শিক্ষকদের শিক্ষক

আগামীকাল শিক্ষক দিবস। এই উপলক্ষ্যে নিজেদের শিক্ষকদের স্মরণ করলেন এই সময়ের চারজন বিশিষ্ট শিক্ষক।

Must read

সুকুমারীর চরণে
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
হ্যাঁ, চোখ তো আমারও কিছু কম নেই, তা নাহলে প্রিয়ত্বের সম্বন্ধও আমার সেইসব মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গেই ঘটেছে যাঁরা খাপছাড়া, বেশি বকেন, সিলেবাস শেষ করতে পারেন না এবং পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য নিতান্তই অনুপযোগী। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমাদের ভারতীয় ইতিহাসের প্রথমাংশ পড়াতেন দিলীপ বিশ্বাস। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের যে অংশ শশাঙ্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সেখানে দিলীপ বিশ্বাসমশাই কোনও বছরেই ষোড়শ মহাজনপদের পরের ভাগ পর্যন্ত যেতে পারতেন না সারা বছরে। কাশী, মগধ, অবন্তীর State formation করার আগেই বোর্ডে ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট, চাইনিজ স্ক্রিপ্ট, সলোসিলেবিক ল্যাঙ্গুয়েজ কীভাবে অর্থ তৈরি করে এই আলোচনার জেরে বছরের শেষে হর্ষবর্ধন-শশাঙ্করা অনাথ হয়ে যেতেন।
সংস্কৃত কলেজে ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায় পাণিনি ব্যাকরণ পড়াতেন— ব্যাকরণ যে অমন আঙ্কিক স্বন্দতায় পড়ানো যায়, তা এই মানুষটিকে না দেখলে বুঝতাম না। বহিরঙ্গে ভীষণ রকমের বদরাগী এই মানুষটি যে কতখানি কুসুম-কোমল মনের অধিকারী, সেটা বুঝেছিলাম— একবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন কলেজে যেতে পারিনি, ভবানীবাবু আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে প্রিয় ছাত্রের খোঁজ নেবার জন্য বাড়িতে চলে এসেছিলেন। ভবানীবাবুর সংস্কৃত শ্লোকোচ্চারণ এতটাই নিখুঁত ছিল যে, সংস্কৃতের অচেনা শব্দেরও যেন অর্থবোধ হয়ে যেত।
আমার আর অন্য গুরুর মধ্যে অন্তত দু’জন আমার বিদ্যা-ব্যবহারে একদিকে পরম সন্তুষ্ট ছিলেন, অপরদিকে একজন ছিলেন অসন্তুষ্ট। তিনি তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য। তাঁর কথা বলাই যাবে না। তিনি আমার প্রিয়তম গুরু (Teacher’s day)। এঁদের মধ্যে প্রথম হলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য, যাঁকে পরম সমাদরে মহাভারতের দ্রৌপদীর বিশেষণে ভূষিত করে একবার বলেছিলাম, আপনি প্রায় কাশ্মীরি তুরঙ্গমীর মতো এক মহিলা। কাশ্মীরীব তুরঙ্গমী। সুকুমারীদি তাতে নারীসুলভ ক্রোধাপাঙ্গীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে আমি ভাবলাম, বয়সোচিত ধৃষ্টতা হয়েছে বুঝি। আমি বললাম, পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে মুখের তুলনা দিলে তার সাধারণ ধর্মটা চাঁদের গোলাকারের মধ্যে থাকে না, তাতে মুখখানাকেও গোল বলে ভাবতে হয়। আমিও তাই আপনাকে দ্রৌপদীর চারিত্র দৃষ্টিতে দেখিনি। দেখুন আজও আপনার সময় নেই। আপনি সারাদিন কীভাবে দাপিয়ে বেড়ান। এই ইউনিভার্সিটির ক্লাস, এই সেমিনার, এই Women’s emancipation, এই foreign scholar আসবেন, বাড়িতে, এই লেখা জমা দিতে হবে, এই জাতি-বিদ্বেষ নিয়ে বক্তৃতা, এই পিএইচডি স্কলার— সারা দিন ধরে এই দাপিয়ে চলাটাই আমার কাছে কাশ্মীরি তুরঙ্গমীর মতো।
সুকুমারীদি বলেছিলেন— তাই বলো। আমি বলেছিলাম— এই তুরঙ্গমী বৃত্তির সঙ্গে দ্রৌপদীর আরেকটি বিশেষণ দিলেই তো আর উপমার অঙ্গুলি-সঙ্কেতে গৌণবস্তুকে মুখ্য করে তুলতে হয় না। কেন না সেটা নিতান্তই সরাসরি— পণ্ডিতা চ মনস্বিনী। সুকুমারীদির এই মনস্বিতার ফল বুঝতে হয়েছে আমাকে। একটা কিছু লিখলে পরে সুকুমারীদি খালি বলতেন— অমুকের লেখাটা পড়ে নিয়েছ তো, আরে এ বিষয়ে ‘মির্চা’র লেখাটা দ্যাখো; দ্যাখো ‘খন্ডা’র লেখাটা। আমি বললাম, কে মির্চা? সে খন্ডা?

 

সুকুমারী ভট্টাচার্য

সুকুমারীদি বললেন— মিথ নিয়ে কাজ করবে, মহাকাব্য নিয়ে কাজ করবে, অথচ মির্চার লেখা পড়বো না, খন্ডার লেখা Wendy Doniger, এবং O’Flaherty, Dimock, Milton Singer কিছুই পড়বে না। অথচ লেখা আরম্ভ হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এই যে খন্ডা, মির্চা এইসব অর্ধনাম উচ্চারণ করছেন, হ্যাঁ তাঁদের সঙ্গে বহুল পরিচয়বশেই করছেন এটা, তা এই …
সুকুমারীদি কথা পড়তে দিলেন না। বললেন— মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ পড়ার সময় আহা-বাহা করে কতই না কষ্ট পেয়েছ। তো আমরা মৈত্রেয়ী দেবীকে চিনি রবীন্দ্রনাথের নাম জুড়ে। কিন্তু মির্চা! এই বুড়ো বয়সেও তাঁকে দেখে এসেছি সেদিন, চোখে ভাল দেখতে পান না। কিন্তু বিদ্যাচর্চায় এখনও তাঁর নিরলস জীবন। সবচেয়ে বড় কথা, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ছাত্র। তাঁর বিদ্যাবৃত্ত সম্পূর্ণ হবার পর তাঁর ধিক্কার জুটল গুরুর কাছে, গুরুকন্যার জন্য। কিন্তু ভারতীয় ঋষিকুলের অন্তেবাসী ছাত্রের মতো মির্চা এলিয়াদে (Mircea Eliade) তাঁর থিসিসটা প্রকাশ করলেন ১৯৫৮ সালে Paris থেকে। তাঁর বইটার নাম Yoga: Immortality and Freedom. কিন্তু তাঁর বইয়ের শুরুতে যে তিনজন মানুষের নাম তিনি স্মরণ করলেন উৎসর্গের প্রক্রিয়ায়— তাঁদের মধ্যে প্রথম হলেন তাঁর ভারতবর্ষে থাকার অর্থসহায়ক কাশিমবাজার রাজবাড়ির মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। আর তার পরেই— my guru, Professor Surendranath Dasgupta, তৎকালীন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, আর তৃতীয়জন মির্চার আগের একজন teacherr : Nae Ionescu.
এই তো মির্চার শুরু। তারপর তো Comparative Religion-এর ওপর তাঁর বিখ্যাত সব বই— সেগুলো একটু-আধটু না দেখেই তুমি লিখতে আরম্ভ করে দিলে। এত রাগের কথা শুনলাম সুকুমারীদির, তাতে উপকার হল একটাই। আমার পড়াশুনোর পরিধিটা শুধুমাত্র ভারতীয় ভাবনার কূপমণ্ডূকতা অতিক্রম করল। এবারে খুশির কথাটা বলি— ‘আনন্দ’ থেকে আমার দ্বিতীয় বইটি বেরোনোর পর আমি সুকুমারীদিকে আমার বইটা দিয়ে এলাম না অভিমানবশত। কিন্তু সুকুমারী নিজে ফোন করে বললেন, আমি অন্যের মুখে ঝাল খেয়ে তোমার বইয়ের প্রশংসা করব, নাকি বইটা একদিন দিয়ে যাবে আমাকে, আমি না হয়, পড়েই ফেরত দেব।
আমি সেইদিনই মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণের একখানি কপি নিয়ে সুকুমারীর চরণে আনত হলাম। উনি কারও প্রণাম নিতেন না— কিন্তু পরম সন্তোষ জানিয়ে বললেন, বইটা অন্যের কাছ থেকে নিয়ে আমি পড়ে ফেলেছি। আমার ছাত্রের বইখানা তাই আত্মসাৎ করার অধিকার জাহির করলাম।

আমার জীবনের
শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য

আমি হিন্দু স্কুলে পড়তাম। নিয়মানুবর্তিতা বলতে যা বোঝায় তা হিন্দু স্কুলে ছিল। আমাদের বন্ধু বান্ধবরাও তখন সব উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পড়তে আসতেন। আমাদের ছাত্রজীবনের সেই সময় সত্যেনবাবু বলে একজন মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনি আসলে একজন বায়োলজির শিক্ষক। কিন্তু তিনি খুব সুন্দর মুখে মুখে কবিতা লিখতে পারতেন। অসাধারণ কথাবার্তা বলতেন। তাই তাঁর প্রতি প্রতিটি ছাত্রের একটা আকর্ষণবোধ ছিল। অসম্ভব শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা ছিল।
প্রতিটি ছাত্রের নাম মুখস্থ। আমরা সবচেয়ে বেশি ওঁর সান্নিধ্য পেয়েছি যখন গরমের ছুটি উপলক্ষে আমরা খুব সুন্দর করে মাস্টার মশাইদের (Teacher’s Day) ফেয়ার ওয়েল দিতাম। আমি তখন ক্লাস ফোর কী ফাইভ। প্রত্যেকটি ক্লাস সুন্দর করে সাজানোর প্রতিযোগিতা চলত। সত্যেনবাবু আসতেন আর আমাদের প্রত্যেকের নাম দিয়ে সুন্দর সুন্দর ছড়া লিখে দিতেন। উনি যখন আমাদের কাঁধে হাত রেখে কথা বলতেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখে জল চলে আসত। ওঁর বড় কালো দাড়ি ছিল। সুন্দর গায়ের রঙ। হালকা করে কথা বলতেন। কখনও জোরে কথা বলতেন না। সেই যে সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম তা জীবনে কখনও ভুলিনি।
আমার মনে আছে আমি তখন আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে গেছি। স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেছে। একদিন কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সত্যেনবাবুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। সেই মুখোমুখি দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কেমন আছি। কী করছি। আর আমার ঘাড়ে হাত রেখে কী সুন্দর ভাবে তাকালেন! সেই যে আশীর্বাদ এবং স্নেহমাখা অন্তরভেদী দৃষ্টি তা ভোলার নয়। আমি তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
আজও যে আমার দাড়ি রাখার বাসনা, সেটা কিন্তু ওঁকে দেখেই। সেই যে ছেলে বয়সে দেখেছিলাম, আমারও মনে হত যদি আমারও এরকম গাল ভর্তি দাড়ি থাকত! এরপর যখন দাড়ি গজাল, তারপর থেকে এ-পর্যন্ত আর কোনওদিন কাটিনি। সেই দাড়ি একই রকম আছে শুধু কালো নেই সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার জীবনে একজন আদর্শ শিক্ষকের (Teacher’s Day) যে প্রভাব, তা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাঁকে এখনও দেখতে পাই। তাঁর যে অসাধারণ ছড়া লেখার ক্ষমতা এবং বায়োলজি ব্যাতিরেকে বাংলা, ইতিহাস এসব বিষয়ে চর্চা বা জ্ঞান, তা আমাদের সত্যি সমৃদ্ধ করেছে। তাই আজও তাঁদের স্মরণ করি। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সত্যেন বন্দোপাধ্যায়কে।

আরও পড়ুন: ভবিষ্যতে শিক্ষকের ব্যাটন গুগল গুরুর হাতে

কত আলোর সঙ্গ
অভীক মজুমদার

শিখতে শিখতেই জীবন কাটে। অল্প বয়স থেকেই আমার শিক্ষকভাগ্য অতুলনীয়। আমার বাবা প্রয়াত আশিস মজুমদার ছিলেন বাংলা ভাষা সাহিত্যের খুব জনপ্রিয় শিক্ষক (Teacher’s Day)। তাঁর কাছে আমার বুনিয়াদ। সাহিত্যের, বিশেষত কবিতাকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। হিন্দু স্কুলে অপূর্ব বিশ্বাস। তিনিও প্রয়াত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে খুলে গেল কত জানালা-দরজা। শিক্ষকদের (Teacher’s Day) কল্যাণে, তাঁদের পরিচর্যায়। আমি সরাসরি শ্রেণিকক্ষের ছাত্র যাঁদের, তাঁরা একেকজন দিকপাল। অধ্যাপক পবিত্র সরকার, অধ্যাপক অলোক রায়, অধ্যাপক পিনাকেশ সরকার। শ্রেণিকক্ষের বাইরে হলেও অনিঃশেষ শিক্ষা পেয়েছি অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ, অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক স্বপন মজুমদার, অধ্যাপক নবনীতা দেবসেন, আর অবশ্যই অধ্যাপক শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও আছেন আমার শিক্ষকেরা (Teacher’s Day)। বিশ্ব-রাজনীতি আর আগ্নেয় স্বপ্নসন্ধান বিষয়ে দিকনির্দেশ পেয়েছি নবারুণ ভট্টাচার্যের কাছে। জীবনঋজুতাকে সাহিত্যপাঠে কীভাবে মিশিয়ে নিতে হয় সে-বিষয়ে জেনেছি শাঁওলী মিত্রের কাছে। আজও যেকোনও সময়ে ছুটে যাই কবি জয় গোস্বামীর কাছে। শুনি কবিতা নিয়ে, সৌরলোক নিয়ে, বিশ্বচরাচর নিয়ে তাঁর অত্যাশ্চর্য বিদ্যুৎগর্ভ পর্যবেক্ষণ। এই আচার্যদের পাশাপাশি আছে আমার বন্ধুরা, আমার অনুজেরা।

যিনি বা যাঁরা বিশ্বাস করেন ক্লাসে শিক্ষক (Teacher’s Day) পড়ান আর ছাত্ররা শেখে— আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। এ-ও এক দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। ক্লাসের থার্ড বেঞ্চ বা ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে ভেসে আসে এমন প্রশ্ন বা উত্তর যা আমাকে শেখায়। বলতে কোনও লজ্জা নেই, আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আজও নতুন অনেক ভাবনা শিখি। গান, বিশেষত লোকায়ত গান এবং লোকায়ত ভুবন বিষয়ে অপরিসীম শিক্ষা গ্রহণ করেছি আমার প্রিয় ছাত্র কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। সে অনেকদিন হল আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।
এই জ্যোতিষ্কদের কেন্দ্রে আছেন আমার গুরু, আমার মুরশিদ, কবি শঙ্খ ঘোষ। সদ্য যৌবনে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলাম। আজও তাঁর স্মৃতি আমার আশ্রয়, আমার অবলম্বন। অনেক জ্বালিয়েছি, অনেক সময় নষ্ট করে দিয়েছি, অসার প্রশ্ন অগভীর লেখালেখি নিয়ে তাঁকে উত্ত্যক্ত করেছি। তিনি অপার স্নেহে এই অযোগ্য ছাত্রকে বোঝাবার নিরলস চেষ্ট করে গিয়েছেন। শুধু সাহিত্য নয়। শুধু কবিতা লেখার পথ-প্রকরণ বা রহস্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ নয়। শেখাবার চেষ্টা করেছেন জীবনবোধ, বিশ্বাসের দার্ঢ্য, স্বপ্নের পরিমিতি। আত্মপ্রতিভায় মুগ্ধ না থেকে পরিশ্রমের প্রতি দায়বদ্ধ হতে। পরিণাম নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে সংকল্পে সৎ থাকতে। জনসমাজের জন্য ব্যক্তি হিসেবে কাজ করতে। মানুষকে সম্মান করতে। ভালবাসা থেকে বিচ্যুত না হতে। শিখতে পেরেছি কি?

শঙ্খ ঘোষ

এমন অনেক আলোকরশ্মির বর্ণময়তায় আমার জীবন ধন্য হয়েছে। ‘মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে…’ আমার প্রতিদিনের, প্রতি প্রহরের, প্রতি মুহূর্তের বাঁচায় ছায়া ফেলে যান আমার আচার্যরা, আমার গুরু। রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বললে অনেকে অপছন্দ করেন। আমি সেই মতের লোক নই। ওকথা মানি না। সংগীত ঘরানার পরম্পরায়, বাউল-ফকির-দরবেশ-কর্তাভজা পরম্পরায় সে অতি পবিত্র শব্দ। তিনি হলেন গুরুর গুরু। তিনিও শেখান, অন্তরীক্ষের মতো।

তাঁর ছিল
অসাধারণ শিক্ষণশৈলী
ড. গৌতম পাল

১৯৬২ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ৫ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষকদিবস’ উদযাপন করা হয় ভারতে। উদ্দেশ্য, শিক্ষকদের সম্মাননার মাধ্যমে বিশিষ্ট অধ্যাপক, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ এবং স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনকে স্মরণ করা। উল্লেখ্য, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর (Teacher’s Day) তামিলনাড়ুর তিরুত্তানিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (ড. রাধাকৃষ্ণন ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল চেন্নাইয়ে পরলোকগত হন)।
প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত আমি বহু বিশিষ্ট শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি। তাঁরা বিভিন্নভাবে আমার জ্ঞানকে পুষ্ট করেছেন। আজ পর্যন্ত আমার শিক্ষা সম্বন্ধীয় অর্জিত জ্ঞানের আহরণে এইসব প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকদের অবদান আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু আমার জীবনের অভিমুখ তৈরি করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি দায়ী এবং যাঁকে দেখে আমি আমার শিক্ষাগত গন্তব্য স্থির করেছিলাম, ২০২২-এর শিক্ষকদিবসে (Teacher’s Day) তাঁর কথা স্মৃতিচারণ করব। তিনি হলেন আমার হাইস্কুলের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সদ্য পরলোকগত অনিলকুমার প্রধান মহাশয়। তিনিই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাঁর মহান আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করার জন্য তাঁর জীবন ও অসাধারণ শিক্ষণশৈলী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম।
আমি মেদিনীপুর জেলার (অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর) অন্তর্গত কাঁথি মহকুমার রামনগর রাও হাইস্কুলের ছাত্র। কাঁথি থেকে দিঘাগামী সড়কের রামনগর শহরের সন্নিকটে (শঙ্করপুর যাওয়ার রাস্তা যেখানে শুরু হয়েছে) রাও হাইস্কুল অবস্থিত। এটি রামনগর থানার সবচেয়ে প্রাচীন ও নামী স্কুল। এই স্কুলেই আমি ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পড়েছি। শ্রদ্ধেয় অনিল প্রধান স্যারকে আমরা পেয়েছি ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত। তিনি আমাদের জীবনবিজ্ঞান পড়াতেন। তাঁর সময়ানুবর্তিতা, জীবনচর্যা ও শিক্ষণশৈলী ছিল অনুকরণযোগ্য।

স্যার ছিলেন কলকাতার সিটি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞানের অনার্স স্নাতক। তিনি ফুলহাতা বুশ-শার্ট ও ধুতি পরতেন। যদিও শার্টের হাতাটি কনুই-এর উপর পর্যন্ত ভাঁজ করে গোটানো থাকত সবসময়। পায়ে থাকত চপ্পল। ভ্যান রিকশায় করে রামনগর হয়ে গ্রাম থেকে স্কুলে আসতেন। নিয়মানুবর্তিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্কুল শুরু হত সকাল ১০টায়। তিনি সোমবার থেকে শনিবার প্রত্যেকদিন পৌনে দশটার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতেন। প্রতিটি ক্লাসে ঢুকতেন নির্ধারিত সঠিক সময়ে। কখনওই তাঁকে ক্লাসে দেরিতে ঢুকতে দেখিনি। স্কুলে বা ক্লাসে স্যারের অনুপস্থিতির স্মৃতি প্রায় নেই বললেন চলে।

শিক্ষক (Teacher’s Day) হিসাবে স্যার ছিলেন অসাধারণ। জীবনবিজ্ঞানের বিষয়জ্ঞানে ও ক্লাসে পড়ানোর দক্ষতায় স্যার ছিলেন বিশিষ্ট ও অনন্য। ক্লাসে তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে চকের মাধ্যমে বিষয়ের কেন্দ্রীয় বা মুখ্য পয়েন্টগুলি লিখে লিখে পড়াতেন। হস্তাক্ষর ছিল ছাপার অক্ষরের মতো। আমরা যেহেতু বাংলা মাধ্যমের ছাত্র, তাই বিষয়বস্তুর বাংলা পরিভাষার সঙ্গে ইংরেজি প্রতিশব্দও পাশাপাশি লিখতেন যাতে আমাদের উচ্চশিক্ষায় সুবিধা হয়। তাঁর আরেকটি মহান গুণ ছিল— ছবি আঁকার দক্ষতা। বোঝানোর জন্য নিমেষেই সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন। তাঁর পড়ানোর পরে আমাদের পুনরায় বই পড়ার প্রয়োজন পড়ত না। তাঁর ছিল অসাধারণ শিক্ষণশৈলী যা আমার স্মৃতিতে চির-উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। প্রায় বছর তিনেক পূর্বে প্রায় ৯০ বছরের কাছাকাছি বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
আমি শিক্ষক হিসাবে যতটুকু সম্মান পেয়েছি তা অনেকটাই স্বর্গীয় অনিল প্রধান স্যারের সৌজন্যে। কারণ ক্লাসে আমার পড়ানোর স্টাইল স্যারের পড়ানোর স্টাইলকে অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষায় আমার বিষয় অভিমুখীকরণ ঘটেছে স্যারকে দেখেই। সঙ্কটে নেতৃত্ব প্রদান ও ভবিষ্যৎ-এর পুনর্নির্মাণে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসের পিছনে স্যারের অবদান অনেকটাই রয়েছে। শিক্ষকদিবসে মহাপ্রাণ স্বর্গীয় অনিল প্রধান স্যারকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

Latest article