১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার দেশে এক জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে। তখন রাষ্ট্রের অতিসক্রিয়তা, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং গণতন্ত্রধ্বংসের ঘটনাবলি ইতিহাসের পাতায় কালাে অক্ষরে লেখা আছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর। আমরা ‘অঘােষিত জরুরি অবস্থার কথা শুনছি নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলি এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের লেখা ও বর্ণনায়। সম্ভবত পিউসিএল (পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ) প্রথম এই অঘােষিত জরুরি অবস্থার কথা বলে। ২০১৮ সালে তাদের ঘােষণায় বলা হয়, “আজ ২০১৮ সালের এই দিনে সারা দেশ জুড়ে ‘অঘােষিত জরুরি অবস্থা চলছে। নাগরিক অধিকার | কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেড়ে নেওয়া। হয়েছে, দেশপ্রেম এবং সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামে। বাক-স্বাধীনতা, লেখা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিষিদ্ধ হয়েছে। যাঁরা মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলছেন, মানবাধিকার রক্ষা ও বিকাশের কথা বলছেন এবং সংগ্রাম চালাচ্ছেন সেই সব সক্রিয় ব্যক্তিদের হয়রান করা হচ্ছে। যে কোনও বিরােধী স্বরকে ‘দেশদ্রোহ’বলে দমন-পীড়ন চালানাে হচ্ছে।”
নরেন্দ্র মােদি (Modi Government) পরিচালিত এনডিএ সরকার প্রণালিবদ্ধ ভাবে আইনের শাসনের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। যার ফলে গণতন্ত্রের ভিত। আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। সংবিধান। অন্তঘাত চলছে সংবিধানের উপর। একই লাইনে চলছে স্বাধীনতা খণ্ডন, সংবাদমাধ্যমের উপর সেন্সরশিপ, নিবারণমূলক আটক আইন এবং আইন বিভাগের স্বচ্ছতার তরলিকরণ।
গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা হল, সরকারকে। প্রশ্ন করা এবং চ্যালেঞ্জ জানানাে। এটাই হল স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতা ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ছে। সরকার বিরােধীদের বিরুদ্ধে অপরাধ-আইন (ক্রিমিনাল ল) প্রয়ােগ করছে। UAPA আইন প্রযুক্ত হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীসহ যাঁরা দলিত আন্দোলনের কর্মী এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মকলাপের বিরােধী, অ্যাডভােকেট ও সংবাদকর্মী— তাঁদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এনকাউন্টার ডেথ, কপোরেট স্বার্থে বেআইনি জমিদখল, আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, দলিত নিপীড়ন সহ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা সকলেই মােদি-জমানায় বিনা । কারণে ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত হচ্ছেন। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার পর তাঁদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা পুরােপুরি অমানবিক। দিল্লির। শাহিনবাগ আন্দোলন সিএএ বিরােধিতার কারণে তাঁদের দেশ বিরােধী বলে দেগে দেওয়া হয়। কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে দিল্লির
সন্নিকটে বৎসরকাল ধরে যে আন্দোলন, তার বিরুদ্ধেও সরকারের অগণতান্ত্রিক ভূমিকা নিন্দাযােগ্য। একুশ বছরের দিশা রবি, | তেইশ বছরের নদীপ কাউর, আঠাশ বছরের মানােয়ার ফারুকিকে কোনও অপরাধ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল। সরকার-বিরােধীদের মনে ভয় ধরানাে।
আরও পড়ুন-স্ট্যাম্প ডিউটি : রেকর্ড আয়
৭৫-এর জরুরি অবস্থা অবশ্যই ভারতীয়। গণতন্ত্রের উপর ছিল এক বড় আঘাত। তৈরি হয়েছিল এক ভয়ের রাজত্ব। গ্রেফতার। হয়েছিলেন লক্ষাধিক মানুষ। জোর জবরদস্তি সবই ঘটেছিল। কিন্তু গণতন্ত্র পুরােপুরি মরে যায়নি। মানুষ ছিলেন সাধারণভাবে জরুরিব্যবস্থা তথা সরকার বিরােধী। তাই যখনই সুযােগ এল, মানুষ তার সদ্ব্যবহার করে
ইন্দিরা-জমানাকে ভােটে পরাজিত করে | গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে তুললেন, তার সমস্ত সীমাবদ্ধতা নিয়েই। আমরা লক্ষ করছি মোদি জমানায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করেই একই পদ্ধতিতে আইনের শাসন, অধঃপতিত হচ্ছে। শাসকদের কৈফিয়ত দেওয়ার বিষয়টিকে এবং গণতন্ত্রের রক্ষক বিভিন্ন সংস্থাগুলিকে ক্রমান্বয়ে একটি ব্যবস্থা হিসেবেই দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। যে সংস্থাগুলি শাসকদের নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, তাদের ব্যবস্থাগত দিক থেকে দুর্বল ও অগ্রাহ্য করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, পার্লামেন্ট, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ এবং বিচার বিভাগ— সবই এর মধ্যে পড়ে। এর সবটা, সবসময় দেখা যায় না, তবে এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক এক সংবিধান-বহির্ভূত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ।
ঘোষিত জরুরি অবস্থায় শুধু সংবিধান সংশোধন করেই স্বৈরতন্ত্রকে মজবুত করা হয়েছে, এমন নয়। প্রচলিত আইনবিধি, প্রণালী ও প্রথাকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। সমস্ত সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত গৃহীত হত মাতা-পুত্র ইন্দিরা গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশমতো ।
একই ভাবে মোদি জমানায় আইনবিধি, পদ্ধতি ও প্রথা বহির্ভূত ভাবেই সব ক্ষমতা নরেন্দ্র মোদির হাতে কেন্দ্ৰীভূত হয়েছে। ক্যাবিনেট ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমস্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কেন্দ্রীভূত হয়। এর উল্লেখ পাওয়া যায়, মোদি ক্যাবিনেটের পদত্যাগী সদস্য উপেন্দ্র কুশওয়ারের অভিযোগপত্রে।
দ্বিতীয় মোদি সরকারের (Modi Government) আমলে একই কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করা হয়। এই সময়ে মোদির সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রে যুক্ত হন অমিত শাহ।
যে-কোনও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। জরুরি অবস্থার সময় প্রেস এতটা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, যা মোদিশাসনে সম্ভব হয়েছে। এবং তা হয়েছে অঘোষিত জরুরি অবস্থায়।
বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে, বিচারব্যবস্থা সংবিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও নীরব থাকে। গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে আলোচনার সময় থাকে না কোর্টের কাছে। ৩৭০ ধারা, সিএএ এবং ইলেক্টেরাল বন্ড, ইত্যাদির কথা তো বলাই যায়।
মোদি-শাসনে এক ধরনের ‘সুলতানি’ ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। ২০১৬-র নোটবন্দি, ২০২০-র দেশব্যাপী অপরিকল্পিত ‘লকডাউন’-এর উদাহরণ। বর্তমান শাসন মোদিকেন্দ্রিক। ব্যক্তি ভাবমূর্তিকে এই
শাসনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইন্দিরা শাসন ছিল কর্তৃত্ববাদী। আর মোদি-শাসন হল সর্বাধিপত্যবাদী।
এই বিষয়টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইন্দিরা জমানার শাসনে ঝোলানো ছিল সমাজতন্ত্রের আদর্শ। আর মোদি জমানার মতাদর্শ হচ্ছে ‘হিন্দুত্ব’। মোদি জমানার বিশাল সমর্থনের কেন্দ্র হচ্ছে আরএসএস। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সেরকম কিছু ছিল না। আরএসএস সরকারের পক্ষে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত প্রচার করতে সক্ষম, যা মোদি-জমানার শক্তিশালী ভিত্তি।
এটাও উল্লেখযোগ্য যে, মোদি-জমানার (Modi Government) পক্ষে জনমত বেশ প্রবল। অবশ্যই তা সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে। ঘোষিত জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা জমানার প্রতি জনমত প্রধানত ছিল বিরোধী অবস্থানে। প্রধান ধারার সমাজমাধ্যম মোদি জমানার পক্ষে মানুষের সাধারণ চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে। মোদির ভারতে জনশক্তি (Mob Power) মোদির পক্ষে। এই ‘মব-পাওয়ার নরেন্দ্র মোদির বাড়তি শক্তি। মোদি জমানার পপুলিস্ট রাজনীতি জনসমর্থনের যে ভিত তৈরি করেছে তাকে দুর্বল ও চূর্ণ করা খুব সহজ নয়। বিরোধী পক্ষের সার্বিক ও ঐকান্তিক উদ্যোগ এর জন্য খুবই জরুরি। এই জমানার বৈশিষ্ট্যগুলিকে বুঝতে হবে গভীর থেকে। মনে রাখা দরকার, ঘোষিত জরুরি অবস্থার চেয়েও অঘোষিত জরুরি অবস্থা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।