বয়কট-সংস্কৃতি (Boycott Culture)। গোটা ভারত জুড়ে গত ৫-৬ বছরের এক নতুন ট্রেন্ড এই বয়কট-সংস্কৃতি (Boycott Culture)। যার শিকড় ক্রমশ গোবলয় ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের কোনায় কোনায়। যার উত্থান অবশ্যই গৈরিক রাজনীতির ধারক-বাহক বিজেপি-আরএসএসের বেতনভুক আইটি সেলের হাত ধরে। সম্প্রতি ভারতে আমির খানের একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবিটি ভাল না খারাপ সেটা পুরোপুরিই নির্ভর করছে ছবির কন্টেন্ট দর্শকদের ভাল লাগবে না খারাপ তার ওপরে। কন্টেন্ট ভাল হলে চলবে নচেৎ দর্শক সে-ছবি প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু ছবিটি মুক্তির আগেই যে বয়কট ট্রেন্ডিং চালু হল গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, তার পিছনে আছে এক বিরাট রাজনৈতিক অঙ্ক। প্রেক্ষিতটা হয়তো অনেকেই জানেন, তবুও আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন৷ ২০১৫ নাগাদ এক সাক্ষাৎকারে, আমির খান দেশের সাম্প্রতিক হালহকিকত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, বলেন যে, এদেশে অসহিষ্ণুতা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। এবং এই দেশে তাঁর স্ত্রী তাঁদের সন্তানকে নিয়ে থাকতে নিরাপদ বোধ করছেন না। এখান থেকেই বির্তকের শুরু। ‘বয়কট আমির খান’ ট্রেন্ডিং শুরু করলেন কুখ্যাত অমিত মালব্য এবং তাঁর আইটি সেলের টিম। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল সংশ্লিষ্ট অভিনেতার ধর্মীয় পরিচয়। বলা হল, শুধুমাত্র মুসলিম বলেই, আমির তাঁর ছবি ‘পিকে’তে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন। কিন্তু এখানেই বিজেপির ‘হিপোক্রেসি’র মুখোশ খুলে পড়ে। কারণ, একইরকম গল্পের ‘ও মাই গড’ ছবিটি (যা একটি গুজরাটি নাটক ‘কিসান ভার্সেস কানহাইয়া’র চলচ্চিত্রকরণ) নিয়ে নিশ্চুপ থাকে বিজেপি। কারণ, সেই ছবির মুখ্য অভিনেতা পরেশ রাওয়াল নিজে একজন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ। কিন্তু বয়কটের এই সংস্কৃতি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মের শিল্পীদের ক্ষেত্রেই যে হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। আপনি হিন্দু হতে পারেন। শিখ হতে পারেন। জৈন হতে পারেন। আপনি যদি সরকারের বিরোধিতা করেন। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে, আপনি যদি বিজেপির বিরোধিতা করেন, খুব সহজেই আপনার নামের সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ট্যাগ লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং করে দেওয়া হবে। রাষ্ট্র— সরকার এবং শাসক দল এগুলো যে এক নয়। বরং রাষ্ট্র একটি ধ্রুবক। এবং শাসক দল বা সরকার পরিবর্তনশীল, এই সহজ-সরল কথাটাকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে মো-শাহেরা! বিজেপির সমালোচনা করলেই আপনি রাষ্ট্রদ্রোহী, এই ন্যারেটিভটাকে গত সাত-আট বছর ধরে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে গোয়েবলসের ভারতীয় সংস্করণ বিজেপি আইটি সেল। ঠিক যেমনভাবে নাৎসি জার্মানিতে হিটলারের সমালোচনা করাটাই ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতোন অপরাধ। নাৎসিবাদ-ইহুদি হত্যা-উগ্র জাতীয়তাবাদ-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নির্দ্বিধায় দেশদ্রোহী বানিয়ে দেওয়ার যে লজ্জার ইতিহাস নাৎসি জার্মানিতে রচিত হয়েছিল তার আধুনিক সংস্করণ আজ বিজেপির কল্যাণে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতবর্ষে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, সঙ্ঘের আদি প্রবক্তারা সাংঘাতিকভাবে নাৎসি জার্মানি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। স্বয়ং সাভারকরও হিটলারের নাৎসি জার্মানির কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। তাঁদের উত্তর পুরুষরা যে সেই ধারাকে আজকের ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কিছু নেই। ভারতের যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এবং শিল্প ও শিল্পীর যে পূর্ণ স্বাধীনতা সেই কাঠামোতে এই ‘বয়কটজীবী’ নব্য নাৎসিরা ক্রমাগত কষাঘাত করে চলেছে। এবং খানিক অংশে তারা সফলও হচ্ছে গৈরিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার এই ক্ষেত্রে। তাই আমির খান, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনুরাগ কাশ্যপ, সোনু সুদ, শাহরুখ খান, দীপিকা পাড়ুকোন। যে যখনই সরকারের সমালোচনা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যালাপ করেছে বিজেপি আইটি সেল। দেশের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া এবং রাষ্ট্রবিরোধীর আখ্যা দেওয়া চলছে আকছার। আসলে ক্ষমতার রাজনীতি করতে করতে বিজেপি ভুলে গেছে যে, ভারত নামক রাষ্ট্রটি এতটাও ঠুনকো নয়, যে, কে কী বলল তাতে এই দেশের ভাবাবেগে আঘাত লেগে যাবে। বা দেশের অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শক-হুন-পাঠান- মুঘল-পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-ব্রিটিশ এদেশের কয়েক হাজার বছর রাজত্ব করেও ভারত-আত্মার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। আসমুদ্রহিমাচল যে ভারতবর্ষের আত্মা নিহিত আছে এ-দেশের কোটি কোটি শ্রমিক, কৃষক, জওয়ান, ছাত্র-যুবর মধ্যে— বিজেপি এই ইতিহাস জানে না। বা জানলেও তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করে, নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে তৈরি গৈরিক ইতিহাসকে চালাতে চায়! (পরের অংশ আগামীকাল)
আরও পড়ুন: বিজ্ঞান মেলা ২০২২