প্রদীপ দে সরকার: বারান্দায় বসে বাবা হয়তো লম্বা সিগারেট ধরিয়েছে। ঘরের ভেতর থেকেও তামাকের গন্ধ পাচ্ছে তুতুল। আগে বাবা মাঝেসাঝে দুয়েকটা ছোট সিগারেট খেত। এ ছাড়া সারাদিনে বেশিরভাগ সময়েই বিড়ি খেত। গন্ধটা বিচ্ছিরি লাগত তুতুলের। গা গুলিয়ে উঠত। বাড়িতে গাড়ি আসার পর বাবা বিড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। আর বড় গাড়ি কেনার পর থেকে বাবা বড় সিগারেট খায়। ওদের প্রথম গাড়িটা ছিল ছোট, প্রাইজে পাওয়া। বাবা তার কিছুদিন আগেই গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছিল। সেসব বছরদেড়েক আগের ঘটনা। ঠিকঠাক হিসেব করলে এক বছর সাত মাস। তুতুল তখন সবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
আরও পড়ুন-কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার মতো বাংলাদেশেও হতে পারে কলকাতা বইমেলা
কোথাও যেতে হলে সে গাড়িটায় মা আর তুতুল পেছনের সিটে বসত, দাদা বসত সামনের বাঁদিকের সিটে আর বাবা চালাত। খুব দূরে কোথাও যেতে হলে বাবা একজন ড্রাইভার ডেকে আনত। তখন বাবা বসত দাদার জায়গায় আর দাদাকে বাড়িতে রেখে যাওয়া হত।
পেছনের সিটে একটু চাপাচাপি করে বসলে তিনজন দিব্যি ধরে যেত। কিন্তু মা-বাবা বলত তাতে নাকি তুতুলের কষ্ট হবে। তুতুল বলত যে ওর কোনও অসুবিধে হবে না, তবুও ওরা শুনত না। বাবা বলত, পারফরম্যান্সের আগে নাকি খুব রিল্যাক্সড থাকতে হয়। কই, বাছাই পর্বের সময় যখন তুতুল বাসে চেপে ওই সি টিভি চ্যানেলের স্টুডিওয় যেত তখন কি ওর অসুবিধে হত? অডিশনের জন্য সারারাত জেগে বসে থাকতে হয়েছিল একটা স্টেডিয়ামের বাইরে। কী ঠান্ডা সেদিন। লাইন রাখার জন্য কম্বল মুড়ি দিয়ে স্টেডিয়ামের শেডের তলায় শুয়ে রাত কাটিয়েছিল ওরা। তুতুল তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, দাদা এইটে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ায় ওরা হি-হি করে কাঁপছিল সারারাত। তবুও তো পরদিন সকালে তুতলের পারফরম্যান্সে তার কোনও ছাপ পড়েনি।
আরও পড়ুন-পেনাল্টি মিস করে ইংল্যান্ডকে ডোবালেন কেন
দাদা ওর থেকে তিন বছর দু’মাসের বড়। এখন তুতুল সেভেনে, দাদা ক্লাস টেন। দাদা প্রথম দিকে বুঝতে চাইত না। বাড়িতে একা থাকতে হবে শুনলে কাঁদত। টলটলে জলে ভিজে যেত ওর বড় বড় চোখ দুটো। কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে তুতুলের মতো প্রতিভা ওর নেই। যাদের প্রতিভা নেই তাদের মানিয়ে নিতে হয়।
হঠাৎ সিগারেটের গন্ধটার জোর বাড়তে তুতুল ঘুরে তাকাল। বাবা সিগারেট টানতে টানতেই ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফোনে কথা বলছে, ‘না, না, এক লাখের কমে হবে না। … কেন বুঝতে পারছেন না, সি টিভি থেকে বলেই দিয়েছে আগামী দু’বছর মাঠেঘাটে যেখানে সেখানে গাইলে হবে না। … নামী হল হলে তাও আশি হাজারে ভেবে দেখতাম। কিন্তু সোনারপুরের মতো সাবার্বের এক অখ্যাত মাঠে অসম্ভব। … কী বলছেন, আপনাদের শরৎপল্লির মাঠে পণ্ডিত সুজয় সোম গান করে গেছেন … দেখুন, উনি ভারতবিখ্যাত গায়ক, দয়া করে কিংবা অন্যরকম প্রচারের আশায় দুটো গান গেয়ে দিতেই পারেন … ও, আচ্ছা, ঠিক আছে, ভেবে দেখুন। সম্ভব হলে জানাবেন, তবে বুধবারের মধ্যে পুরো টাকাটা অ্যাডভান্স পেয়ে গেলে শনিবার সন্ধে আটটার সময় ঠিক পৌঁছে যাব।… ও হ্যাঁ, আমাদের গাড়ির জন্য কিছু খরচা দেবেন … এই হাজার দুয়েক দিলেই হবে।’
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবার এমপি কাপের উদ্বোধন, রাজনীতি নয়, এখন শুধু ফুটবল, মঞ্চ মাতালেন হানি সিং
নতুন গাড়িটা কেনা হয়েছে এবছরেই। এটায় অনেক জায়গা। ড্রাইভার কাকু চালালেও অসুবিধে হয় না। পেছনের সিটে তিনজন খুব আরাম করে বসা যায়। একেবারে পেছনে আরও চারটে সিট আছে। ওখানে মা ব্যাগ, জলের বোতল, কফির ফ্লাস্ক রাখে। বাবা মাঝে মাঝে কফি আর বড় সিগারেট খায়। এখন বড় গাড়িতে দাদার যেতে কোনও অসুবিধে নেই। তবুও আজকাল দাদা আর যেতে চায় না। বলে পড়া আছে, কিংবা ট্যুইশন আছে। মা-বাবাও বলে ক্লাস টেনে ওঠার পর দাদার পড়ার চাপ বেড়ে গেছে। কে জানে? হয়তো সত্যিই পড়ার চাপ বেড়েছে, কিংবা হয়তো একা একা বাড়িতে থাকার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে দাদার। তুতুল ঠিক বুঝতে পারে না।
আসলে আজকাল তুতুল দাদাকে ঠিকমতো বুঝতেই পারে না। আগে দাদা ওর সঙ্গে কত গল্প করত, আজকাল আর তেমনটা করে না। খুব কম কথা বলে। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে। আগে যে কোনও জিনিস নিয়ে তুতুলের সঙ্গে ঝগড়া করত। এখন নিজে থেকেই তুতুল যা চায় দিয়ে দেয়। সেদিন নিজের শখের রং পেন্সিলগুলোও দিয়ে দিল। বলল, ‘বোনু, এগুলো তো তোর খুব পছন্দের। এগুলো তুইই রাখ।’
মা রান্নাঘর থেকে ডাকল, ‘খেতে দিয়েছি, সবাই চলে এসো।’
আরও পড়ুন-EXCLUSIVE সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক সাকেত গোখেল, মেঘালয়-গোয়া-ত্রিপুরায় দলের স্ট্র্যাটেজি জানতেই গ্রেফতার
তুতুলের কানে হেডফোন গোঁজা। সদ্য রিলিজ হওয়া ‘সুপারস্টার’ সিনেমার টাইটেল সঙটা শুনছিল। কাল কলামন্দিরে সি টিভির আয়োজনে একটা অনুষ্ঠান আছে। ওকে একটা গান গাইতে হবে। মা বলেছে কালকের অনুষ্ঠানে এই গানটা গাইতে।
কানে হেডফোন থাকলেও কিছুক্ষণ আগেই ও গানটা মিউট করে দিয়েছিল। একই গান বারবার শুনতে আর ভাল লাগে না। কিন্ত মা বড্ড জোর করে। বলে, ‘প্রত্যেকটা লাইন, প্রতিটি সুর, তার ভাঁজ, সব খুব খুঁটিয়ে তুলতে হবে। তবেই না পাবলিক খাবে।’
পাবলিক কী খাবে তুতুল বোঝে না। ওর এখন বড্ড খিদে পেয়েছে। মায়ের এক ডাকেই ছুটে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু গেল না। কারণ, তাতে ধরা পড়ে যাবে যে ও গান শুনছিল না। তাই চুপ করে বসে থাকল। বাবা এসে ওকে ঠেলা মারল, ‘কিরে, গানটা শুনেছিস তো ভাল করে? এখন চল, মা খাবার দিয়েছে।’ তুতুল হেডফোন খুলে রেখে উঠে পড়ল।
আরও পড়ুন-আজ পরীক্ষা দেবেন ৬,৯০,৬৩২, টেট বানচালে চক্রান্ত চলছে, অভিযোগ পর্ষদ সভাপতির
খাবার টেবিলে আজকাল তুতুলের জন্য স্পেশাল কিছু মেনু থাকে। আজ আছে চিকেন স্টু। মা দাদাকে বলল, ‘তোকেও একটু দিই।’ দাদা মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমার স্টু খেতে ভাল লাগে না।’
তুতুল জানে দাদা মিথ্যে কথা বলছে। দাদা গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে চিকেন স্টু খেতে খুব ভালবাসত। প্রথম যেদিন এ বাড়িতে শুধুই তুতুলের জন্য চিকেন স্টু হয়েছিল সেদিনটার কথা মনে আছে তুতুলের।
বছর দেড়েক আগে কলামন্দিরে সি টিভির গানের সুপারহিট রিয়েলিটি শো ‘সরগম’-এর প্রথম পাঁচ গায়ক গায়িকাকে নিয়ে দুর্দান্ত একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেটা ছিল ফাইনালের ঠিক আগের শনিবার। সেখানে ছিলেন ‘সরগম’-এর অন্যতম বিচারক, বিখ্যাত গায়ক-সুরকার যুধাজিৎ।
তুতুল সেদিন পরপর পাঁচটা গান গেয়েছিল। ‘মেরে ঢোলনা’ গানটা গাওয়ার পর যুধাজিৎ মঞ্চে উঠে জড়িয়ে ধরেছিলেন তুতুলকে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাইক হাতে বলেছিলেন, ‘বিস্ময় বালিকা নামটা আমি এমনি এমনি দিইনি। গানের দুনিয়ায় এমন প্রতিভা কদাচিৎ আসে। আগামী দিনে ওকে দিয়ে প্লেব্যাক গাওয়ানোর জন্য মিউজিক ডিরেক্টররা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। আমি কিন্তু সহজে কারও প্রশংসা করি না।’
আরও পড়ুন-জনসংযোগ যাত্রা মন্ত্রী উদয়নের
হল ভর্তি কত জ্ঞানী-গুণী মানুষ। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে এত বড় সুরকারের ঝুলি উপুড় করা প্রশংসা শুনে আনন্দে তুতুলের চোখে জল এসে গিয়েছিল। আনন্দে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল তুতুল। যুধাজিৎ স্যার স্বয়ং তুতুলকে জড়িয়ে ধরে রেখে মঞ্চ থেকে নামিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে এসেছিলেন।
তুতুলকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার বিস্ময় বালিকার যত্ন নেবেন। মাঝে মাঝে ওকে একটু চিকেন স্টু খাওয়াবেন। ওর শরীরে একটু বাড়তি এনার্জি দরকার। শরীরে এনার্জি থাকলে তবেই না সেটা গলায় ফুটে উঠবে।’
মা সেদিন রাতে বাড়ি ফিরেই চিকেন স্টু বানিয়েছিল। দু’পিস চিকেন ছিল ফ্রিজে। সেই দু’পিসের স্টু বানিয়ে তুলে দিয়েছিল তুতুলের হাতে। দাদা একবার বলেছিল, ‘মা, আমাকে দেবে না?’
মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, ‘শোনোনি, যুধাজিৎ কী বললেন? বোনুর এখন এগুলোর দরকার।’
আরও পড়ুন-বীরবাহার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দেখান
তুতুল একবার বলেছিল, ‘মা, এক পিস দাও না দাদাভাইকে।’
মা আবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, ‘তোমাকে যা দেওয়া হয়েছে সেটা চুপচাপ খাও। দাদাকে অন্যদিন ঠিক দেব।’
দাদা কিন্তু এরপর থেকে আর কখনও চিকেন স্টু খেতে চায়নি। দাদা ওর ক্লাসে ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হয়। আগে বাড়িতে কেউ এলেই দাদার খুব প্রশংসা করত। ফার্স্ট হলে দাদার পছন্দের মেনু তৈরি হত বাড়িতে। তুতুল গান গেয়ে নাম করার পর থেকে দাদার রেজাল্ট নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। তুতুল জানে এ-বছরে দাদা ফার্স্ট হয়েছে। অথচ যেদিন ওদের ক্লাসের রেজাল্ট বেরল সেদিনও দাদা চিকেন স্টু খেতে চায়নি।
খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমোনোর আগেও তুতুল এসব নিয়েই ভাবছিল। আগে ওকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন ওকে নিয়ে সবার কী মাতামাতি। কোনও টিভি চ্যানেলে ওর প্রোগ্রাম থাকলে কত লোক যে বাবা আর মাকে ফোন করে তার হিসেব নেই। সব কিছু মাঝে মাঝে কেমন যেন স্বপ্নের মতোই লাগে তুতুলের। ঘুমিয়ে পড়লেও স্বপ্নে দেখে ও মঞ্চে মাইক হাতে গান গাইছে আর হল ভর্তি লোক হাততালি দিচ্ছে, যুধাজিৎ স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ল্যাপ করছেন, থামস আপ দেখাচ্ছেন। কিন্তু হলের সেই ভিড়ে দাদাকে আজকাল আর খুঁজে পায় না তুতুল।
আরও পড়ুন-রাস্তা সারাতেও দিচ্ছে না রেল: টক টু মেয়রে গৌতম
অনেকদিন পর আজ দাদাও এসেছে ওদের সঙ্গে। কলামন্দির কানায় কানায় ভর্তি। ঠিক সেবারের মতোই। একেবারে সামনের সারিতে আরও অনেক গণ্যমান্য মানুষজনের সঙ্গে বসে আছেন যুধাজিৎ স্যার। দ্বিতীয় সারিতে বসেছে তুতুলরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই যুধাজিৎকে মঞ্চে ডেকে নিলেন সংগঠকরা। যুধাজিৎ মঞ্চে উঠে মাইক হাতে নিয়ে ওঁর সেই অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় বললেন, ‘বিস্ময় বালিকা। গানের দুনিয়ায় এমন প্রতিভা কদাচিৎ আসে। আগামী দিনে ওকে দিয়ে প্লেব্যাক গাওয়ানোর জন্য মিউজিক ডিরেক্টররা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। আমি কিন্তু সহজে কারও প্রশংসা করি না।’
শিউরে উঠল তুতুল। আজও ওর কথা মনে রেখেছেন যুধাজিৎ স্যারের মতো বিখ্যাত সুরকার! যুধাজিৎ এক মুহূর্তের জন্য থেমে আবার বললেন, ‘আমি মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি আমার বিস্ময় বালিকাকে।’
তুতুল উঠতে যাচ্ছিল, দাদা পাশ থেকে হাত টেনে ধরল। ও অবাক হয়ে দাদার দিকে তাকাতেই দাদা চোখের ইশারায় ওকে শান্ত হয়ে বসতে বলল। আবার নিজের সিটে বসে পড়ে তুতুল অবাক বিস্ময়ে দেখল উইংসের পাশ থেকে মাইক হাতে অন্য একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। যুধাজিতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই ধরল, ‘মেরে ঢোলনা’।
আরও পড়ুন-ঘুরিয়ে রাজনীতির কথা বলছেন কি বিচারপতি
গান শুরু হতেই গোটা হল ফেটে পড়ল হাততালিতে, যুধাজিৎ স্যারও হাততালি দিচ্ছেন। সব যেন ঠিক গতবারের মতোই, শুধু এ-বছরের মেয়েটির নাম তুতুল নয়।
কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল গলার কাছে, দাদা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দুঃখ করিস না বোনু, টিভিতে দেখেছিস তো সোহিনীকে, ও হয়তো এবছরে সরগম চ্যাম্পিয়ন হবে।’
ছলছল চোখে ঝলমলে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট তুতুলও বুঝল নতুন বিস্ময় বালিকা এসে গেছে।