সর্বজনীন
একটা সময় নন্দন চত্বরেই আটকে ছিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (28th Kolkata International Film Festival)। ভিড় জমাতেন মূলত ইন্টালেকচুয়ালরাই। গত এক দশকে বদলেছে চেহারা। উৎসব হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। বেড়েছে প্রচার, প্রসার। ছড়িয়ে পড়েছে শহরের নানা প্রান্তে। ইতিমধ্যেই এই উৎসব পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র উৎসবের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের সিনেমা নিয়ে এইরকম উন্মাদনা এককথায় অবিশ্বাস্য। এর পিছনে বিরাট অবদান রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি এই উৎসবকে পৌঁছে দিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের কাছে। তাঁর আন্তরিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন সময় এসেছেন সিনেমা জগতের রথী-মহারথীরা। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
চাঁদের হাট
বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর। কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বসেছিল চাঁদের হাট। উপলক্ষ ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তো ছিলেনই। তিনিই মধ্যমণি। পাশাপাশি তাঁর আমন্ত্রণে এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, জয়া বচ্চন, শত্রুঘ্ন সিনহা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রানি মুখোপাধ্যায়, মহেশ ভাট, কুমার শানু, অরিজিৎ সিং, চঞ্চল চৌধুরি প্রমুখ। ছিলেন রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপাল ড. সি ভি আনন্দ বোস, বিধানসভার মাননীয় অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, অজয় চক্রবর্তী, বাবুল সুপ্রিয়, রাজ চক্রবর্তী। এ ছাড়াও রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, অরিন্দম শীল, শুভশ্রী, শ্রাবন্তী, মিমি চক্রবর্তী, শতাব্দী রায়, সোহম চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, চূর্ণি গঙ্গোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম প্রমুখ টলিউড তারকারা। থালিগার্ল ছিলেন রুক্মিণী মৈত্র। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন অমিতাভ বচ্চন। আলো ঝলমলে অনুষ্ঠান। উপস্থিত প্রত্যেকেই আয়োজনের ভুয়সী প্রশংসা করেন।
ছবির মেলা
এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে ১০টি প্রেক্ষাগৃহে ৪২টি দেশের নানা ভাষার ছবি দেখানো হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৩০টি কাহিনিচিত্র এবং ৫৩টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ও তথ্যচিত্র৷ প্রেক্ষাগৃহগুলো হল নন্দন-১, নন্দন-২, নন্দন-৩, রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাঘর, রাধা স্টুডিও, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, নজরুল তীর্থ-১, নজরুল তীর্থ-২। প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে ‘ফেস্টিভ্যাল ডায়েরি’।
এবারের থিম
‘নায়ক’ উত্তমকুমারের মুখোমুখি বসে আছেন জিন সেবার্গ। ‘দ্য কিড’-এর চার্লি চ্যাপলিনের পাশে বসে ‘পথের পাঁচালী’-র ছোট্ট অপু। এ ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, অমিতাভ বচ্চন অভিনীত চরিত্রগুলি ফ্রেম শেয়ার করেছে বিদেশি ছবির চরিত্রের সঙ্গে। এইভাবেই ছবির মেলায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বের ছবি। কারণ এবারের থিম ‘বিশ্ব মেলে ছবির মেলায়’। নজর কেড়েছে অভিনব এই প্রচার।
আরও পড়ুন-২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অমিতাভকে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি মুখ্যমন্ত্রীর
নানা রসের ছবি
নব রসে সাত দিন। কোন কোন রসের ছবি দেখা যাবে এবার? হাস্যরস, করুণরস, বীররস, ভয়ানকরস, বীভৎসরস, শান্তরস, অদ্ভুতরস, রৌদ্ররস, শৃঙ্গাররস। তারকাদের ছবি-সহ ব্যানারে ব্যানারে ছয়লাপ শহর জুড়ে।
সংলাপের উৎসব
‘মাসিমা মালপো খামু’। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ মজার সংলাপটি ফুটেছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। জনপ্রিয় সংলাপটি এই মুহূর্তে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্র সদনের একটি দেওয়ালে। ঝুলছে আরও কয়েকটি কালজয়ী সংলাপ। যেমন, ‘হীরক রাজার দেশে’র ‘এরা যতবেশি পড়ে তত বেশি জানে তত কম মানে’, ‘নায়ক’-এর ‘আই উইল গো টু দ্য টপ দ্য টপ দ্য টপ’ থেকে শুরু করে ‘শোলে’র ‘কিতনে আদমি থে’। মুখে মুখে ফেরা বিভিন্ন সিনেমার সংলাপগুলো উৎসবে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি
এইবছর হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ। গতকাল উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে তাঁর পরিচালিত ‘অভিমান’। এ ছাড়াও বিভিন্ন দিন দেখানো হবে তাঁর ‘আনাড়ি’, ‘অনুরাধা’, ‘অনুপমা’, ‘সত্যকাম’, ‘আনন্দ’, ‘মিলি’, ‘বেমিশাল’। পাশাপাশি শতবর্ষ উদযাপিত হবে অ্যালেন রেসনাইস, পিয়ার পাওলো পাসোলিনি, মাইকেল ক্যাকোয়ানিস, অসিত সেন, ভারতী দেবী, কে আসিফ, আলি আকবর খান, দিলীপকুমারের।
বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য
সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন অভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, সন্তুর বাদক ও সুরকার শিবকুমার শর্মা, অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলা ল্যান্সবারি এবং পরিচালক তরুণ মজুমদার। বিশেষভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হচ্ছে তাঁদের। তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘নিমন্ত্রণ’, ‘গণদেবতা’, ‘বালিকা বধূ’ উৎসবে দেখানো হবে। তালিকায় আছে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘জন অরণ্য’, শিবকুমার শর্মা সুরারোপিত ‘সিলসিলা’, অ্যাঞ্জেলা ল্যান্সবারি অভিনীত ‘দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে’। পাশাপাশি স্মরণ করা হচ্ছে জ্যঁ লুক গদারকে।
রেট্রোস্পেকটিভ
বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। তিনি বাংলার জামাইবাবু। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কলকাতায়। পরে কাজের সূত্রে এসেছেন বহুবার। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ পুরনো। এই বছর ৮০-তে পা দিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে তাঁর অভিনীত কয়েকটি ছবি। উদ্বোধনী ছবি হিসেবে ছিল ‘অভিমান’। এ ছাড়াও আছে ‘দিওয়ার’, ‘কালা পাত্থর’, ‘ব্ল্যাক’। গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা এবং নজরুল তীর্থে আয়োজিত হচ্ছে তাঁকে নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী।
খেলার ছবি
বেশ কয়েকটি খেলা বিষয়ক ছবি দেখা যাবে এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে। সেই তালিকায় রয়েছে ‘কোনি’, ‘৮৩’, ‘এমএস ধোনি’, ‘চক দে ইন্ডিয়া’, ‘মেরি কম’ এবং ‘ভাগ মিলখা ভাগ’।
প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ
দুটি নন-কম্পিটিশন বিভাগ আছে। সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল এবং বাংলা প্যানোরামা। এর পাশাপাশি রয়েছে মোট পাঁচটি আলাদা প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ। ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ, কম্পিটিশন অন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস, এশিয়ান সিলেক্ট (নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড), ন্যাশনাল কম্পিটিশন অন ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ন্যাশনাল কম্পিটিশন অন ফিকশন। প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে রয়েছে মোট ৬৬টি ছবি৷
বাংলা প্যানোরামা
এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা প্যানোরামা বিভাগে দেখানো হবে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘আকরিক’। তথাগত ভট্টাচার্য পরিচালিত ছবিটি ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও আছে ‘ঘাসজমি’, ‘নীতি শাস্ত্র’, ‘তরঙ্গ’, ‘ইকিড় মিকিড়’, ‘উত্তরণ’, ‘শহরের উষ্ণতম দিন’-এর মতো ছবি।
হাওয়া-ঝড়
সম্প্রতি দর্শকমহলে ঝড় তুলেছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’। চঞ্চল চৌধুরি অভিনীত বাংলাদেশের ছবিটি দেখানো হবে এবারের উৎসবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের পরিচালক মুহাম্মদ কায়াম-এর ‘দ্য গোল্ডেন উইংস অফ ওয়াটারকক্স’ ছবিটি ঘিরেও অনেকেই উৎসাহী। গৌতম ঘোষ তৈরি করেছেন ‘মুজিব ইন ক্যালকাটা’। এই ছবিটিও থাকছে উৎসবে। সেইসঙ্গে থাকছে সাতটি আদিবাসী ভাষার ছবি।
সিনে আড্ডা এবং আলোচনা
সেজে উঠেছে একতারা মুক্তমঞ্চ। ১৭-২১ ডিসেম্বর প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হবে সিনে আড্ডা। থাকবেন চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট মানুষরা। পাশাপাশি বাংলা আকাদেমি সভাঘরে অনুষ্ঠিত হবে টক শো এবং মাস্টার ক্লাস। আলোচনায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট মানুষজন। ১৮ ডিসেম্বর শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা। বলবেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুধীর মিশ্র। সবমিলিয়ে জমজমাট কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ আয়োজিত এই উৎসব (28th Kolkata International Film Festival) চলবে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সিনেমার বিশ্বে বিশ্বের সিনেমা নিয়ে মেতে উঠবেন দর্শকরা।