সুস্মিতা মণ্ডল, কাকদ্বীপ (Kakdwip): সাগরের উত্তাল ঢেউ আর নাগাড়ে বৃষ্টি। তারমধ্যে প্রায় আঠারো থেকে কুড়ি ঘণ্টা উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের জলে ভেসে ছিলেন ওঁরা পাঁচজন। সাগরের জলে ছিল কুমিরের আতঙ্ক। পরে জলে ভাসতে ভাসতে পাশের কেঁদোর জঙ্গলে আশ্রয় নেন ওঁরা। কেঁদোর জঙ্গল আবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অবাধ বিচরণভূমি। তাই জঙ্গলে পুরোপুরি না ঢুকে একরাশ আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সাগরের পাড়ে রাতভর বসে ছিলেন ওঁরা। রাত যেন আর শেষ হতে চায় না। সকাল থেকে পেটেও দানাপানি পড়েনি। নোনা জলের ঝাপটায় কাবু হয়ে গেছে তারতাজা শরীরগুলি। কিন্তু ওঁদের শেষ প্রার্থনা ছিল, বেঁচে বাড়ি ফেরা। শনিবার ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের কেঁদো দ্বীপের কাছে পৌঁছয় মৎস্যজীবী ইউনিয়নের উদ্ধারকারী ৬টি ট্রলার। ওই মৎস্যজীবীদের উদ্ধারে গিয়েছিল ট্রলারগুলি। জঙ্গলের পাশ থেকে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার জুড়ে দেন ওই পাঁচজন। সেই আওয়াজ শুনে অবশেষে উদ্ধার হয় শুক্রবার সকালে ডুবে যাওয়া ট্রলার এফবি সত্যনারায়ণের নিখোঁজ পাঁচ মৎস্যজীবী। এঁরা কালী দাস, রবীন দাস, যাদব দাস, মৃদুল দাস ও শেখর দাস। এঁরা প্রত্যেকেই কাকদ্বীপের কালীনগর এলাকার বাসিন্দা। শনিবার বেলা এগারোটা নাগাদ উদ্ধার মৎস্যজীবীদের নিয়ে আসা হয় পাথরপ্রতিমা ঘাটে। সেখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাকদ্বীপ হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পরেও সকলের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। হাসপাতালে চেক আপের পর ঘণ্টা দুই পরে বাড়ি ফেরা। ততক্ষণে হাসপাতালে চত্বরে ভিড় জমিয়েছেন উদ্ধার মৎস্যজীবীদের আত্মীয়-স্বজনরা। প্রিয়জনদের ফিরে পেয়ে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকে। উদ্ধার মৎস্যজীবীদেরও তখন চোখে জল। মধ্য চল্লিশের কালী দাস বললেন, ‘‘সকালে ট্রলার ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে সকলে লাইফ জ্যাকেট পরে নিই। ঢেউ আর বৃষ্টিতে ভাসতে থাকি সকলে। স্রোতের টানে ভেসে যেতে থাকি। ১৮ জন যে যার মতো হারিয়ে যাই। দীর্ঘক্ষণ এভাবে ভাসার পর বিকেল নাগাদ আমরা পাঁচজন কেঁদোর জঙ্গলের কাছে চলে আসি। এরপর থেকে আমরা একসঙ্গে। কেঁদোর জঙ্গল বাঘের জঙ্গল হিসেবে চিহ্নিত। আমরাও তা জানি। তাই জঙ্গলের বাইরের দিকে সাগরের কিনারায় আমরা রাতভর অপেক্ষা করি। কোনও আওয়াজ পেলে ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠছিল। খিদে, তেষ্টায় শরীরও আর দিচ্ছিল না। আমরা সবাই শুধু ভগবানকে ডাকছিলাম। কেই ঘুমোইনি। সকলে জেগে ছিলাম। রাত যেন শেষ হচ্ছিল না!’’ হাসপাতালে উপস্থিত কাকদ্বীপ ফিশারম্যান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিজন মাইতি জানান, ‘‘সকলে লাইফ জ্যাকেট পরেছিল বলে বেঁচে ফিরল। তবে বাঘের জঙ্গলে যেভাবে ওরা রাত কাটিয়েছে তা অভাবনীয়। আসলে বাঘের ভয় তখন ওদের কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বর ওদের বাঁচিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।’’
আরও পড়ুন: মানুষের ক্ষোভের মুখে কেন্দ্রীয় দল