প্রান্তিকা আর সৌমেনের বিয়েটা হয়েছিল একটি বিখ্যাত ম্যাট্রিমনির সাইট দেখে। সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্র পেয়ে আর কোনওদিক না দেখে সৌমেনের সাথে প্রান্তিকার বিয়েটা দিয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা-মা। বিয়ের সময় মোটা অঙ্কের নগদ-সহ গয়নাগাঁটি, আসবাবপত্র মেয়েকে দিয়েছিলেন তাঁরা। বরপক্ষকে এত যৌতুক দেওয়ার বিরোধিতা করেছিল প্রান্তিকা। কিন্তু প্রান্তিকার কোনও কথাই শোনেননি তার বাবা- মা। তাঁরা ভেবেছিলেন যৌতুক দিলে সৌমেনদের পরিবারের কাছে মেয়ের মানসম্মান বজায় থাকবে। কিন্তু বিয়ের পরে সৌমেনের পরিবার প্রান্তিকাকে সম্মান করা দূরে থাক, আরও যৌতুকের জন্য তার ওপর অত্যাচার করা শুরু করে। এবং শেষ অব্দি তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেও ফেলে।
আরও পড়ুন-বাঁশের তুমি বাঁশের আমি
কলকাতার বিখ্যাত বণিক পরিবারের পুত্রবধূ দেবযানী বণিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। দেবযানীকেও পণের জন্য তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেরে ফেলেছিল। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এদেরকে পণ্য হিসেবেই গণ্য করেছিল, কোনওদিন সম্মান দেয়নি।
আমাদের রিকশাস্ট্যান্ডের রবিদা একজন রিকশাচালক। বয়সটা ষাট ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, পেটের দায়ে এত বয়সেও রিকশা চালাচ্ছে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করে চোখে পড়ে একটি যুবক ওর সঙ্গে তুই-তোকারি করে কথা বলছে। দ্বিগুণ বয়সের কাউকে যে সম্মান দিতে হয় সেই শিক্ষা ছেলেটির ছিল না। তার কাছে রবিদা সামান্য রিকশাচালক ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু সম্মান দিলে যে সম্মান ফেরত পাওয়া যায় সেই বোধ ছেলেটির ছিল না।
আরও পড়ুন-সাহিত্য-আলোকে উদ্ভাসিত শারদোৎসব
খবরের কাগজ খুললে প্রায়শই যে খবরটি চোখে পড়ে সেটি হল বধূ নির্যাতন। নির্যাতনের কারণ কোনও ক্ষেত্রে পণ আবার কোথাও পুত্রসন্তান জন্ম না দেওয়ার অপরাধ।
কোনও সংসারে পুত্র এবং পুত্রবধূর কাছে বৃদ্ধ বাবা-মা বোঝা হয়ে যায়। এইতো কিছুদিন আগে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল বৃদ্ধা মাকে চোখ দেখানোর নাম করে একটি স্টেশনে বসিয়ে রেখে তাঁর ছেলে বেপাত্তা হয়ে গেছে। জন্মদাত্রী মা ছেলের গলগ্রহ হয়ে উঠেছে, আর তার ফলস্বরূপ অসহায় মাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে সেই ছেলে। স্বার্থের কাছে হারিয়ে গিয়েছে মায়ের প্রতি ছেলের ভালবাসা, সম্মান।
‘সম্মান’ কথাটা ভীষণ ভারী। তাই হয়তো বর্তমান সমাজে তার দায়ভার গ্রহণ করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়েছে। আর আমরা একে অপরকে সম্মান করা ভুলে যাচ্ছি। আর ফলস্বরূপ বেড়ে যাচ্ছে গৃহহিংসা, বধূ নির্যাতন, যৌননিগ্রহ। নারী লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন বাড়ি থেকে শুরু করে কর্মস্থল, সর্বত্র। প্রতিনিয়ত তাঁদের সম্মানহানি ঘটছে। নিগৃহীত হচ্ছে শিশুরাও। আধুনিক সমাজ যেন নারী ও শিশুদের সম্মান করতেই ভুলে যাচ্ছে। আর সেই কারণেই নারী ও শিশুর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বেছে নেওয়া হয় ন্যাশনাল রেসপেক্ট ডে অর্থাৎ জাতীয় সম্মান দিবস হিসাবে। এই জাতীয় সম্মান দিবস বা ন্যাশনাল রেসপেক্ট ডে পালন করার প্রধান উদ্দেশ্য পারস্পরিক সম্মান প্রদান করা যে একান্ত প্রয়োজনীয় এবং ঘরে-বাইরে নারী ও শিশুরা যাতে কোনও হেনস্তার শিকার না হয় সে সম্পর্কেও সমাজকে সচেতন করা। এই ন্যাশনাল রেসপেক্ট ডে তথা জাতীয় সম্মান দিবস শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে।
আরও পড়ুন-সাহিত্য-আলোকে উদ্ভাসিত শারদোৎসব
দ্য ফ্যামিলি ভায়োলেন্স প্রিভেনশন ফাউন্ড (the Family Violence Prevention Fund) যেটা বর্তমানে ফিউচার উইদাউট ভায়োলেন্স (Futures Without Violence) মেসির (Macy) সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্রথম ন্যাশনাল রেসপেক্ট ডে অর্থাৎ জাতীয় সম্মান দিবস পালন করেছিল।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষকে সম্মানের বিষয়ে শেখানো, গৃহহিংসা বন্ধ করা, শিশু নির্যাতন আর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মানুষ তথা নারী ও শিশুদের সুস্থ পরিবেশ ও জীবন দান করা এই দিবস পালন করার প্রধান উদ্দেশ্য। তবে এছাড়াও বিশ্ব সম্মান দিবস পালন করার আরও একটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সঠিক সম্মান প্রদানের বিষয় সচেতনতা গড়ে তোলা।
আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, সমাজের সব মানুষেরই সমান অধিকার। সবার ক্ষেত্রেই সম্মানটা সমান ভাবে প্রাপ্য। অনেক বাড়িতে গৃহ পরিচারিকাকে মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। ক’দিন আগে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল একজন উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলা তার গৃহপরিচারিকাকে প্রচণ্ড অত্যাচার করত, তাকে দিয়ে খারাপ খারাপ কাজ করাতে বাধ্য করত। অর্থাৎ তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিত না সেই মহিলা। আর এটা দেখে ফেলে সেই উচ্চবিত্ত মহিলার ছেলে। এবং সেই ছেলে তখন পুলিশের কাছে মায়ের নামে কমপ্লেন করেছিল। কারণ হয়তো গৃহপরিচারিকার প্রতি মার এই অসম্মান প্রদান মেনে নিতে পারেনি ছেলেটি।
আরও পড়ুন-রেকর্ড পতন পাউন্ডে
সম্মান হচ্ছে সেই জিনিস, যেটা কাউকে দিলে সেটা দ্বিগুণ পরিমাণে ফেরত পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি পরিবারে এটাই শেখানো উচিত যে মানুষ সবাই সমান। সবাইকে সবার ন্যায্য সম্মান দেওয়া উচিত।
আমাদের বাড়িতে একজন বয়স্কা গৃহপরিচারিকা ছিলেন। বিজয়া দশমী বা জন্মদিনে আমরা ছোটরা ওঁকে প্রণাম করতাম। প্রথমদিকে প্রণাম নিতে না চাইলেও পরে এই ব্যাপারে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আর সেই কারণে আমাদের বাড়ির সকলের প্রতিও তাঁর সম্মান ছিল প্রবল।
আমাদের পাড়ার একটি পরিবারে শাশুড়ি-বউমাকে দেখেছিলাম, না বলে দিলে বোঝার উপায় নেই যে ওঁরা শাশুড়ি-বউমা। মা-মেয়ে বলে প্রায়শই ভুল করতেন সবাই। সেই শাশুড়ি যতটা সম্মান তাঁর ছেলের বউকে করতেন, তার থেকে বেশি সম্মান ফিরে পেতেন তাঁর কাছ থেকে। আসলে সম্মান হল আয়নার মতো। অন্যকে যত বেশি সম্মান দেওয়া যাবে, ঠিক ততটাই ফেরত আসবে।
আরও পড়ুন-মোহনবাগানের লিগে খেলা নিয়ে জট সেই বহালই
পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘‘সম্মান অর্জনের জন্য আলাদা কিছু করার প্রয়োজন নেই, শুধু নিজের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করাই যথেষ্ট।” তাই আমরা যদি পরস্পর পরস্পরকে সম্মান দিতে পারি, অন্য মানুষের অনুভূতিকে সম্মান দিতে পারি, একে অপরের প্রতি ভালবাসাকে সম্মান দিতে পারি, একজন মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দিতে পারি, তাহলে শুধুমাত্র ১৮ সেপ্টেম্বরকে ন্যাশনাল রেসপেক্ট ডে তথা জাতীয় সম্মান দিবস হিসাবে পালন করার দরকার পড়বে না। আমাদের কাছে প্রতিদিনই হয়ে উঠবে সম্মান দিবস।