মাথাভাঙা থেকে শিয়ালদার সবজি বাজার, সর্বত্র সকাল-বিকাল আড্ডা কিংবা আলোচনার বিষয়বস্তু সিবিআই (CBI-Central Bureau of Investigation), ইডি বা এনআইএ।
কোত্থেকে কীভাবে এল এই সিবিআই (CBI-Central Bureau of Investigation)?
১৯৬২। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ, দুর্নীতি আর অন্যায় আচরণে জেরবার হয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সাংসদ কস্তুরীরঙ্গা সান্থানামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়ে দিলেন তিনি। সেই কমিটির অনুমোদনক্রমে দিল্লি স্পেশ্যাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৪৬-এর ক্ষমতাবলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক্সিকিউটিভ রেজুলিউশনের ফলে ১৯৬৩ সালের পয়লা এপ্রিল সিবিআই (সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন)-এর জন্ম। প্রথম ডিরেক্টর ধর্মনাথ প্রসাদ কোহলি। বর্তমানে এই সংস্থা মিনিস্ট্রি অফ পার্সোনেল, পাবলিক গ্রিভেন্স অ্যান্ড পেনশনের অধীনে কর্মরত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানাভাবে ক্ষমতা বেড়েছে সংস্থাটির।
এরও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১ সালে যুদ্ধ সম্পর্কিত জিনিসপত্র কেনাকাটা, জোগান ইত্যাদিতে ব্যপক হারে দুর্নীতি এবং ঘুষের প্রভাব তদন্ত করে দেখার জন্য ব্রিটিশ সরকারের আদেশক্রমে লাহোরে স্পেশ্যাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট নামক একটি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সৃষ্টি হয়। সেই সময় রায়সাহেব করম চাঁদ জৈন ছিলেন এর উপদেষ্টা আর কুরবান আলি খান ছিলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট। পরবর্তীকালে এটিও দিল্লি স্পেশ্যাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৪৬ অনুসারে স্বরাষ্ট্র বিভাগের আওতায় চলে আসে।
১৯৬৫-তে কেন্দ্রীয় এই সংস্থার তদন্তের পরিধি বাড়ানো হল এবং এই সংস্থা হয়ে উঠল মুখ্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। কেন্দ্রীয় কোনও আইন ভঙ্গ হলে, একাধিক রাজ্য জুড়ে কোনও সংগঠিত ক্রাইম কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রাইম হলে এই সংস্থা তদন্ত করবে। পরবর্তীকালে জটিল কেস, খুন, অপহরণ এবং সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদির তদন্তভার পেতে থাকে এই সংস্থা মূলত এর সুনামের কারণে। ১৯৮৭-তে এই সংস্থার মধ্যে অনেকগুলি বিভাগ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ইন্টারপোলে ভারতের নোডাল এজেন্সি হল সিবিআই। এই সংস্থার মাধ্যমেই রেড কর্নার নোটিশ জারি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পুলিশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য পুলিশের যাবতীয় সংস্থার যোগাযোগ স্থাপন হয়।
আরও পড়ুন-সিজিএল ২০২২ : কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েক হাজার ক্লার্ক, ইন্সপেক্টর, অফিসার নিয়োগ
কোনও রাজ্য সরকার চাইলে কিংবা প্রাপ্ত অভিযোগের বিচারে কেবল সুপ্রিম কোর্ট কিংবা হাইকোর্ট এই সংস্থাকে তদন্তের আদেশ দিতে পারে। ২০১২ সাল থেকে এই সংস্থার কাজকর্ম তথ্যাধিকার আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
সিবিআই ‘স্ট্যাটিউটারি বডি’ নয়। কারণ ভারতীয় পার্লামেন্টে এর জন্য আইন প্রণয়ন হয়নি বরং ব্রিটিশ সরকারের দিল্লি স্পেশ্যাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৪৬-এর ম্যানডেট অনুসারে সৃষ্টি এই সংস্থা। পরবর্তীকালে লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত অ্যাক্ট, ২০১৩-এর ম্যানিডেট-এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এই কারণেই ২০১৩ সালেরই নভেম্বর মাসে গুয়াহাটি হাইকোর্ট সিবিআই-কে বলল, ‘অসংবিধানিক’। সেই আদেশের উপর সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দেয় এবং এখনও তা বহাল রয়েছে।
১৯৮৪ শিখ নিধন কেস, সত্যম কেলেঙ্কারি, ২-জি স্পেকট্রাম, প্রিয়দর্শিনী মাট্টু হত্যা, আরুষি হত্যা মামলা-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সাফল্য পাওয়া তদন্তকারী এই সংস্থার নামটা শুনলে আগে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি জাগত, বিশেষ করে অর্থনৈতিক তছরুপের তদন্তে এই সংস্থা বিশেষ সুনাম অর্জন করে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই এই সংস্থা তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক শাসকের যন্ত্র কিংবা স্ক্রু-ড্রাইভার-এর কাজ করে চলেছে। এ-জন্যই ২০১৩-এ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা বিরক্ত হয়ে সিবিআইকে ‘খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি যা তার প্রভুর গলায় কথা বলে’ অভিধায় অভিহিত করেন।
ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি, ১৯৯৭-এর হাওয়ালা মামলায় সিবিআই ব্যর্থ। নরসিংহ রাও, জয়ললিতা, মায়াবতীদের বিরুদ্ধে কেসগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে টেনে টেনে দীর্ঘায়িত করার অভিযোগ এই সংস্থার বিরুদ্ধে। ১৯৮৬ সালের বফর্স মামলার তদন্তে ঘেঁটে ‘ঘ’ এই সংস্থা। এসব সবারই জানা।
রাজনৈতিক গুরুদের কথায় তদন্তে পক্ষপাতিত্ব দেখাতে গিয়ে এই সংস্থা লেজেগোবরে হয়েছে বারবার। এই সংস্থারই প্রাক্তন ডাইরেক্টর যোগিন্দর সিং এবং জয়েন্ট ডাইরেক্টর বি আর লাল স্বজনপোষণ, বিপথগামী তদন্ত, ঘুষ, দুর্নীতির মতো মারাত্মক সব অভিযোগ এনেছেন সংস্থার বিরুদ্ধে। শ্রী লাল সিবিআই নিয়ে লেখা বইয়ের শিরোনামে প্রশ্ন তুলেছেন, আসলে সিবিআই-এর মালিক কে? ডাইরেক্টর রঞ্জিত সিনহা, অলোক কুমার কিংবা স্পেশ্যাল ডাইরেক্টর রাকেশ আস্থানা, ডিএসপি দেবেন্দ্র কুমার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ দেখেছে ভারতবাসী, দেখেছে মাঝরাতে দায়িত্বের হাতবদল।
উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী, উন্নাসিক এই বিজেপি সরকার পরিচালনায়, কর্মসংস্থানে, সার্বিক উন্নয়নে ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে দেউলিয়া। টাকার লোভ দেখিয়ে, সিবিআই, ইডি-র পাহাড়প্রমাণ চাপ তৈরি সত্ত্বেও সম্প্রতিকালে রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি ইত্যাদি রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে জননেত্রীর হাতে খাওয়া মোক্ষম রাজনৈতিক কানমোলা হজম করতে না পেরে এই রাজ্যের আঙিনায় আজ সিবিআই-ইডি আর তাদের দোসরদের সকাল-সন্ধ্যা আনাগোনা।
কেন্দ্রীয় সরকারের একপেশে মনোভাব এবং তদন্তে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আজকের ভারতবর্ষে প্রায় সমস্ত বিরোধী সরকার পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলো সিবিআই তদন্ত নিয়ে ‘জেনারেল কনসেন্ট’ উইথড্র করে নিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে শক্ত মেরুদণ্ডের কোনও এক বিচারপতি হয়ত কোনও এক বিকেলে সিবিআই সম্বন্ধে বলবেন, এই সংস্থা আদতে ‘কেনেলে পালিত জীব, প্রভুর কথায় লেজ নাড়ে’।
বিধায়কদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া কিংবা সিবিআই (CBI-Central Bureau of Investigation), ইডি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনার যে রেওয়াজ বিজেপি ভারতবর্ষে শুরু করে জনাদেশ উল্টে দিতে শুরু করেছে। এর শেষ পরিণতির চিত্রনাট্য আমাদের অজানা। তবে মানুষ জাগছে, আর ‘গণতন্ত্রে শেষ কথা মানুষই বলে’। তাই ২০২৪-এই হয়ত আমরা দেখতে পাব, ‘উল্টে দিতেই পাল্টে গেছে’।