এজেন্সি নামিয়ে জননেত্রীকে আটকানো যায়নি, যাবে না
নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলা কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাটা মোদি-শাহ জমানার দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই মিথ্যাচারের কাছে মাথা নত করবে না তৃণমূল কংগ্রেস। উলটে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বিপজ্জনক এই প্রবণতার ভয়ানক পরিণতির বিষয়ে হুঁশিয়ার করতে কলম ধরেছেন জয়ন্ত ঘোষাল। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
গতকালের পর…
সেসময়ে দেবগৌড়া কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ছিলেন অথচ বোফর্সের তদন্ত সেই সময়ে চুপচাপ অনেকটা এগিয়ে যায় আর তখন থেকেই কংগ্রেসের মধ্যে শুরু প্রতিক্রিয়া হয়। ইন্দরকুমার গুজরাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সীতারাম কেশরি প্রাতরাশ বৈঠকে তাঁর কাছে এসে বলেছিলেন, এই ‘বোফর্স তদন্ত’ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সমর্থন তুলে নেওয়া হবে। শেষপর্যন্ত কিন্তু কংগ্রেস সমর্থন তুলে নিয়েছিল। কারণ বোফর্সের তদন্ত দেখায়নি কিন্তু গুজরালকে দিয়ে কার্যত সেটা বন্ধের চেষ্টা হয়েছিল। সিবিআই ততদিনে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে গেছে। যোগীন্দর সিংও তখন থামতে চাননি। পরবর্তীকালে যোগীন্দর সিংকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর লেখা বইতে সেই সমস্ত কথা বলা হয়েছে। এখন যোগীন্দর সিং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে। দেবগৌড়া এবং গুজরাল, তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দর কষাকষি করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে। সুতরাং, সিবিআইয়ের যে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা লালবাহাদুর শাস্ত্রী অনুভব করেছিলেন, সেটা কখনও হয়নি। চন্দ্রস্বামীর বিষয়ে সিবিআই তদন্ত করছে এবং সেই চন্দ্রস্বামীকে যাতে গ্রেফতার না করা হয় তার জন্য নরসিংহ রাও কেন, চন্দ্রশেখরের মতো প্রধানমন্ত্রীও সিবিআইকে বাধা দিয়েছেন। সেসব কথা সিবিআইয়ের প্রাক্তনীদের লেখনী থেকেই বেরিয়ে আসছে। এগুলো সমস্ত অন রেকর্ড রয়েছে তাঁদের বক্তব্যে। এমনকি, ‘কিসসা কুর্সি কা’ যখন ছবি হয়েছিল মোরারজী দেশাইয়ের সময়, তখন কীরকম ভাবে সিবিআইকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সঞ্জয় গান্ধীর বিরুদ্ধে কী তদন্ত হয়েছিল এবং কীভাবে সেই তদন্ত উঠে গেল, এই বিষয়গুলো সবই আজ ইতিহাসের অঙ্গ।
আরও পড়ুন-১৫ই ত্রিপুরায় পদযাত্রা অভিষেকের বিপুল উদ্দীপনা
এত ইতিহাসের কথা বললাম কেন? তার কারণ একটাই, সেটা হচ্ছে যে, আজ কিন্তু আবার দেখতে পাচ্ছি যে সিবিআইয়ের অপব্যবহার হচ্ছে। ভোটের সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআইয়ের হানা, এনফোর্সমেন্ট কর্তাদের হানা। সিবিআইয়ের যে হানা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানার আগে সংবাদমাধ্যমের কতিপয় সাংবাদিক জেনে যাচ্ছেন এবং ক্যামেরাম্যানরা তাঁদের পজিশন নিয়ে নিচ্ছেন। এটা কী করে সম্ভব হয়? আসলে এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আমরা এখন ‘মিডিয়াটাইজ’ গণতন্ত্রে বসবাস করি। এই যে আগে থাকতে জানিয়ে দেওয়া, এব্যাপারে প্রাক্তন সিবিআইয়ের কর্তা শান্তনু সেন, তিনি বলছিলেন যে, সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে তদন্ত করার সংস্কৃতি কিন্তু তাঁদের সময়ে ছিল না। অর্থাৎ সিবিআইয়ের তদন্তের যে কার্যকলাপ সেটা হয় ‘COVERT’, ‘OVERT’ নয়। অর্থাৎ লোককে জানিয়ে, সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে সিবিআইয়ের তদন্ত করার কথা নয়! সেটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দোষী বা দোষী নয়, তদন্ত হওয়া উচিত না উচিত নয়, সেটা রাজনৈতিক প্রণোদিত উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্য নয় এই বিতর্কে যাওয়ার আগে আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে যে, যদি তদন্ত হয়ও, সেটা সংবাদমাধ্যমকে কীভাবে জানানো হচ্ছে, কারা জানাচ্ছেন, সেটাও একটা তদন্তের বিষয়। তার কারণটা হচ্ছে, সিবিআই কোনও বিবৃতি দিচ্ছে না।
আরও পড়ুন- সরকার গড়লেও অর্থসংকট বন্ধ আন্তর্জাতিক সাহায্য, বেকায়দায় তালিবান
সিবিআই কোনও রকম সাক্ষাৎকার দিচ্ছে না, সিবিআইয়ের কোনও ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট নেই। তাহলে কীভাবে এই রকম পরিস্থিতিতে সিবিআইয়ের মুখপাত্র কোনও অন রেকর্ড বক্তব্য রাখছেন না, অথচ সিবিআই সূত্র বলে সংবাদমাধ্যমে কিছু একটা বেরোচ্ছে। তাহলে এখন সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে যদি কোনও একজন বন্ধু সাংবাদিককে এটা যদি জানিয়ে দেওয়া হয় যে, অভিষেকের বিরুদ্ধে অমুক-অমুক দুর্নীতি আছে এবং সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি আর সেই সাংবাদিক যদি একটি চ্যানেলে বা একটি সংবাদপত্রে সেটা প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে টিআরপি প্রতিযোগিতায় থাকা অনান্য সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চিতভাবে সেটা প্রচার করতে শুরু করবে। এভাবে কোনও প্রমাণ ছাড়াই একজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়ে যায়। সুতরাং, তদন্তটার যে বিষয়টা সেটা যদি হিন্দিতে যেমন বলা হয়, ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ অর্থাৎ পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সম্ভবায়িত হয়। সিবিআই সূত্র থেকে আমি যেটা জানতে পেরেছি যে, এখনও পর্যন্ত আট-নয় ঘন্টা জেরা করার পরেও সিবিআইয়ের কোনও কাগজপত্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নেই। ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র জে সাংবাদিক সিবিআই কভার করেন, সেই পৌলমী সাহা দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, সিবিআইয়ের কাগজপত্রে অভিষেকের নাম নেই। সেটা যখন নেই তখন সেই বিষয়ে যোগসাজশ খোঁজার জন্য সিবিআই প্রশ্ন করছে যে, অনুপ মাঝি ওরফে লালা ও বিনয় মিশ্রের সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্ক আছে কিনা। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে দিয়ে কোনও বিবৃতি লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে কিনা, এসব কথার সত্যতা কতদূর, সেসব আমরা তো জানতে পারছি না। তাহলে এখানে কিন্তু বাস্তব এবং প্রচারিত যে খবরের মধ্যে একটা মস্ত বড় ফারাক থাকতে পারে। সেই ফারাকটা যাতে না থাকে, সিবিআইয়ের প্রতি মানুষের বিশ্বাস যাতে রক্ষা করা যায়, তাহলে সবটা জানানো প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের বক্তব্যের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা
এবার আসা যাক রাজনৈতিক প্রভাবের কথায়। যদি অভিষেকের বাড়িতে হানা দিয়ে যদি জনমানসে খুব ভাল প্রভাব ফেলা যেত এবং সেক্ষেত্রে যদি অভিষেকের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হত, তাহলে তো পসচিম্বং বিধানসভা ভোটে এই ফলাফল হতে পারে না! এখন ভবানীপুরে নির্বাচনের আগে যদি অভিষেককে ডাকা হয় এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী ঐক্যকে ভাঙার জন্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে টার্গেট করা হয় এবং কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে যাতে কোনওরকম ভাবে ঐক্য রচনা না হয়, সেইসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যদি সিবিআইকে কাজে লাগান হয়, তাহলে তো মানতেই হবে জে, অভিষেক সংক্রান্ত বিষয়গুলো সিবিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত বিষয় নয়, রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত।
… এরপর আগামিকাল