জওহরলাল নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রী। কলকাতার এক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্দ্রাকে বেআইনি ভাবে অনেকগুলি জীবন বিমা সংস্থা কেনার অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে। ১৯৫৪ সালে মুন্দ্রা ব্যবসা শুরু করেন। তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায় মাত্র দু’বছরেই তিনি ধনকুবের হয়ে ওঠেন। রাজ্যসভার সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় তোলেন। কৃষ্ণমাচারি জবাবে বলেন, আমি হরিদাস মুন্দ্রা নামটাই কোনওদিন শুনিনি। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় কিন্তু নেহরুকে চিঠি দিয়ে বলেন, অসত্য বলছেন অর্থমন্ত্রী। তদন্ত হোক। আর মৌলনা আবুল কালাম আজাদ নেহরুকে কি বলেছিলেন জানেন? তিনি বলেন, ‘তুমি যদি ওর ইস্তফা গ্রহণ না কর তা হলে দুর্নীতির সঙ্গে আপসের অভিযোগে আমি ইস্তফা দেব। কৃষ্ণমাচারি সেদিনই ইস্তফা দেন। নেহরুর প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের বিরুদ্ধে জিপ কেনার কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি ওঁর সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করেন। মেননকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে নেহরু তাঁকে পছন্দ করতেন। আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেই ফিরিয়ে আনেন।
১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেহরু আর কোনও বই লেখার সময় পাননি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীদের প্রচুর চিঠি লিখেছিলেন। সে-সব চিঠি এখন পড়তে গিয়ে দেখি নেহরু বারবার দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে শঙ্কা-উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তাই দুর্নীতি জিনিসটা আজ যে হঠাৎ হচ্ছে তা নয়। কৌটিল্য তো রাজা ধননন্দের দুর্নীতি হাতেনাতে ধরেছিলেন। ধননন্দ ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের বেতন থেকে মোহর চুরি করে জঙ্গলে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। উৎকোচ সম্পর্কে চাণক্যর বিখ্যাত শ্লোক— রাজকর্মচারীদের কাছে এ-যেন জিহ্বাগ্রে মধু।
সমাজব্যবস্থার শীর্ষ থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত দুর্নীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত। এদেশে একবার বোফর্স দুর্নীতি ভোটে ইস্যু হয়েছে বটে কিন্তু দেখা যায় সাধারণ মানুষ ভোটে দুর্নীতিকে প্রধান বিষয় হিসেবে সাধারণত গ্রহণ করে না। বোফর্স ইস্যুতেও দুর্নীতির চেয়ে বেশি ছিল দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তাবাদের ইস্যু। দেশকে বিক্রি করার অভিযোগ। সেই বোফর্সের অভিযোগের কোনও প্রমাণ কিন্তু হল না আদালতে। রাজীব গান্ধী প্রয়াত হলেন। বিশ্বনাথপ্রতাপ সনিয়ার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন। একটা লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা পার্সেপশন তৈরি করলেন। গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।
প্রমাণ কিন্তু হল না।
আজ এদেশের শাসকদল (India-BJP) বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশে দুর্নীতি নামক অস্ত্রকে ব্যবহার করছে, একথা বলার জন্য তো তৃণমূল কংগ্রেস দলের সদস্য হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে-কোনও মানুষ বলবেন, বিজেপি এজেন্সিকে এবং তারপর সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে পারসেপশন তৈরির রাজনৈতিক বিপণন করছে। পূর্বপরিকল্পিত একটি চিত্রনাট্য তৈরি করা হচ্ছে। অনেকটা নেটফ্লিক্স অথবা প্রাইমে প্রদর্শিত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সিরিয়ালের মতো। শাসক দলের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা আছে। নেতৃত্বের হেজেমনি বা আধিপত্য আছে। আদালত থেকে সংবাদমাধ্যম— সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ আছে প্রবল। তাই তদন্ত কী বিষয়ে হবে সেটাও সুনির্বাচিত সিলেকটিভ।
আরও পড়ুন-খিদেয় ভুগছে ভারত, এটাই বিজেপির একমাত্র সাফল্য
এটাকে বলা হয় ব্যাক ক্যালকুলেশন। সর্বশেষ সিদ্ধান্তটা আগেই নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিজেপিকে সিংহাসনে বসতে হবে। বেশ। তার জন্য বিভিন্ন নেতা ও আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে এজেন্সিকে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও টার্গেট করতে হবে কারণ তিনিই দলের উত্তরাধিকারী। আবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অতএব তাঁর সাদা শাড়িতে কালি ছিটনোর জন্য তদন্ত শুধু নয় ধারাবাহিক সিরিয়ালের মতো তাঁর প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট-পরবর্তী বিধানসভা ভোট পর্যন্ত এ-প্রচার চালাতে হবে।
এটা রাজনীতি। দুর্নীতি অস্ত্র। তারপর প্রচারের মাধ্যমে আত্রমণাত্মক রাজনীতির বিপণন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানের বিজেপি (India-BJP) সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপম কেলেঙ্কারি নিয়ে সমস্ত বিরোধীপক্ষ একযোগে তদন্তের দাবি করলেও কেন তা নিয়ে কোনও তদন্ত হয় না? কেন বিজেপি (India-BJP) তা নিয়ে নীরব থাকে? ব্যাপম শব্দটির অর্থ বৈষয়িক পরীক্ষকমণ্ডল। ২০১৩ থেকে এই দুর্নীতি নিয়ে টানাপোড়েন। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় ২০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পড়ে। অভিযোগ, প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
এই তদন্ত নিয়ে সিবিআই বা এনফোর্সমেন্টকে কোনও অভিযানে সক্রিয় হতে দেখেছেন? বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, এই দুর্নীতিতে জড়িত নানান ‘ভিক্টিম’ অভিযোগকারী প্রায় ৪৮ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অসমর্থিত সূত্র বলছে— বেসরকারি পরিসংখ্যান— প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়েও কি কোনও তদন্ত হয়েছে?
ছত্তিশগড়ে বিজেপি (India-BJP) যখন ক্ষমতাসীন ছিল তখন রেশন কেলেঙ্কারি হয়। কর্ণাটকে ইয়েদুরাপ্পা সরকারের বিরুদ্ধে খনি ও আকরিক লোহার দুর্নীতি হয়। মধ্যপ্রদেশ অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল মানি লনডারিংয়ের ওপর ৩৬ পাতার রিপোর্ট দেয়। আর ফ্রান্সের সঙ্গে ব্যাফেল চুক্তি নিয়ে তো সংসদ পর্যন্ত সরগরম হয়।
কিন্তু দুর্নীতি দমনটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হল দুর্নীতিটা কার? বিজেপির বিরুদ্ধে গোটা দেশে একটিও তদন্ত হয় না। রাজ্যে রাজ্যে কোনও অভিযোগ নেই তা তো নয়। এমনকী আদালতের পরামর্শ পর্যন্ত আছে। খোদ উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত হয়নি।
তাই দুর্নীতি এদেশে কেন গোটা দুনিয়ার কাছেই নতুন কোনও শব্দ নয়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এবং সিসারো দুর্নীতি শব্দটির প্রথম উল্লেখ করেন। বিশেষণের প্রয়োগে শব্দটির অর্থ ছিল ‘সমূলে বিনষ্ট হওয়া’। তা সেই দুর্নীতির পক্ষে আমরা কেউ সওয়াল করছি না।
দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু প্রমাণ নেই শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে প্রচারের বিপণন। সে তো রাজনীতি। সে তো ষড়যন্ত্র। সে তো মমতা-সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক অবভাস তৈরির ষড়যন্ত্র। এই রাজনীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বরকে জোরালো করতে হবে। এই মুহূর্তে সেটাই আমাদের বাংলার প্রতিবাদ। বাংলার কর্তব্য।