তিরুপতি বালাজি মন্দির (Tirupati Balaji Temple)। বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরও বলা হয়। হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থক্ষেত্র। অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার অন্তর্গত তিরুপতির তিরুমালা শৈলশহরে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে ধনী এই বিষ্ণু মন্দিরটি। তিরুমালা পর্বতের সাতটি চূড়া। শেষাদ্রি, নীলাদ্রি, গরুড়াদ্রি, অঞ্জনাদ্রি, বৃষভাদ্রি, নারায়ণাদ্রি ও ভেঙ্কটাদ্রি। সপ্তম চূড়া ভেঙ্কটাদ্রির উপরেই সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এই মন্দির।
প্রধান উপাস্য দেবতা বিষ্ণুর অবতার বেঙ্কটেশ্বর। প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ দর্শনার্থী আসেন। মন্দিরটি আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। দেখা যায় দ্রাবিড়ীয় শিল্পশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। দেওয়ালে নানারকম লিপি খোদিত এবং চিত্রিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সমস্ত লিপির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত গুরুত্ব আছে। পার্বত্য মন্দির এবং নিচের তিরুপতি ও তিরুচানুরের মন্দিরগুলি মিলিয়ে লিপির সংখ্যা প্রায় এক হাজারেরও বেশি। আগে ছিল আরও। তবে আবিষ্কারের আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।
পাশাপাশি প্রায় ৩০০০ তাম্রলিপি রয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে। জানা গেছে, এগুলিতে তাল্লাপাকা আন্নামাচার্য ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের তেলুগু সংকীর্তন খোদিত রয়েছে। সংগীততত্ত্ব ছাড়াও লিপিগুলি তেলুগু ভাষার ঐতিহাসিক ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের মূল্যবান উৎস।
তিরুমালার (Tirupati Balaji Temple ) এই মন্দিরটি বিশেষ গৌরব অর্জন করেছিল দক্ষিণ ভারতের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায়। যেমন পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, কডবরায়, যাদবরায়, তেলুগু চোল, তেলুগু পল্লব, বিজয়নগরের রাজন্যবর্গ সঙ্গম, সালুব ও তুলুব রাজবংশ। পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তাঁরাই তিরুমালা ও তিরুপতির মন্দিরগুলির দেওয়ালে বিভিন্ন লিপি খোদাই করে যান।
মন্দিরে আছে তিনটি প্রবেশদ্বার। এই দ্বারগুলো পেরিয়েই বাইরে থেকে মন্দিরের গর্ভগৃহে যাওয়া যায়। প্রথম প্রবেশদ্বারের নাম ‘মহাদ্বারম্’বা ‘পদিকাবলি’। এটি চত্বরের বাইরের প্রাচীরে অবস্থিত। দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারটির নাম ‘বেন্দিবাকিলি’ বা রৌপ্যদ্বার। গর্ভগৃহে প্রবেশের দরজাটির নাম হল ‘বঙ্গারুবাকিলি’ বা স্বর্ণদ্বার। এটা তৃতীয় প্রবেশদ্বার। এই পথের দুই পাশে দ্বারপাল জয় ও বিজয়ের দুটি তাম্রমূর্তি রয়েছে। মোটা কাঠ দিয়ে তৈরি এই দরজাটির উপর সোনার গিলটি করা পাতে বিষ্ণুর দশাবতারের ছবি খোদিত রয়েছে।
সারাবছর বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় মন্দিরে। তার মধ্যে অন্যতম দৈনিক অনুষ্ঠান। দৈনিক সেবাগুলির মধ্যে রয়েছে সুপ্রভাত সেবা, তোমল সেবা, অর্চনা, কল্যাণোৎসবম্, দোলোৎসবম্, অর্জিত ব্রহ্মোৎসবম্, অর্জিত বসন্তোৎসবম্, সহস্র দীপালংকারণ সেবা ও একান্ত সেবা।
বিনামূল্যে মন্দির দর্শন করা যায়। অবশ্য তার জন্য নির্দিষ্ট লাইনে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্য বড় হল ঘরের সুব্যবস্থাও আছে। দর্শনার্থীদের জন্যে বিনামূল্যে অন্নভোগ, পানীয় জল, চা, বাচ্চাদের জন্য দুধ, টয়লেট ও প্রয়োজনে আপৎকালীন চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আলাদা লাইনে বিগ্রহ দর্শন করাবার অতিরিক্ত ব্যবস্থা আছে।
আরও পড়ুন-উত্তর-দক্ষিণ একসঙ্গে একভাবেই থাকবে
এ-ছাড়া বিশেষ কুপন কেটে তার বিনিময়েও দেবদর্শন করা যায়। বিভিন্ন দামের কুপন মন্দির সংলগ্ন কাউন্টারে পাওয়া যায়। অনলাইনেও এই কুপন বুক করার ব্যবস্থা আছে। দর্শন শেষে কুপন দেখিয়ে পাওয়া যায় বিশেষ লাড্ডু প্রসাদ।
মন্দির (Tirupati Balaji Temple) ছাড়াও পাহাড়ের উপর আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। সেগুলো ঘুরে দেখা যায়। তার জন্য আছে বাস। ভাড়া করা যায় গাড়িও। সময় বের করে ঘুরে আসতে পারেন। স্থানীয় মানুষরা অতিথিপরায়ণ। সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ছাড়ে হাওড়া-পুদুচেরি উইকলি এক্সপ্রেস এবং সাঁতরাগাছি থেকে তিরুপতি উইকলি এক্সপ্রেস। এ-ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাড়ে আরও কয়েকটি ট্রেন। সময়সূচি দেখে নেওয়া যেতে পারে। তিরুপতি স্টেশন থেকে তিরুমালা পর্বতের উপরে শ্রী বালাজি মন্দির দু’ভাবে যাওয়া যায়। প্রথমত, গাড়িতে যাওয়া যায় তিরুমালা পর্বতের উপরে। তিরুপতি রেল স্টেশনের ১ নম্বর প্লাটফর্মের বাইরের দিক থেকে ছাড়ে সরকারি এবং বেসরকারি বাস। কাটা যায় রিটার্ন টিকিট। এ-ছাড়াও আছে দিনরাতের গাড়ি সার্ভিস।
পাশাপাশি হেঁটেও তিরুমালা পর্বতের উপরে ওঠা যায়। সেটা যাত্রীর শারীরিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। অসুস্থ শরীরে যাতে কেউ পায়ে হেঁটে না ওঠেন, সেই অনুরোধ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। যাত্রীদের সঙ্গে ভারী মালপত্র থাকলে হেঁটে ওঠা সম্ভব হয় না। সেইজন্য স্টেশন লাগোয়া বিষ্ণু নিবাসে লাগেজ জমা রাখার ব্যবস্থা আছে। দুটি প্রবেশপথের কোনটা দিয়ে যাত্রীরা উঠছেন জানালে, তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানাম বা টিটিডি কর্তৃপক্ষ তিরুমালা পর্বতের দ্বার সংলগ্ন অফিসে মালপত্র দায়িত্বের সঙ্গে বিনামূল্যে পৌঁছে দেন। নিজের ব্যাগপত্র লাগেজ-কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হয় শেষ ধাপ পেরোবার পর। হেঁটে ওঠার দুইটি পথেই শৌচাগার, বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং বিনামূল্যে খাদ্যশিবিরের সুবন্দোবস্ত আছে। পুরো পথটায় ছাউনি আছে। তাই সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় রোদবৃষ্টিতে অসুবিধে হয় না। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে দেওয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবা। রাস্তায় আছে নোটিশ বোর্ড। তার মাধ্যমে তীর্থযাত্রীদের জানানো হয় বিভিন্ন দরকারি বিষয়।
কোথায় থাকবেন?
তিরুমালা পাহাড়ে ওঠার পর টিটিডি-র অফিসে যোগাযোগ করতে হবে রেস্ট হাউস নেবার জন্য। দিনে বা রাতের যে কোনও সময়। যতক্ষণ তীর্থযাত্রীদের বণ্টনের জন্য রেস্ট হাউসের রুম খালি থাকে, টিটিডি-র অফিস ততক্ষণ খোলা থাকে। কাজেই যে কোনও সময়ে পৌঁছনো যাক না কেন, রুম খালি থাকলে পাওয়া যেতে পারে। নাহলে ফ্রি ডরমিটরিতে থাকা অথবা অপেক্ষা করা যায়। এখানে আছে ফ্রি লকারের বিশেষ ব্যবস্থা, স্নানের জায়গাও আছে। একলা তীর্থযাত্রীকে ডরমিটরিতে রাখা হয়। লাগেজ রেখে নিশ্চিন্তে মন্দির এবং পাহাড় ঘুরে দেখা যায়। বিভিন্ন দামের রেস্ট হাউস আছে। তিরুপতিতে আধার কার্ড, পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক। নাহলে কোনও রেস্ট হাউস ভাড়া দেওয়া হয় না।