২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকী। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের হিসাব মোতাবেক এই পর্বে জিডিপির (GDP) বৃদ্ধি ১৩.৫ শতাংশ। এর আগে এই বৃদ্ধির হার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ছিল ১৬.২ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপি (GDP) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রকৃত বৃদ্ধির হার আনুমানিক বৃদ্ধির হারের তুলনায় ২.৭ শতাংশ কম।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমান পরবর্তী ত্রৈমাসিকীগুলিতে যা, তার তুলনায় প্রকৃত বৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ (জুলাই–সেপ্টেম্বর, ২০২২), ৪.১ শতাংশ (অক্টেবর-ডিসেম্বর, ২০২২) এবং ৪ শতাংশ (জানুয়ারি-মার্চ, ২০২৩) কম হবে বলেই আন্দাজ করছে তথ্যাভিজ্ঞমহল। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস বা এনএসও যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তদনুসারে অনুমিত হচ্ছে যে বার্ষিক জিডিপির (GDP) বৃদ্ধি এই আর্থিক বর্ষে ৬.৭ শতাংশ হবে।
২০১৯-’২০-তে কোভিড অতিমারির আগের পর্যায়ে প্রকৃত জিডিপি ছিল ৩৬.৯ লক্ষ কোটি টাকা। সেটাকে মাপকাঠি ধরলে বর্তমান আর্থিক বর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে মোটে ৩.৮ শতাংশে।
এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। ভারতীয় অর্থনীতির স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ। সেই অবস্থায় বর্তমান অর্থনীতিক স্বাস্থ্য নেই। ২০২২-’২৩-এ ৭ শতাংশ বৃদ্ধির হারে পৌঁছাতে হলে এবছরের তৃতীয় ও চতুর্থ ত্রৈমাসিকীতে জিডিপি-র বৃদ্ধি অন্তত ৫ শতাংশ হতেই হবে।
কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য মোদি সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
১৬০ কোটি মানুষের দেশ আমাদের। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ভারতবাসীর ঠিকানা শহারঞ্চল। বাদবাকি বিশ্বের দিকে তাকালে দেখব মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের দুভাগ মানুষ শহরে বাস করবে ২০৫০ নাগাদ। রাষ্ট্রসংঘের দেওয়া তথ্য বলছে ভারতীয় নাগরিকদের গড় বয়স ২০৫০-এ বর্তমানের তুলনায় ১০ বছর বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ বছর হবে। এর মানে একটাই। জনসংখ্যার একটা বড়সড় অংশ কর্মক্ষম বয়সের বন্ধনীতে পৌঁছে যাবে ততদিনে, থাকবে ১৫-৬৫–র কোঠায়। এই বিষয়টা বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে কারণ, ২০৪০-এর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মক্ষম ব্যক্তিদের সংখ্যা কমতে থাকবে।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, জেনে রাখুন খুঁটিনাটি
এরকম একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন একটাই। মোদির ভারত কি এই বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনগণকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ করার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে পেরেছে? কারণ, এই পারা না-পারার ওপরেই নির্ভর করছে ভারতীয় অর্থনীতিতে জিডিপি (GDP) বৃদ্ধির হার উন্নত দেশ হয়ে ওঠার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে কি না?
শিক্ষার যে হাল দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমরা যে কর্মক্ষম জনগণকে পেতে চলেছি তাদের একটা বড় অংশ কার্যত নিরক্ষর বাবা-মায়ের সন্তানসন্ততি। মোদি সরকারের শিক্ষানীতি পাঠ্যক্রমের গৈরিকীরণ নিয়ে সদাব্যস্ত। ফলে, ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য ব্যর্থতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর। পুরো শিক্ষ্যব্যবস্থাই মুখস্থ, কোচিং ক্লাস আর পরীক্ষায় টুকলি, অর্থাৎ তিনটি ‘C’-এর ওপর (cramming, Coaching, Cheating) দাঁড়িয়ে।
যুক্তিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনায় মদত দেওয়ার পরিবর্তে মোদি সরকার ব্যস্ত এই তত্ত্ব প্রচারে যে বিনায়ক সাভারকর বুলবুলির ডানায় চেপে জেল থেকে পালাতেন। প্রযুক্তি চর্চায় উৎসাহ দানের পরিবর্তে মোদি সরকার ব্যস্ত এই কথাটা গেলাতে যে পাকিস্তানের ওপর স্ট্র্যাটেজিক হামলা ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ সফল করতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সেনাবিভাগের বৈমানিকরা মেঘের আড়ালকে আশ্রয় করে অগ্রসর হয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে পিথাগোরাসের উপপাদ্য। এরকম আবহে বৌদ্ধিক বিকাশ ব্যাহত হতে বাধ্য। আর সেটা হচ্ছে বলেই আমারা একুশ শতকের মাঝামাঝি পৌঁছে যে কর্মক্ষম জনশক্তি পাব সেটা আদতে কতটা উৎপাদনশীল তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণা পরিপুষ্ট হলে অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, মোদি সরকার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে বৈচিত্র্যকে হাতিয়ার করে বিদ্বেষ ছড়ানোর ও বিভাজন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এই বিভেদ বিভাজন অনৈক্য কখনও দেশের অর্থনীতিক বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অশান্তি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ফাটল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে বিঘ্নিত করে থাকে। এক্ষেত্রেও, মোদি সরকারের সৌজন্যে পরিস্থিতি বৃদ্ধি সহায়ক নয়। বরং, বিঘ্ন উৎপাদক। এই অবস্থা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সাহায্য করবে না। বরং তার বৃদ্ধিকেই ব্যাহত করবে। এই সহজ সত্য মোদি সরকার যে বুঝেও বুঝছে না, তার কারণ বিভেদ ওদের রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট দেয়। সেই ডিভিডেন্টের ডানায় ভর করেই মোদি সরকার ২০২৪-এ ভোটে সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দলীয় স্বপ্ন পূরণ করার তাগিদে জাতীয় অর্থনীতি অরাজকতার যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত আজ।
এ-সব ছাড়াও আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। আমরা যখন বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ করার কথা সামনে রেখে এগোনোর কথা ভাবছি বা স্বপ্ন দেখছি, তখন সেটা করছি মার্কিন ডলারের হিসাবকে বিবেচনায় রেখে। কিন্তু দেশে মুদ্রাস্ফীতির যে হার, ডলারের তুলনায় টাকার দামে পতনের যে ছবি দেখা যাচ্ছে তাতে স্বাভাবিকভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, টাকার অঙ্কে বৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত হার অর্জন করলেও ডলারের অঙ্কে বৃদ্ধির হার অধরা থেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
এই প্রতিবেশে স্রেফ বুলি আওড়ে ভারতকে কি উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে একই বন্ধনীতে ঠেলে দেওয়া সম্ভব?
মোদি-শাহর অন্ধ ভক্তবৃন্দ ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তরে বোধ করি কেউই ‘হ্যাঁ’ বলবেন না।