হচ্ছে না, কারণ, এই সেদিনও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদিজি বলেছিলেন, সংসদকে অপরাধীমুক্ত করবেন। অনেকে ভেবেছিলেন, দলমত নির্বিশেষে দুষ্কৃতীদের আইনসভার সদস্য হয়ে ওঠার পথে পাঁচিল তুলবেন মোদিজি। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস নামক একটি অসরকারি সংস্থার তরফে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সবাই জানলাম, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী ৫৩৯ জন সাসংদের মধ্যে ২৩৩ জন অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আছে। ২০১৪-তে এই সংখ্যাটা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সেবার ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল ১৮৫ বা মোট নির্বাচিত সাংসদের ৩৪ শতাংশ।
মনে হচ্ছে না, কারণ, ডিসেম্বর, ২০১৮-তে নীতি আয়োগ একটি নথি প্রকাশ করে। সেটির শিরোনাম ‘স্ট্র্যাটেজি ফর নিউ ইন্ডিয়া @৭৫’ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে নব ভারতের জন্য পরিকল্পনা। সেখানে ২০২২-এর মধ্যে অপুষ্টি-মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আর ২০২২-এর স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন দেখতে পাচ্ছি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তালিকায় ১১৬টি দেশের মধ্যে মোদি-শাসিত ভারতের স্থান ১০১-এ।
আরও পড়ুন-বেলুড় বালিকা বিদ্যালয় পেল নতুন রূপ
মনে হচ্ছে না, কারণ, সংবিধানে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বজনীন ভোটাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, অসাম্য নিশ্চিতকরণের জন্য যেন এই গেরুয়া সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই, তাই-ই, গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য যে প্রকল্প, সেই মনরেগা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবর্ষে কমিয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা কর্পোরেট করে ছাড় ঘোষিত হয়েছে ১.৪৫ লক্ষ কােটি টাকার, চলতি অর্থবর্ষে মনরেগার বাজেট বরাদ্দের দ্বিগুণ এই ছাড়ের টাকা। সোজা কথায় গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষের তুলনায় কর্পোরেটের প্রতি এই জমানার প্রীতি-পক্ষপাত সমধিক।
এহ বাহ্য! ওয়ার্ল্ড ইন-ইকোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২-এ প্রদত্ত ছবিটা মারাত্মক। বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা এই বৈষম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেন। এই রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের এক শতাংশ ধনীতম জনগণের হাতে ২২ শতাংশ জাতীয় আয়ের অধিকার আর দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ কেবল ১৩ শতাংশ জাতীয় আয়ের ভাগীদার।
আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় আসছে চিনা নজরদারি জাহাজ
আর গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ? সে ব্যাপারে স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তী বর্ষে এগিয়ে মোদির ভারত। সরকারের দেওয়া রিপোর্ট বলছে ২০১৬-’২০-র মধ্যে ২৪ হাজার ভারতীয়কে ইউএপিএ-তে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মোটে ১ শতাংশকে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে। বাকি ৯৯ শতাংশের জীবন, জীবিকা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্মান, সব কিছু বরবাদ হয়ে গিয়েছে মোদির ভারতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সৌজন্যে।
আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা? বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের স্থান ১৪২ থেকে নেমে ১৫০-এ।
সব মিলিয়ে, ভারতের গভীরতর অসুখ এখন। এত্ত কিছু না-পাওয়ার আবহে ঘরে ঘরে জোর জবরদস্তি করে জাতীয় পতাকা কিনিয়ে উড়িয়ে স্বাধীনতা যথাযথভাবে উদযাপিত হয় কি না, সেটাই এখন অর্বুদ টাকার প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-নিম্নচাপে সুন্দরবনে শঙ্কা দুর্যোগের, সতর্ক প্রশাসন
অন্তিমে তাই রয়ে যায় ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লাইনগুলো, একটু বদলে নিয়ে :
‘‘স্বাধীনতার সঠিক মানে ক’জন স্বজন সত্যি জানে/ স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজি শেকল ছেঁড়া পাখির গানে।’’ সেই খোঁজাতেই হারিয়ে যায় ৭৫তম ১৫ অগাস্ট, অহেতুক ঘূর্ণাবর্তের পাকে। কিংবা মিথ্যার পাঁকে। তবুও উড়ুক তেরঙ্গা। উচ্চারিত হোক ‘বন্দে মাতরম্’। ভারতের প্রতিটি ঘরে। ভারতের প্রত্যেক কণ্ঠস্বরে। কারণ, ‘‘সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’’