এ জয় বাঙালির। এ গর্ব বাংলার। যদিও আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে শিল্পী কিংবা শিল্পকে চিহ্নিত করা সঠিক নয়, তবু কিছু নাম কিছু জাতির কাছে এমনই গর্বের, তাঁকে বা তাঁদের নিজেদের বলে দাবি করার মধ্যে সীমাবদ্ধতার চেয়েও আত্মিকতা সোচ্চার হয়। প্রকট হয় শ্রদ্ধা আর প্রচ্ছন্ন থাকে ভালবাসা তা যতই পাগলামি মনে হোক না কেন! চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তেমনই একজন মানুষ যিনি তাঁর কাজ দ্বারা শুধু নিজেকে নন, স্বজাতিকেই বিশ্বমঞ্চে বারংবার গর্বিত করেছেন, আজও করছেন, প্রয়াণের এতগুলো বছর পরেও। এ স্বীকৃতি আরও বিশেষ, কারণ এই বছরটি পরিচালকের জন্মশতবর্ষ। শিবের গীত গাওয়া কিন্তু আবেগমথিত হয়েই! সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফিল্ম ক্রিটিকসের (ফিপরেস্কি) বিচারে, ‘পথের পাঁচালী’ (Pather Panchali) ভারতের সর্বকালের সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছে। সেই ভারত যেখানে শতাধিক ভাষাভাষী মানুষ আছেন। শুধু ভাষা নয়, রুচি, সংস্কৃতি, ভাবনা, জীবনযাপনও যেখানে বৈচিত্রময়। আছে একাধিক আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রিও। এবং শিল্প সৃষ্টিতে কেউ কম যান না! সবাইকে পিছনে ফেলে জয়ী হয়েছে বাংলা ছবি ‘পথের পাঁচালী’! তাই গর্ব আকাশছোঁয়া।
অস্কার-জয়ী পরিচালকের এটিই ছিল প্রথম ছবি। ১৯৫৫ সাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক দশকও হয়নি, বরেণ্য পরিচালক তাঁর আন্তর্জাতিক মনন নিয়ে ছবিটি বানিয়ে ছিলেন তুমুল লড়াইয়ের পর। এ লড়াইয়ের রক্তক্ষরণ বাইরে ধরা পড়ে না। যন্ত্রণার খবর বাইরে প্রচারিত হয় না! সে খবর জানতে পারেন শুধু ছবির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা আর পরিচালকের ঘনিষ্ঠ জনেরা। ছবির জন্য প্রযোজক জোগাড় করা, অর্থাভাবে ছবির কাজ বারংবার থমকে যাওয়া, পরিচালকের হার না মানা অদম্য আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি না পড়া, সিনেমা সম্পূর্ণ করার আর্জি নিয়ে পৌঁছে যাওয়া প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে— এসবই আজ গল্পকথা কিংবা আরও ছবির রসদ! কিন্তু ফলশ্রুতি যা, তা শুধুই গর্বের, আলোর, আনন্দের আর আবেগের। এই আবেগের আরও একটি অনন্য কারণ হল, যতই শ্রী সত্যজিৎ রায় আদ্যন্ত একজন আন্তর্জাতিক মানের মানুষ হন না কেন, তাঁর প্রথম শিল্প সৃষ্টির বীজ কিন্তু বাংলার মাটিতেই বোনা। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’কে নিজের প্রথম ছবির বিষয় হিসাবে নির্বাচন করার সাহস অতি বড় পরিচালকও কিন্তু দেখাবেন না! সেই সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন। আর তাই সেই প্রথম সবিস্তারে গ্রাম-বাংলার জীবন-যাপন, গ্রামের মানুষদের রোজনামচা আর বাংলার মমতাময়ী-মোহময়ী রূপকে ক্যামেরায় ক্যাপচার করা! তদানীন্তন ভারতীয় সিনেমার যাবতীয় ব্যাকরণকে ভেঙে দিয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ (Pather Panchali)। সিনেমা যেমন শিল্প, তেমন তো বিনোদনও। আটপৌরে গ্রামও সাহিত্যের পাশাপাশি যে বিনোদনের রসদ হতে পারে তা কে দেখতে পেয়েছিল! আর বিনোদনও যে বাস্তবে এমন বুকে মোচড় ধরাতে পারে তাই বা কে বুঝতে পেরেছিল, শ্রী সত্যজিৎ রায়ের আগে! তাঁর হাত ধরেই ‘নিওরিয়ালিজম’-এর দুনিয়ায় সাবালক পদার্পণ ঘটেছিল ভারতীয় সিনেমার।
আরও পড়ুন: ভাবা যায়! গণধর্ষণের বিনিময়ে কি না চাকরি
হ্যাঁ। সবটাই ব্যতিক্রমী। কথায় আছে, যে সয়, সে রয়! তিনি সয়েছিলেন, তাই তিনি আজও আছেন। যতদিন বাঙালি থাকবে তিনিও নিজ দাপটে থেকে যাবেন! শুধু ‘পথের পাঁচালী’ই (Pather Panchali) নয়, প্রথম দশটি ছবির তালিকায় স্থান পেয়েছে তাঁর আরও একটি ছবি, ‘চারুলতা’, এবং এ ছবিও সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন, বাঙালির আরও এক গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বড় গল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে। সব মিলিয়ে ‘সত্যজিৎ-জাদু’তে মুগ্ধ বিশ্ব-চলচ্চিত্র। পাশাপাশি আরও বরেণ্য দুই বাঙালি পরিচালকের কাজও স্থান পেয়েছে এই তালিকায়। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং মৃণাল সেনের ‘ভুবনসোম’। গত বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) বিশেষ এই তালিকা প্রকাশ করেছে ফিপরেস্কি-ইন্ডিয়া বিভাগ। তালিকাতে স্থান পেয়েছে মোট দশটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে পাঁচটি হিন্দি, তিনটি বাংলা, একটি মালয়ালম ও একটি কন্নড় ভাষার ছবি আছে। উল্লেখ্য, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় তামিল ও তেলুগু ইন্ডাস্ট্রি থেকে কিন্তু কোনও সিনেমা এই তালিকায় স্থান পায়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস (ফিপরেস্কি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। কান চলচ্চিত্র উৎসব, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব, টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে তাঁরা পুরস্কার প্রদান করেন। এই তালিকাটি তৈরি হয়েছে ভোটাভুটির মাধ্যমে। সংগঠনের তিরিশ জন সদস্য অত্যন্ত গোপনে ভোটদান করেন। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস ঘেঁটে এই ভোটাভুটি ও নির্বাচন সংঘটিত হয়। প্রথম স্থান পায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫)। দ্বিতীয় স্থানে, মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)। শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ও ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত এই ছবিটিও আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বকীয়তার সাক্ষ্য বহন করে। তৃতীয় নামটিও একজন বাঙালি পরিচালকের। তবে ছবিটি হিন্দি, পরিচালক মৃণাল সেনের ‘ভুবনসোম’ (১৯৬৯)। অভিনয়ে ছিলেন উৎপল দত্ত ও সুহাসিনী মূলে। চতুর্থ স্থানে আছে আদুর গোপালকৃষ্ণনের মালয়ালাম ছবি ‘এলিপ্পাথায়াম’ (১৯৮১), পঞ্চম স্থান পেয়েছে গিরিশ কাসারাভাল্লির কন্নড় ছবি ‘ঘটশ্রদ্ধা’ (১৯৭৭), ষষ্ঠ স্থানে এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ (১৯৭৩), সপ্তম স্থানে ফের সত্যজিৎ রায়, ‘চারুলতা’ (১৯৬৪), অষ্টমে আছে শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪), নবম স্থানে গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’ (১৯৫৭) এবং দশম স্থান পেয়েছে রমেশ সিপ্পির আইকনিক ছবি, ‘শোলে’ (১৯৭৫)।