রাজসভায় একদল ব্রাহ্মণ এক ব্রাহ্মণপুত্রের শব বহন করে আনলেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁরা জানালেন, রামরাজ্যে নিশ্চয় কোথাও অধর্মাচার চলছে। তাই অকালে এই ব্রাহ্মণসন্তান মারা গিয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, নিশ্চয় কোনও শূদ্র তপস্যায় রত। তারই পরিণামে ব্রাহ্মণপুত্রের অকালমৃত্যু। রাম ধর্মপালক, প্রজারক্ষক, তাই অধর্মাচার বন্ধ করার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই বর্তায়। রাম বের হলেন অধর্মাচারীর খোঁজে। গহন অরণ্যে দেখলেন, এক শূদ্র বালক সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করে তপস্যারত। রাম জানতে চাইলেন, তার নাম কী, সে কী করছে ইত্যাদি। উত্তরে সে জানাল, তার নাম শম্বুক। সে কঠোর তপস্যায় রত। সে আদতে অনার্য, শূদ্র। দ্রুত রাম শম্বুককে লক্ষ্য করে শরনিক্ষেপ করলেন। তিরবিদ্ধ শম্বুকের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ওদিকে অযোধ্যার রাজসভায় মৃত ব্রাহ্মণপুত্রের শরীরে প্রাণ সঞ্চারিত হল। সে উঠে বসল। রামের নামে চারিদিকে জয়ধ্বনি উচ্চারিত হল।
বাল্মীকি রামায়ণের এই কাহিনি প্রক্ষিপ্ত অংশ কিনা সঠিক ভাবে জানা নেই। তবে যখনই দেশের নানা প্রান্তে, বিশেষত হিন্দি হিন্দুত্বের বলয়ে কোনও শূদ্র, দলিত, অনার্য বালক স্রেফ লেখাপড়া শিখতে গিয়ে নির্যাতিত (Dalit oppression) হয়, তখনই রামায়ণের শম্বুক কাহিনি সত্য হয়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছিল কয়েক মাস আগে রাজস্থানে। নয় বছরের ছেলে ইন্দ্র মেঘওয়াল উচ্চবর্ণীয় শিক্ষক মহাশয়ের পাত্রের জল খেয়ে ফেলেছিল। তাকে মরতে হয়েছিল।
মোদি-শাহরা যাই-ই বলুন না কেন, ঘোর বাস্তব এটাই যে হিন্দি-হিন্দুত্বের বলয়ে দলিত বালকের শিক্ষালাভ কোনও আনন্দদায়ক প্রক্রিয়া নয়। মিড-ডে মিলে তাদের আলাদা পঙক্তিতে বসানো হয়। উচ্চবর্ণের শিক্ষক ও সহপাঠীরা তাদের বেদম পিটিয়ে মজা পায়। উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে তারা ব্রাত্য নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে বলেই সেন্থিল কুমার, রোহিত ভেমুলা আর পায়েল তাদভিদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়।
দেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে আজকের দিনেও জীবন জীবিকা জাতিগত বা বর্ণপরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল। জীবিকা ব্যক্তির পছন্দ অপছন্দ কিংবা দক্ষতা যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না, করে ব্যক্তির বর্ণপরিচয়ের ওপর। এই বিষয়টা লক্ষ্য করেই বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, বর্ণাশ্রম প্রথা শ্রমের বিভাজন ঘটায় না, শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সঞ্চার করে। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় তখন, যখন একজন চর্মকারের সন্তান ইচ্ছা থাকলেও সূত্রধর বা কাঠের মিস্ত্রি হতে পারে না, যদিও তার একান্ত ইচ্ছা চামড়া নয়, কাঠ নিয়ে কাজ করার। উপায় নেই। মৃত পশুর শরীর থেকে ছাল ছাড়িয়ে সেটাকে ব্যবহার-উপযোগী করে তোলার মতো দরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি এখনও দেশের বেশিরভাগ অংশে নির্দিষ্ট বর্ণের লোকদের ওপরেই ন্যস্ত। তার অন্যথা হওয়ার জো নেই। ব্রাহ্মণরা মরা পশুর শরীর দেশের বেশির ভাগ জায়গাতে ছোঁবেই না। ফলে, সার্বিক জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে কোনও না কোনও ভাবে এই বর্ণাশ্রম প্রথা প্রতিবন্ধকতা রচনা করে।
বলা বাহুল্য, মদীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এখনও এত ছুৎমার্গ নেই। কিন্তু উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বিষয়টি নিয়ে চরম বাড়াবাড়ি বিরাজমান। ফলে উদ্ভাবনী ক্ষমতা সর্বস্তরে বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে না। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগানটা নেহাতই কথার কথা হয়ে থাকছে।
আরও পড়ুন-ঢাকাগামী বাস থেকে মিলল বাংলাদেশি টাকা
বর্ণাশ্রম প্রথা বজায় থাকা মানে সমাজের উচ্চবর্ণীয়রা নিম্নবর্গীয়দের পরিশ্রমের ফল ভোগ করবে। ব্যাপারটা মনে পড়লেই সমাজবিজ্ঞানী কাঞ্চা ইল্লাইয়ার একটা কথা মনে পড়ে যায়। তিনি কর্মফল তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে বসে লিখেছেন, যদি তুমি কর্ম কর আর ফলের প্রত্যাশা না কর, তবে কে সেই ফলটা ভোগ করবে? নিঃসন্দেহে উচ্চবর্গীয় মানুষজন যাঁরা কর্ম করছেন না, ফল উৎপাদন করছেন না, তাঁরাই সানন্দে তোমার কর্মফল ভোগ করবেন।
দলিত নির্যাতনের (Dalit oppression) হার মোদির ভারতে যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিশ্চিত, এই ব্যবস্থাটা কায়েম করার জন্য এই সরকার উঠে পড়ে লেগেছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে গরিবগুর্বোদের (Dalit oppression) প্রতি ভয়ানক রকমের উদাসীন তা বোঝা যায় কয়েকটা পরিসংখ্যান দেখলেই।
ভারতে দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যার কারণে মৃত্যু সংক্রান্ত রিপোর্ট বলছে, ২০২১-এ দিনমজুরদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা সর্বাধিক। অপঘাতে মৃতদের ২৫.৬ শতাংশ হল দিনমজুর। ২০২১-এ ৪২,০০৪ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০২০-তে আত্মঘাতী দিনমজুরের সংখ্যা ছিল ৩৭,৬৬৬। ২০১৯-এ এই সংখ্যাটা ছিল ৩২,৫৬৩। অর্থাৎ দিনমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বাড়ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মোদি-শাহর জমানায় এমন অচ্ছে দিন এসেছে যে কেবল দিনমজুরদের মধ্যেই নয়, সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ৭.১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকদের মধ্যে আত্মঘাতীর সংখ্যা কমলেও খেতমজুরদের মধ্যে সংখ্যাটা হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। ২০১৯-এ আত্মহত্যা করেছিলেন ৪,৩২৪ জন। ২০২০-তে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৫,০৯৮। আর ২০২১-এ ৫,৫৬৩ জন খেতমজুর আত্মহত্যা করেছিলেন।
একেই বোধ হয় অচ্ছে দিন বলে।
পস্কো আইনের অধীনে শিশু নির্যাতনের হারও বেড়েছে ৩৬ শতাংশ,
সব মিলিয়ে অশুভের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের সনাতনী বিশ্বাস, বহুকালাগত পরম্পরা। ভারতাত্মার রক্ষণের জন্যই এই নষ্ট জমানার বদল হওয়া দরকার। মোদি-শাহ সরকারকে বিদায় করা আবশ্যক।