প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: সকালবেলায় শোবার ঘরের দরজায় খট-খট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায়। কবিতা দরজা খুলতেই দেখে চঞ্চল।
“কী রে? সাতসকালে কী মনে করে?”
“কাল তো বলছিলি কিছুই জোগাড় করতে পারলাম না, দ্যাখ আমি ঠিক নিয়ে এসেছি।”
এই একটা বিপদ ওকে নিয়ে। কিছু একটা মাথায় ঢুকে গেলে সেই কাজটা করবেই, আর সেটা যদি কবিতার হয় তো রক্ষে নেই। কয়েক দিনের ছুটিতে গ্রামে এসেছে। কবিতা এখন কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে মাস্টার্স করছে। কাল চঞ্চলকে নিয়ে গ্রামে পুরানো মূর্তির সন্ধানে বার হয়েছিল। একটা প্রোজেক্ট তৈরি করে জমা দিতে হবে। সেরকম কিছু জোগাড় না হওয়ায় আফসোস করছিল।
“তুই কী জোগাড় করেছিস শুনি?”
আরও পড়ুন-পোলিও কর্মীদের উপর হামলা, মৃত্যু ৪ পুলিশের
“এই যে।”
“এটা কোথায় পেয়েছিস?”
“হরে বাগদির মনসাথানে।”
“মানে? তুই কি ঠাকুরথান থেকে এটা চুরি করেছিস নাকি?”
কবিতার কথার উত্তর না দিয়ে চঞ্চল মিটিমিটি হাসতে থাকে। কবিতার মাথাটা গরম হয়ে যায়। বলে, “তুই এটা কোন আক্কেলে আনলি বলত! জানতে পারলে পুরো বাগদি সম্প্রদায় মেরে তোর চামড়া তুলে নেবে।”
চঞ্চল একটা ফিচেল হাসি দেয়। বলে, “আরে হরেকাকা বুড়ো মানুষ। বুঝতেই পারবে না।”
“সাধে কি তোকে সবাই বোকারাম বলে। আজ এটা দেখতে না পেলে হরে বাগদি তো বলে দেবে কাল তুই গিয়েছিলি। কী কুক্ষণে আমি যে তোকে ওসব বলতে গেলাম! এখন তোর জন্য দেখছি আমিও বিপদে পড়ব।” কবিতার উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে।
“সেরম হলে আমি ফিরিয়ে দিয়ে আসব। একটু দেখে তো নে। আসলে নিরামিষ ঠাকুর বলেই নিয়ে এলাম।”
আরও পড়ুন-দেখুন বই কিনুন বই
“নিরামিষ ঠাকুর! সে আবার কী কথা!”
“আমি বললাম, ‘কাকা এটা কী ঠাকুর গো?’ তো কাকা বলল ‘এটা দামোদর থেকে ঠাকুর্দা কুড়িয়ে এনেছিল রে। জানিস বাপ, এটা নিরামিষ ঠাকুর। মনসা পুজোয় পাঁঠা বলির সময় লতুন গামছে দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়।’ তাই তো তোর জন্য নিয়ে এলাম, যদি তোর কাজে লাগে, তা নয় তুই আমাকে বকছিস!”
চঞ্চলের কথায় এবার কবিতা মূর্তিটা ভাল করে দেখে। মুর্তিটা ছোট। তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে একটা লেন্স আর ব্রাশ বার করে। ব্রাশ দিয়ে মুর্তির গায়ের নোংরা আর সিঁদুরগুলো ঝাড়তে থাকে। খালি চোখে দেখার পর লেন্স দিয় বড়ো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। চঞ্চল অবাক হয়ে কবিতার কাজ-কারবার দেখতে থাকে।
আরও পড়ুন-পুজোর লেখালিখি
তাই তো এটা তো বুদ্ধমূর্তি মনে হচ্ছে! দীর্ঘদিন এটার গায়ে সিঁদুরের প্রলেপ পড়ে পড়ে আসল চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কবিতা ভাবে, এটা এখানে কী করে এল। বাঁকুড়া জেলায় জৈনমূর্তি পাওয়া গেলেও বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। আরও আশ্চর্য ওই লেখাপড়া না-জানা মানুষগুলো জানে এটা অহিংসার দেবতা। তাই ছাগবলির সময় গামছা ঢাকা দেয়। কী আশ্চর্য!
চঞ্চল অনেকক্ষণ ধরে কবিতার হাবভাব দেখতে থাকে। এই মূর্তিটা নিয়ে একটা গুরুতর ব্যাপার আছে বুঝতে পারে।
“কী রে থম মেরে গেলি?” চঞ্চল বলে।
“এই মূর্তিটা এখানে এল কীভাবে বলত চঞ্চল?”
“ওই যে বললাম, হরেকাকার ঠাকুর্দা নিয়ে এসেছে।”
“দূর পাগল! ওটা তো নদী থেকে কুড়িয়ে এনেছে, নদীতে এল কীভাবে আমি সেটা ভাবছি।”
আরও পড়ুন-শিকাগো জয়ের দিনলিপি
“নদীর বানে ভেসে এসেছে রে। এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে।”
এবার কবিতা সশব্দে হেসে ওঠে। বলে, “সত্যি! তুই সেই হাঁদারামই রয়ে গেলি। বাদ দে তুই এসব বুঝবি না।”
চঞ্চলের মুখটা করুণ হয়ে যায়। সত্যিই তো সে বুঝবে কী করে। সে তো আর কবিতার মতো অতো অতো লেখাপড়া করে নাই। টেনেটুনে একটা পাশও দিতে পারল না। ক্লাস নাইনে দু-দুবার ফেল করার পর ইস্কুল যাওয়া ছেড়ে দেয়। করুণ ভাবে বলে ওঠে, “আমি বুঝব না, না?”
চঞ্চলের মুখটা দেখে কবিতার মায়া হয়। ভাবে বুঝুক না বুঝুক যেটুকু সে নিজে বুঝেছে, তা বলতে দোষ কী।
“এটা কোনও ঠাকুর নয় চঞ্চল, এটা বুদ্ধমূর্তি। মূর্তিতে পালি ভাষায় একটা নাম খোদাই করা রয়েছে, সম্রাট উদয় ভদ্র। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪ সালে মগধের রাজা হন বিম্বিসার। ইনি ছিলেন হর্ষঙ্ক বংশের। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইনি মহাপদ্ম নামে পরিচিতি লাভ করেন। বিম্বিসারের ছেলে ছিলেন অজাতশত্রু । বাবাকে হত্যা করে তিনি রাজা হন। প্রথম জীবনে অজাতশত্রু ছিলেন শিবভক্ত। পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পাটলিপুত্র স্থাপন তাঁর অন্যতম কীর্তি। অজাতশত্রুর পুত্র উদয়ভানু পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করেন। এই মূর্তিটি উদয়ভানু তৈরি করান। একদিকে বৌদ্ধধর্মকে সম্মান জানানো, বাবার কীর্তিকে মহান করা আর নিজের নাম স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ-রকম মূর্তি তৈরি করেছিলেন বলে আমার মনে হচ্ছে।”
আরও পড়ুন-বাগুইআটি-কাণ্ড: পেশাদারি খুনিকেই ব্যবহার?
চঞ্চল অবাক হয়ে একমনে কবিতার কথা শুনছিল, বলে, “তুই কত জানিস কবিতা! একদিন তুই অনেক নাম করবি, আমাদের গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল করবি।”
এই সময় কবিতার মা আসে। চঞ্চল কবিতার মাকে খুব ভয় পায়। তাই টুক করে কেটে পড়ে।
কবিতা হাঁক পাড়ে, “আরে এটা নিয়ে যা, ওখানে রেখে আসবি। যাঃ চলে গেল!”
দুই
প্রোজেক্টটা কীভাবে করা যায় কবিতা ভাবতে থাকে। মোবাইলটা বেজে ওঠে, হাতে নিয়ে দেখে কুণাল।
“হ্যাঁ, বল?”
“প্রোজেক্ট হল? আমি তো নতুন কিছু আইডিয়া পাচ্ছি না রে কবিতা।”
“আমি আমার গ্রামের উপর একটা শুরু করব ভাবছি কিন্তু মুশকিল হল ব্যাপারটা রিলেট করতে পারছি না।”
“বিষয়টা আমাকে একটু খুলে বল, দেখি তোকে হেল্প করতে পারি কি না।”
আরও পড়ুন-ক্রীড়া দফতরের সাহায্য চায় পরিবার
কবিতা বুদ্ধমূর্তিটার কথা খুলে বলে। তার পর বলে, “এটা এখানে মানে আমাদের গ্রামে কীভাবে এল তা জানতে পারলে আমি প্রোজেক্টটা করতে পারতাম।”
“কী করতে চাস?” কুণাল জানতে চায়।
“পুষ্করনার সঙ্গে যে সেই সময় মগধ, পাটলিপুত্র এসব জায়গার যোগাযোগ ছিল তার উপরেই আমি প্রোজেক্টটা করতে পারতাম।”
“পুষ্করনা মানে তোদের গ্রাম পখন্নার উপর। আচ্ছা তুই এক কাজ কর ওটার একটা পিকাচার আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ কর।”
তিন
দুপুরের খাবার পর কবিতার আবার চিন্তাটা শুরু হয়। চঞ্চল মূর্তিটা নিয়ে গেল না, এখন এটা জানাজানি হলে কী যে হবে কে জানে। এটা ওকে দিয়ে আসতে বলতে হবে। তার তো আর মূর্তির দরকার নেই, ছবি তুলে রেখেছে। কুণালকে পাঠিয়েও দিয়েছে। চঞ্চলের বোকামিকে সে দোষ দিচ্ছে, কিন্তু এটাও তো ঠিক ওর জন্য এই প্রোজেক্টের আইডিয়াটা মাথায় এসেছে।
আরও পড়ুন-ফুটবলার সমস্যায় নতুন জট, আইএফএ-কে ফের চিঠি মোহনবাগানের
সবে একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। মোবাইলটা বাজতেই উঠে পড়ে। কুণালের কল।
“হ্যাঁ কুণাল বল?”
“শোন, তোর পাঠানো ছবির মতো বুদ্ধমূর্তি আরও কিছু পাওয়া গেছে পাটনা থেকে। সমুদ্রগুপ্তের সভা কবি হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে বৈষ্ণবধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম নিয়ে বেশ কিছু বিষয় জানা যায়।”
“তা তো বুঝলাম, কিন্তু তার সঙ্গে এই মূর্তিটা এখানে আসার সম্পর্ক কী তা তো বুঝতে পারছি না।”
“সমুদ্রগুপ্ত সারা বাংলা জয় করে নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন পুষ্করনাও জয় করেন।”
“আমি এটা জানি, কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তো বৈষ্ণব ছিলেন। রাজ্য জয়ের সময় উনি তো আর বুদ্ধমূর্তি আনবেন না!” কবিতা কুণালকে বলে।
“উনি না আনলেও ওঁর সঙ্গের লোকজন তো আনতে পারে। বসুবন্ধুর নাম শুনেছিস?”
আরও পড়ুন-বিরাটের স্কিল আমার থেকেও বেশি : সৌরভ
“না রে, শুনিনি। ওঁর সঙ্গে এ-সবের কী সম্পর্ক?”
“বসুবন্ধু ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের মন্ত্রিসভার সদস্য। উনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মী। সমুদ্রগুপ্ত নিজে বৈষ্ণব হলেও সব ধর্মকে মর্যাদা দিতেন। রাজ্য জয়ের সময় বসুবন্ধু মারফত মূর্তিটা তোদের ওখানে গেছে এমনটা কি খুব অস্বাভাবিক?”
“বাঃ দারুণ আইডিয়া দিয়েছিস! এভাবে প্রোজেক্টটা রেডি করি, তার পর স্যার কী বলেন দেখি। থ্যাঙ্ক ইউ রে, প্লিজ তুই ডিটেলটা আমাকে একটু পাঠিয়ে দে, আমি সাজিয়ে নিচ্ছি।”
এত সহজে যে প্রোজেক্টটা করে উঠতে পারবে কবিতা কল্পনাও করতে পারেনি। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। এখন ভালয় ভালয় মূর্তির ব্যাপারটা মিটে গেলে হয়।
চার
বিকালে চঞ্চল হাজির।
আরও পড়ুন-বাম আমলের দাবি মেটালেন নিজের তহবিলের ৫ কোটি টাকায়
“সেই যে গেলি আর পাত্তা নেই, এতক্ষণে তোর আসার সময় হল?” কবিতা কিছুটা রেগে বলে।
চঞ্চল ভয়ে ভয়ে বলে, “দে ঠাকুরটা, রেখে আসি।”
চঞ্চল বাইরে যেতেই কবিতার কানে চিৎকার-চেঁচামেচিটা কানে আসে। বাইরে এসে দেখে বাগদি পাড়ার লোকজন চঞ্চলকে ঘিরে ধরেছে। ওদের কথাবার্তা এমন যেন ওরা বমাল সমেত চোর ধরেছে। কেউ বলছে, বেঁধে নিয়ে চল, ষোল আনায় বিচার হবে, কেউ-বা জরিমানা করার কথা বলছে। থানা-পুলিশের কথাও বলছে কেউ কেউ। চঞ্চলকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া চলছে, কবিতার মনে হয় এরপর হয়তো চড়-থাপ্পড়ও পড়তে পারে।
কবিতা চঞ্চল আর জনতার মাঝে গিয়ে বলতে যায়, এটা চুরি নয়, কেন চঞ্চল মূর্তিটা নিয়ে এসেছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে যায়। সবে কথা শুরু করতে যাবে, সেই সময় একটা ইটের টুকরো কবিতার কপালে লাগে। “উঃ মাগো” বলে কবিতা বসে পড়ে। কপাল বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে। হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় সামনের সারির বয়স্করা হতচকিত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন-৫ দিন নিখোঁজ টাকির দুই ছাত্রী
এতক্ষণ চঞ্চল নির্বিকার ছিল। কবিতার কপালে রক্ত দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। সামনেই হরে বাগদিকে দেখে বলে ওঠে, “কাকা, তুমি যে বলেছিলে এটা নিরামিষ ঠাকুর, তার সামনে রক্তপাত করলে? এই নাও তোমাদের ঠাকুর। আমার বিচার তোমরা কাল কোরো, আমি এখন কবিতার কপালটা কী হল দেখি।”
চঞ্চল কবিতার কপালটা চেপে ধরে। কবিতা চঞ্চলের চোখে গভীর উৎকণ্ঠা দেখতে পায়। এই মুহূর্তে চঞ্চলকেই তার নিরামিষ দেবতা মনে হয়।