সব দেশেরই চেতনাসম্পন্ন, সাহিত্যপ্রেমী, জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে তাঁদের ভাষার বইমেলা হল একটা আবেগ। এই মেলায় তাঁরা খুঁজে পান মনের আরাম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তাই হয় ছোট-বড় বইমেলার আয়োজন। আমাদের রাজ্যে সরকারি-বেসরকারি অগুনতি বইয়ের মেলা হয়। জেলায় জেলায় সেই সব মেলায় মানুষজন প্রাণের তাগিদে আর হরেক কিসিমের বই-টানে সপরিবার, সবান্ধব হাজির হয়ে যান। বইমেলামুখী হন না, এমন মানুষ, বিশেষত কোনও বাঙালি আছেন বলে তো মনে হয় না। নেহাতই শরীর অসমর্থ হলে তবেই কেউ মেলা থেকে মুখ সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এটাই বইমেলার বড় বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনও মেলার ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না। বাংলায় তো বারো মাসে তেরো পার্বণের বাহুল্য আছেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চোদ্দো পার্বণ প্রাণাধিক বইমেলা। এ কথা দুই বাংলার ক্ষেত্রেই একশো ভাগ প্রযোজ্য, এটাও লেখা বাহুল্য।
আরও পড়ুন-পেনাল্টি মিস করে ইংল্যান্ডকে ডোবালেন কেন
এপারের সবচেয়ে জনপ্রিয় হল কলকাতা পুস্তকমেলা। তার বয়স তো অর্ধশতক ছুঁতে চলল। এর পরেই ইদানীং জনপ্রিয়তার নিরিখে এগিয়ে এসেছে কলকাতার বাংলাদেশ বইমেলা। ক’দিন আগেই শুরু হওয়া এই মেলাও পড়ে গেল দশম বর্ষে। তবে মহামারী জনজীবনে অকস্মাৎ থাবা বসানোয় মাঝে দুবছর সব মেলা, জনসংযোগ গোটানো ছিল বহিরঙ্গে। তবে তা ছিল হৃদয়কোণে জাগরুক। বিশেষত বইমেলা। মহানগর থেকে বাংলার প্রত্যন্ত জেলা ফের জেগে উঠেছে মেলা ও নানাবিধ পার্বণে। জানুয়ারির শেষে আসন্ন কলকাতা বইমেলার প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। তার মধ্যেই ট্রায়াল রান হিসেবে আয়োজিত হল বাংলাদেশ বইমেলা। আজই তার শেষ দিন।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবার এমপি কাপের উদ্বোধন, রাজনীতি নয়, এখন শুধু ফুটবল, মঞ্চ মাতালেন হানি সিং
বই মানুষকে সম্পন্ন করে, সমৃদ্ধ করে। বই মানুষের হৃদয়সঙ্গী। বই এমন একটি উপকরণ, যা মানুষকে সহজে আলোকিত করে তুলতে পারে শিক্ষা, নৈতিকতা, আদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্যসংস্কৃতি–সহ সব কিছু দিয়ে। তাই বইমেলা ছিল, আছে এবং থাকবেও। এই মেলায় মানুষ তো থাকবেই। দশদিনের বাংলাদেশ বইমেলাতেও ছিল। আরও যেটা বলার কথা, এবার মেলা ঠাঁইবদল করে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা বইয়ের পীঠস্থান কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। এখানে কবি-সাহিত্যিক থেকে ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী, ছেলে-বুড়ো, শিশু ও মহিলা, সর্বোপরি প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের প্রায় নিত্য আনাগোনা। তাই তো কলেজ স্কোয়ারে বাংলাদেশ বইমেলার উদ্বোধনী আসরে এসে ও দেশের শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে গেলেন, এবার মেলা উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে।
আরও পড়ুন-EXCLUSIVE সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক সাকেত গোখেল, মেঘালয়-গোয়া-ত্রিপুরায় দলের স্ট্র্যাটেজি জানতেই গ্রেফতার
কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার বয়স হয়ে গেল দশ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে কলকাতা বইমেলা হয়নি বহু চিঠিচাপাটি চালিয়েও। তবে শিগগিরই বাংলাদেশেও পশ্চিমবঙ্গ বইমেলা হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। আভাস মিলেছে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণির কথায়। কলেজ স্কোয়ারে দশম বাংলাদেশ বইমেলা শুরুর অনুষ্ঠানে। এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও ছিলেন উদ্বোধনে। তিনিও সেদিন আশাপ্রকাশ করেন, এ রাজ্যে যেমন বাংলাদেশ বইমেলা হচ্ছে, বাংলাদেশেও এখানকার প্রকাশকরা তেমন বইমেলা করুন। সেখানকার মানুষও এই বাংলার বই পড়ুন। তাঁর ইচ্ছাকে রূপ দিতে চান জানিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের ওখানেও পশ্চিমবঙ্গ বইমেলা হবে। আমাদের প্রকাশক, লেখক সকলের সাহায্য পাবেন। মঞ্চে থাকা দে’জ পাবলিকেশনের কর্ণধার সুধাংশু দেও বাংলাদেশে বইমেলা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ব্রাত্য বসুর মতে, পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যখন পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করছে, নারীবিদ্বেষ যখন বেড়ে চলেছে, তখন দুই বাংলা অর্থাৎ একটি দেশ এবং একটি রাজ্যর শীর্ষে আছেন দুজন নারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা আন্দোলনপ্রসূত বাস্তবতা থেকে উঠে এসেছেন। তাঁরা দুই বাংলাকে পথ দেখাচ্ছেন। চক্রান্ত, কুৎসা, কলরব থাকবে। সব কিছু অতিক্রম করে আমাদের এগোতে হবে। তাই নিজের দিকে তাকান, নিজেকে চিনুন। নিজেকে চিনতে বইয়ের বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণির কথায়, পশ্চিমবঙ্গকে বিদেশ মনে হয় না। দুই দেশের সম্পর্ক নিবিড়। কলেজ স্ট্রিট হল কলকাতার বইপাড়া। চারিদিকে এত নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমন একটি জায়গায় এই বইমেলা সত্যিই আনন্দের। কলেজ স্কোয়ারই হল বইমেলার আদর্শ জায়গা।
এক সময় বাংলাদেশি বইয়ের প্রাপ্তিস্থান ছিল কলকাতা বইমেলা। পরে পাঠক সমাবেশ ও পত্রভারতীর যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশি বইয়ের স্থায়ী ঠিকানা হয় কলেজ স্ট্রিট। এর পরই বাংলাদেশি বইয়ের পশরা নিয়ে ২০১১ সালে কলকাতায় শুরু হয় বাংলাদেশ বইমেলা। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার মূল উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসা নয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যাতে বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক-কবিদের সঙ্গে উদীয়মান লেখকদেরও চিনতে পারেন সেটাই বাংলাদেশ বইমেলার মূল উদ্দেশ্য।’
আরও পড়ুন-অলিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট হলেন উষা
এবারের বাংলাদেশ বইমেলা চলাকালীনই ৫ ডিসেম্বর কলেজ স্ট্রিটের বিদ্যাসাগর টাওয়ারে দে’জ পাবলিশিংয়ের বইঘরে সূচনা হল বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশনীর বই বিপণনের। উদ্বোধন করে বাংলাদেশের কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘আজ কলকাতায় বাংলাদেশের বইয়ের পাকা ঠিকানা হল। খুলে গেল বাংলাদেশের বই দেখা ও কেনার দ্বার। আসুন, আমরা আজকের এই শুভদিনে নতুন করে বলি, বই কিনি।’ এর আগে কলকাতার পত্রভারতী চালু করে বাংলাদেশের অন্যপ্রকাশ বুক কর্নার। সেখানে মেলে দুই বাংলারই বই। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাংলা বইয়ের আদান-প্রদান ও যৌথভাবে প্রকাশ করাই অন্যপ্রকাশ বুক কর্নারের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দুই সংস্থা যৌথভাবে গঠন করে বই প্রকাশ ও বিক্রির জন্য নতুন সংস্থা ‘বই সাঁকো’। চুক্তি হয়েছে একে অন্যের বই প্রকাশের। নকল বইয়ের মুদ্রণরোধে যৌথ উদ্যোগও নিয়েছে দুই সংস্থা।
আরও পড়ুন-জনসংযোগ যাত্রা মন্ত্রী উদয়নের
বাংলাদেশ বইমেলায় অংশ নিয়ে ওপারের প্রকাশকরা খুূবই খুশি। কারণ কলকাতার বিভিন্ন বয়সি পাঠকদের কাছে বাংলাদেশি বইয়ের কদর বেড়েছে। ফলে ভিড় জমে বিভিন্ন স্টলে। এবারের বাংলাদেশ বইমেলা উৎসর্গিত করা হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে। মেলায় বঙ্গবন্ধু কর্নার ছাড়াও ছিল মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বহু বই। আর সেই সব বইয়ের প্রতিই ঝোঁক ছিল কলকাতার সব বয়সি পাঠকের। চাহিদা ছিল নজরুলের বই, বিজ্ঞান এবং গবেষণাধর্মী বইয়ের। প্রকৃতপক্ষে, দুই বাংলার সেতুবন্ধনের কাজ করল বই এবং বইমেলা।
বাংলাদেশের বই নিয়ে ১০ দিন প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা গেল এপারের বাঙালি পাঠককুলের মধ্যে। মাঝে আছে কাঁটাতারের বেড়া। আছে সীমান্ত প্রহরা, ভিসা–পাসপোর্টের আইনি বিধি। তবু দুই বাংলার মানুষ এক সুরে মাতে, একসঙ্গেই বেদনায় জারিত হয়। ফলে এপারের মতো ওপারেও পড়শি বাংলার বইয়ের সম্ভার নিয়ে মেলা হলে তা যে প্রাণের আবেগে ভরে উঠবে, লেখাই বাহুল্য।