ভবানীপুরের বিরোধী প্রার্থী নাকি একদা তৃণমূল ভবনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন দলনেত্রীর দেখা পাওয়ার জন্য। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার হতাশা থেকেই নাকি তাঁর পদ্মশিবিরে যোগদান! আর সেই সূত্রেই তিনি এবার হারের হ্যাটট্রিকের মুখে। লিখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিজন সরকার
‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।’
আরও পড়ুন-তথাগত রায়ের টুইটের উত্তরে তাকে খোঁচা বাবুল সুপ্রিয়র
কলকাতার ভবানীপুর আদতে মিনি ভারত। এখানকার ৪০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা অবাঙালি। পাঞ্জাবি, বিহারি, মাড়োয়ারি, গুজরাতি, উত্তর প্রদেশের বহু মানুষের বাস এই বিধানসভা কেন্দ্রটিতে। কাজের সন্ধানে বাংলায় এসে তাঁরা দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের বাসিন্দা এখানে থাকতে থাকতে, এখানে কাজ করতে করতে তাঁরা বাংলার মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। সবমিলিয়ে ভবানীপুর যেন এক মিনি ভারত।
২০১১ সালে এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন সুব্রত বক্সি। জিতেছিলেন প্রায় ৪৯ হাজারের বেশি ভোটে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সে-বছরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে জয়লাভ করলেন ৫৪,২১৩ ভোটে। ২০১৬ সালে এই ভবানীপুর কেন্দ্র থেকেই জয়লাভ করলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আবারও, এই ২০২১-এ এই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছুদিন আগেই তৃণমূল কংগ্রেসের শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এই কেন্দ্রে পদ্মশিবিরের অভিনেতা-প্রার্থীকে হারিয়েছেন ২৮ হাজার ৭১৯ ভোট। আসলে, ২০১৬ সালে দীপা দাসমুন্সিকে এই কেন্দ্রে ২৫ হাজার ৩০১ ভোটে হারানোর পর ফের লড়াইয়ের ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী। এবার লড়াই গেরুয়া পার্টির সঙ্গে সরাসরি।
তাদের প্রার্থী বিশিষ্ট আইনজীবী। কানাঘুষো শোনা যায়, এই মহিলা-প্রার্থী নাকি একসময় তৃণমূল ভবনে দলনেত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে আসতেন মাঝে-মধ্যে। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দলনেত্রীর সঙ্গে তাঁকে কেউ দেখা করিয়ে দেননি। অবশেষে তিনি হাত ধরলেন বিজেপির এক নেতার। আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের সঙ্গে। বাবুলের অনুরোধেই তাঁর বিজেপিতে যোগদান।
তারপর থেকেই নানা জায়গায় বিভিন্ন মঞ্চে দেওয়া ভাষণে তাঁর দলনেত্রী ও মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা শুরু হল।
দু-দুবার হেরেছেন এই প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। একবার কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে। আর একবার বিধানসভা নির্বাচনে। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এবার ভবানীপুর কেন্দ্রে তিনি হারের হ্যাট্রিকের মুখে।
আরও পড়ুন-পাহাড় থেকেই দেবের দুই ছবির ট্রেলার রিলিজ
এমন একটা সময়ে এই নির্বাচন, যখন বিশ্ব করোনা-অতিমারির সঙ্গে লড়াই করছে। ১৯৯১-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে একের পর ভোটযুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ললাটে জয়টিকা এঁকে দিয়েছেন ভবানীপুরে সাধারণ মানুষ। তাঁরাই এবার তাঁকে প্রার্থী হিসেবে পেয়েছেন যখন তিনি টাইম ম্যাগাজিনের বাছাই করা একশো জন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বের অন্যতম। যখন কন্যাশ্রী থেকে শুরু করে তাঁর একের পর এক জনমুখী প্রকল্প বিশ্বের মঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেছে, যখন তাঁর সাম্প্রতিকতম প্রকল্প ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় রোল মডেল হতে চলেছে। এই প্রকল্পগুলি তো নিছক প্রকল্প নয়, নারী-উন্নয়নে এক-একটা সোপান। নারীপাচার রোখা থেকে শুরু করে মেয়েদের স্কুলছুট হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো, সব কিছুর নেপথ্যে এই প্রকল্পগুলোর অবদান। ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদভবন আর নিজের বাসভবন তৈরিতে ব্যস্ত, তখন সমপরিমাণ অর্থ, ওই ২০ হাজার কোটি ব্যয় করতে উদ্যোগী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বাংলার মা-বোনেদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী করে তোলার লক্ষ্যে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন-ছুটে আসছে ‘শব্দবাণ’, সাহস থাকলে জব্দ করুন
কলকাতার বুক থেকে উঠে-আসা জননেত্রী আজ দেশনেত্রী। বিরোধী শিবিরে অগ্রনায়িকার মুখ আর বিজেপির কাছে ঘুম ছুটিয়ে দেওয়া বাঘিনি। তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর থেকে জনকল্যাণের লক্ষ্যে নিজেকে নিত্য নিয়োজিত রেখেছেন। সরকার যে পরিষেবা নিয়ে দরজায় কড়া নাড়তে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি মানুষ। কিন্তু মমতাস্পর্শে সেটাও এখন বাস্তব। দেউয়াপাচমির কয়লা উত্তোলন, তাজপুরে বন্দর— সবমিলিয়ে বাংলার অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের জোয়ার, সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পেও আসছে নতুন বিনিয়োগ।
শুধু রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নয়, দলীয়স্তরেও নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছেন দলনেত্রী। ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতিকে সামনে রেখে দলের নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদল ঘটিয়েছেন তিনি। শাখা সংগঠনগুলিতেও নতুন মুখ এনে ঢেলে সাজার কাজটি করেছেন তিনি।
স্বাস্থ্যসাথী রাজ্যের চিকিৎসা-পরিষেবায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। রাজ্যের মানুষ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে চিকিৎসা করাতে গেলেও এই কার্ডের সুবিধা পাচ্ছেন। আবার রাজ্যের চিকিৎসা-পরিষেবা উন্নত হওয়ায় পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে যেমন রোগীরা আসছেন, তেমনই ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশের রোগীরাও আসছেন এ রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে।
আরও পড়ুন-বিজেপি সরকারের কীর্তি, সামান্য লেখার ভুলে গ্রেফতার দুই সাংবাদিক
গরিব মানুষের জন্য নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা, ফি ছাড়াই শিক্ষা, বিনামূল্যে চাল— সবমিলিয়ে রাজ্যবাসীর প্রতিদিনের প্রকৃত সাথী মা-মাটি-মানুষের সরকার। এই আবহে ভবানীপুরের ভোটাররা বাঙালি হোন বা অন্যভাষা-ভাষী, তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় যাই-ই হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবতে যাবেন কেন! বিশেষত ভবানীপুরের মা-বোনেরা তো এই সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন নীতির প্রত্যক্ষ সুবিধা লাভ করেছেন। তাই তাঁদের ভোটও সংহত হয়ে জননেত্রীর ভোট ব্যাংককে আরও মজবুত করবে। এ কথা বুঝতে গেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার দরকার পড়ে না।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এই আকাঙ্ক্ষা যখন একদিকে বাস্তবায়িত হচ্ছে নানাবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে, তখন দেশের নিরাপদতম শহর হিসেবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যে স্বীকৃতি পাচ্ছে কলকাতা মহানগর। সেই কলকাতার বুকেই ভাবনীপুর বিধানসভা কেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার ভোটাররা নিশ্চিন্তে নিরাপদে জীবনযাপনের স্বস্তিলাভে খুশি। সেই খুশিরই প্রকাশ, প্রতিফলন ঘটতে চলেছে ইভিএম-এ।
আরও পড়ুন-ভবানীপুর উপনির্বাচন: তৈরি তৃণমূল নেত্রীর প্রচারের সূচি
অন্যদিকে প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। তিনি ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের পাঠানো নোটিস ছিঁড়ে ফেলার কথা বলেছেন। দেশের স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে ধরে নেওয়ার যে গেরুয়া-সংস্কৃতি, তারই বহিঃপ্রকাশ এরকম অবমাননাকর উক্তি। মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয়, দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে চুরমার করে দেওয়াতেই যে এদের বেশি আগ্রহ, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
গোটা রাজ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির হুঙ্কার এখন আর শোনাই যাচ্ছে না।
পরিবর্তে, ভবানীপুর-সহ সমগ্র রাজ্যের আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই আওয়াজ।
‘জয় মা দুর্গা।’