পূর্ণেন্দু বসু : সত্যিই আশা জাগাচ্ছে চলমান কৃষক আন্দোলন। তিনটি কৃষি আইন বাতিল এবং কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি স্বীকৃতি-সহ আরও কিছু দাবিকে সামনে রেখে এই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। লাগাতার দশ মাস। পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও ক্রমশই একের পর এক রাজ্য এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। গড়ে উঠেছে পৃথক পৃথক কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ— সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)।
৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, এই আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। এদিন কয়েক লক্ষ কৃষক উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরের গভর্নমেন্ট ইন্টার কলেজ গ্রাউন্ডে এক কৃষক মহাপঞ্চায়েত উপলক্ষে জমায়েত হন। এই জমায়েত থেকে কৃষক নেতারা তিনটি কৃষি আইন বাতিল ও এমএসপির আইনি গ্যারান্টির দাবিগুলি পুনরায় উত্থাপন করেন। কৃষক নেতা বিজেপি শাসনের অপসারণের কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন। কৃষক নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সাম্প্রাদায়িক ঐক্যের আওয়াজ তোলেন।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এই কৃষক আন্দোলন আমাদের স্মরণ করাচ্ছে ৭৫ বছর আগের এক কৃষক আন্দোলনকে। এই বাংলার ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনকে। একদিকে তখন ’৪৬-এর ভয়াবহ দাঙ্গা, অন্যদিকে তখন তেভাগা আন্দোলনে শাসকপক্ষীয় সাম্প্রাদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সকলের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান— ‘দাড়ি টিকি ভাই ভাই, লড়াইয়ের ময়দানে জাতিভেদ নাই।’
ভাবতে অবাক লাগে, ৭৫ বছর পার করেও স্বাধীন ভারতে বর্তমান শাসকরা আন্দোলন ভাঙার একই পথ নিচ্ছে। আর কৃষকদের একইভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেই লড়াই ছিল ভাগচাষিদের তেভাগার লড়াই। জমির মালিকরা অর্থাৎ জোতদার জমিদার ভাগচাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক নিয়ে নিত। ভাগচাষিরা দাবি করল— ‘আধি নয় তেভাগা চাই।’ যার অর্থ হল, অর্ধেক নয়, ফসলের তিন ভাগের দু’ভাগ দিতে হবে। স্বাধীনতার আগে ও পরে দুই পর্বে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের মধ্যেই তেভাগা আন্দোলনে শহিদ হন ৭৩ জন কৃষক। তারপর ১৯৪৮-৪৯ সালে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন আরও ৬৮ জন। আজকের মতো সেদিনও কৃষক শহিদ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তেভাগা আন্দোলনে কৃষকরা জয়ী হয়েছিলেন। ’৪৯ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ সরকার অধ্যাদেশ জারি করে তেভাগার দাবি মেনে নেয়।
আধিয়ার, ভূমিহীন খেতমজুর, সাধারণ কৃষক, আদিবাসী প্রভৃতি সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য। সাম্প্রদায়িকতার বিষ আন্দোলনে ফাটল ধরাতে পারেনি। জলপাইগুড়ি জেলায় তেভাগা আন্দোলনে চা-শ্রমিক ও রেল শ্রমিকের সক্রিয় সমর্থন ছিল উল্লেখ করার মতো। আজও কৃষক আন্দোলনে শ্রমিক অংশগ্রহণের সম্ভাবনা ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কৃষি বিল বাতিলের দাবি এবং শ্রম কোডগুলি বাতিলের দাবিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে শাসক বিরোধী আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বেগবান হবে আন্দোলনের গতি। আশা জাগানো চলমান কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এবার তুলে ধরব।
এক, পাঁচ তারিখের জমায়েত থেকে সেক্যুলার বনাম ধর্মীয় বিভাজনী-রাজনীতির লড়াইয়ে কৃষকপক্ষ পুরনো ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক বয়ানকে প্রকাশ্যেই সামনে এনেছে। খোলাখুলি বিজেপির বিভাজনমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন কৃষক নেতারা। ২০১৪ সাল থেকে দেশজুড়ে এবং স্থানীয় স্তরে, বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে প্রাধান্যে নিয়ে এসেছে। তার বিপরীতে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, উত্তরাখণ্ড ও অন্যান্য রাজ্য থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যায় মহিলা ও যুবকরা মুজফ্ফরনগেরর সমাবেশে হাজির হয়েছে। এই আন্দোলনে লিঙ্গ ও পরিবেশ ও সংক্রান্ত ইস্যু বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন : খনি এলাকায় ধস, ঘরছাড়া ১৫টি পরিবার
এছাড়াও পৃথক পৃথক কৃষক সংগঠনগুলিকে একটি যৌথ মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করা এবং ছোট ছোট প্রান্তিক সংগঠন বা গোষ্ঠীগুলির মতপ্রকাশের জায়গা করে দেওয়ার মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ গড়ে উঠছে আজকের স্বৈর-জমানায় তা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে সামনে নিয়ে আসার পাশাপাশি বিজেপির রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন সরব হয়েছে। কারণ আন্দোলনরত কৃষকরা ভাল করেই বুঝেছেন যে, বিজেপি যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন আইন বাতিল হবে না।
দুই, ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল। এরফলে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশকে ধর্মভিত্তিক ব্যাপক মেরুকরণ বা পোলারাইজেশন ঘটে। এতে লাভবান হয় বিজেপি। ২০১৪ ও ২০১৯-এর নির্বাচন তার প্রমাণ। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন শুধু সামাজিক বন্ধনকে আলগা করেনি, এরফলে কৃষকের নিজস্ব পরিচিতি ও ঐক্য নষ্ট হয়। এই মহাপঞ্চায়েত সে সবের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজ-সহ সমগ্র দেশের কাছে এক ইতিবাচক বার্তা পাঠানো। বিরোধী দলগুলির ভীত-সন্ত্রস্ত সংযত নেতাদেরও বার্তা দিল কৃষক সমাবেশ। বলা বাহুল্য, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বর্তমান বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে। শুধু তাই নয়, শুরুর সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস কৃষক আন্দোলনকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন করেছে এবং কৃষি আইনগুলির বিরোধিতা করেছে। আন্দোলনের নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায়ও বসেছেন।
আরও পড়ুন : খনি এলাকায় ধস, ঘরছাড়া ১৫টি পরিবার
তিন, এই মহাপঞ্চায়েত চলমান কৃষক আন্দোলনকে একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনে উত্তরণ ঘটাবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ অতিক্রম করল। ঘােষণা হল, দাবি না মানলে কৃষকরা তাঁদের দুর্ভোগ কমাতে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিজেপিকে বেগ দেবেন। উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। এ কথা মাথায় রেখেই ‘মিশন ২০২২’-এর কথা ঘোষণা করেছেন কৃষক নেতারা। আওয়াজ উঠেছে ‘ফসলো কী দাম নহী, তো ভোট নহী।’ নেতারা ঘোষণা করেছেন, শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে গ্রামে গ্রামে কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবেন। কৃষকদের বোঝাবেন, কৃষি আইনগুলি তাঁদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে কতখানি হানিকর।
গত বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা ভারত। বাংলার জয়ে সকলে খুশি হয়েছেন। তব সব থেকে বেশি খুশি পাঞ্জাব, হরিয়ানার আন্দোলনরত কৃষকরা। বিজেপিকে হারাতে পারেন মমতা। এতে তাঁরা গর্বিত। কৃষক আন্দোলন চলছে। আন্দোলন চলাকালীন প্রাণত্যাগ করেছেন অনেকে। সম্প্রতি কারনালে পুলিশি অত্যাচারে শহিদ হয়েছেন এক কৃষক। কারনাল এখন ন্যায়বিচারে দাবিতে উত্তাল।
আরও পড়ুন : ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা যতীন্দ্র নাথ দাসের প্রয়াণ দিবসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
সংযুক্ত কিষান মোর্চার এই আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের মিলন ঘটাবার পর বাকি থাকছে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সহায়ক ভূমিকাকে সংহত করার কাজ। আন্দোলনের পক্ষে এই রাজনৈতিক উদ্যোগ এখনও নেওয়া কর্তব্য। ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস-সহ ৯টি বিরোধী দল সংযুক্ত কিষান মোর্চার ঘোষিত কিছু কর্মসূচিকে যৌথভাবে সমর্থন করেছে। আরও সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
এই সম্মিলিত উদ্যোগে কেন্দ্রে বিজেপি শাসনের অবসান সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে, কারও একক উদ্যোগে যা সম্ভব নয়। উত্তরপ্রদেশ থেকে সেই উদ্যোগ শুরু হোক। পশ্চিমবঙ্গে যা সম্ভব হয়েছে, উত্তরপ্রদেশেও তা সম্ভব। সম্ভব দিল্লির ক্ষমতা থেকেও বিজেপিকে সরিয়ে দেওয়া। তাই ‘মিশন ২০২২-এর পর মিশন ২০২৪’। আওয়াজ উঠেছে, বিজেপি হঠাও কৃষক বাঁচাও। বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও।