মহান শিক্ষক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রজ্ঞার দীপ্তিতে এক অনন্য জীবনের আলেখ্য, আদর্শ শিক্ষকের অলোকসামান্য আলোকবর্তিকার কথা তুলে ধরছেন রাজ্য সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের জয়েন্ট ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ড. পার্থ কর্মকার|
একাধারে দার্শনিক, অধ্যাপক ও দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদ শান্ত মানুষটি ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। তিনি হলেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। জন্মগ্রহণ করেন ৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ তামিলনাডুর তিরুট্টানিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে।
১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’। বিশ্বে তিনি অতি-জনপ্রিয় দার্শনিক-অধ্যাপক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁকে ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-তে ভারতরত্ন সম্মান পান। প্রথম জীবনে তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন (১৯১৮) ও বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সে-সময়েই তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ লেখেন। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য রেন অফ রিলিজিয়ন ইন কনটেমপোরারি ফিলোজফি’ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ও দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার কয়েক দিন পরে তাঁর কয়েক জন ছাত্র ও অধ্যাপক বন্ধুবান্ধব ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি তাঁর জন্মদিন পালন করার অনুমতি চাইলেন। রাধাকৃষ্ণন তাঁদের বলেছিলেন, ‘‘Instead of celebrating my birthday, it would be my proud privilege if September 5 is observed as Teachers’ Day’’। অর্থাৎ, ‘‘আমার জন্মদিন পৃথক ভাবে পালন না করে দিনটি যদি দেশের সমস্ত শিক্ষকদের উদ্দেশে পালন করা হয়, তা হলে আমি গর্বিত হব।’’ একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন— ‘তবু সর্বোপরি আমি এক জন শিক্ষক। মনেপ্রাণে, আমার বিশ্বাসে, আমার কর্মে আমি সে-কথা কখনও ভুলিনি। আমার কাছে ছাত্ররাই পৃথিবীর সবথকে প্রিয়। আমি তাদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসি।’ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন সকল শিক্ষককেই চিরকালীন এই নির্দেশিকাটি মানতে অনুরোধ করেছন— “Respect for teacher cannot be ordered ; it must be earned” এই মহান দার্শনিক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অতীন্দ্রিয়বাদের মূল সত্য, সেবা ধর্ম, অন্তর্দৃষ্টি এবং মানুষকে ভালবাসার প্রয়োজনীয়তার কথা তরুণ মনে এবং কোমল অন্তঃকরণে একবার পরিষ্কারভাবে জাগিয়ে দেওয়া বা গেঁথে দেওয়া যায়, তা হলে পরবর্তী জীবনে কোনও প্রলোভনই তাদের অধর্মের দিকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না।
এক জন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই শিক্ষক যে পড়াশোনার ক্ষেত্রেই হতে হবে, তা নয়। তিনি থাকতে পারেন জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রেই। তিনি যে পড়ুয়াকে শেখাবেন, তাই নয়। তিনি তাকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেবেন, ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেবেন, সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেবেন। তিনি তাকে শুধু সফল নয়, একজন ভাল মানুষ হতে শেখাবেন। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘শুধু বিবেকানন্দের নাম-গান করলেই চলবে না। তিনি হৃদয়বান, আত্মবিশ্বাসী এবং নিঃস্বার্থপর মানুষ তৈরির শিক্ষা দিয়েছেন, তা আমাদের সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। এই পুণ্যভূমিতে আমাদের যোগ্য নাগরিক হতে হবে। আমাদের সেই লক্ষ্যে এগোতে হবে। কেননা, স্বামীজি বলেছেন, This life is short, the vanities of the world are transient, but they alone live who live for others, the rest are more dead than alive.” আর এ কাজে শিক্ষকেরাই শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, “Teachers should be the best minds in the Society”।
শিক্ষক সমাজকে বুঝতে হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা অনন্ত শক্তি লুকিয়ে আছে। তাদের উচিত সেই শক্তি উপলব্ধি করা এবং ইতিবাচক বাতাবরণের মধ্যে তার যথার্থ বিকাশ ঘটানো। ১৯৩১ সালে ২৬ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা সভায় ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রগতিবাদী, মানবতাবাদী, অধ্যাত্মচেতনাসম্পন্ন এক অসাধারণ শিক্ষক বলে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তিনি মনে করতেন শিক্ষার্থীদের আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে। কারণ তাঁর লেখার মধ্যে এমন একটা ভালবাসা আছে, যার আবেদন চিরন্তন, সার্বজনীন। শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন আত্মবিশ্বাস, নিঃস্বার্থপরতা ও হৃদয়বত্তার বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মানসিক কাঠামো তৈরি করতে পারেন শিক্ষক।
তাঁর নামাঙ্কিত স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের (১৯৪৮-’৪৯) জন্য তিনি যে পনেরোটি প্রধান সুপারিশ করেছিলেন, তার প্রথমটিই ছিল ‘শিক্ষার লক্ষ্য’ বিষয়ক। এর অধীনে তিনি যে দশটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন যার আবার সর্বপ্রথমটিই হল “to teach that life has a meaning” শীর্ষক। শিক্ষার সঙ্গে জীবনের যোগ তাঁর উপলব্ধিতে এভাবেই একাত্ম হয়ে উঠেছিল।
এই মহান শিক্ষক তাঁর আচার-আচরণে ও সহজ-সরল জীবনযাপনের দ্বারা ছাত্রদের সামনে চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। আজকের দিনে সকল শিক্ষক সমাজের কাছে তাঁকে অনুসরণ করার আবেদন রাখব।
রাধাকৃষ্ণনের বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা
ড. রাধাকৃষ্ণন তাঁর ‘অক্সফোর্ড সিরিজ অফ এসেজ’ (১৯৫৪ সালে প্রকাশিত) -এ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা’র কথা তুলে ধরেছিলেন। সে-কাহিনিরই পুনর্কথনে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপক
ড. রথীন্দ্রনাথ বসু
তিনি তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্টার্ন রিলিজিয়ন এবং এথিকসের অধ্যাপক। সে-সময় তিনি রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করছিলেন। সম্ভবত তাঁর সেই ব্যাখ্যার মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ছিল। একজন উজ্জ্বল মেধাবী ছাত্র তাই অত্যন্ত বিনম্রভাবে ড. রাধাকৃষ্ণনকে বলেন যে, তিনি তাঁর আলোচ্য বিষয়ের কিছু অংশ অনিচ্ছাকৃত ভাবে উপেক্ষা করেছেন।
ড. রাধাকৃষ্ণন ভীষণ খুশি হলেন যে তাঁর ভুল তাঁর নিজের ছাত্রই সংশোধন করেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই ছাত্রটিকে যে বিষয়গুলি তিনি উপেক্ষা করেছিলেন সেগুলি ব্যক্ত করতে বললেন। ছাত্রটি রাধাকৃষ্ণনের সামনেই সেই উপেক্ষিত অংশগুলি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন। ছাত্রটির যথাযথ ব্যাখ্যায় তিনি এতটাই খুশি হলেন যে ঐ ছাত্রটি যাতে পরবর্তী দর্শনের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে পারেন তার জন্য তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকে অনুরোধ করেন। এটাই হল ইনটেলেকচুয়াল হিউমিলিটি (বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা)।
ড. রাধাকৃষ্ণনের জায়গায় অন্য কেউ হলে তিনি মনে করতেন যে ওই ছাত্রটি শিক্ষকের মর্যাদাহানি করেছেন এবং সেজন্য ছাত্রটির প্রতি মনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করতেন। রাধাকৃষ্ণন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন বলেই সে-কাজ করেননি। বুদ্ধিবৃত্তিক নম্রতা বা ইনটেলেকচুয়াল হিউমিলিটির এরকম উদাহরণ আজকের দিনে বিরল।