হাসির রাজা

এক সময় রিলিফ সিন হিসেবে ছবিতে কমেডির ব্যবহার করা হত। এভাবেই অপরিহার্য হয়ে উঠতেন কৌতুক অভিনেতারা। বাংলা ছবিতে কমেডিয়ানের সংখ্যা প্রায় শেষ। তারই মধ্যে খানিক অক্সিজেন ভরে রেখেছিলেন অভিনেতা চিন্ময় রায়। আগামিকাল তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথা মুখ
যুবক ভজহরি মুখোপাধ্যায় মুখে সারাক্ষণ বীরত্বের কথা শোনালেও আসলে তার চরিত্রটা ভীরু প্রকৃতির। এই ভজহরির সঙ্গে আছে প্যালা ওরফে কমলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবুল ওরফে স্বর্ণেন্দু সেন এবং ক্যাবলা ওরফে কুশল মিত্র। প্যালা, হাবুল, ক্যাবলাকে নিয়ে এই ভীরু মানুষটির অভিযান। হাজারিবাগ রামগড় থেকে যাওয়া যায় সেই ঝন্টিপাহাড়ে। সেই স্থানেই এই ভীরুপুরুষটির অভিযানের প্রেক্ষাপট রচিত। ঝন্টিপাহাড়িতে ক্যাবলার মেসোমশাই এক সাহেবের কাছ থেকে একটি বাংলো কিনেছিলেন। তাদের গন্তব্যস্থলটি ছিল ঝন্টিপাহাড়ের সেই বাংলো। ঝন্টিপাহাড় যাওয়ার পথে স্বামী ঘুটঘুটানন্দ ও তার চ্যালা গজেশ্বরের সঙ্গে এদের আলাপ হয়। ভজহরির সঙ্গে এদের বাক-বিতণ্ডা হলে ভজহরি প্রতিশোধস্বরূপ ঘুটঘুটানন্দের যোগসর্পের হাঁড়ি (আসলে রসগোল্লার হাঁড়ি) সাফ করে দেয়। ঝন্টিপাহাড়েও এরপর ঘুটঘুটানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং নানা অভিযানের পর ক্যাবলার অসীম সাহসিকতায় ঝন্টিপাহাড়ে জাল নোটের কারবারটা ধরা পড়ে, যার অন্যতম পুরোধা স্বামী ঘুটঘুটানন্দ ও সহকারী গজেশ্বর। এতক্ষণে পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কার গল্প আমি বলছি। ঠিকই ধরেছেন। সেই ভজহরি আসলে হল টেনিদা। টেনিদার ‘চারমূর্তি’ নিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো গল্প। সেই গল্প নিয়ে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য নির্মাণ করলেন ছবি ‘চারমূর্তি’। টেনিদার চরিত্রের শিল্পী চিন্ময় রায়। এই ছবিতে অধিকাংশ নতুন মুখ। কিন্তু একা চিন্ময় রায় ছবি টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর অননুকরণীয় অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গি দিয়ে। তদুপরি এই ছবিতে চিন্ময় রায়ের লিপে মান্না দে’র গাওয়া ‘‘ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো” গানটি আজও মানুষের মুখে। তেমনভাবে চিন্ময় রায়কে (Chinmoy Roy) বাংলা ছবি ব্যবহার করতে পারেনি, পারলে চারমূর্তির টেনিদার মতো আরও উজ্জ্বল চরিত্র চিন্ময় আমাদের উপহার দিতে পারতেন।

জীবনকথা
১৯৪০ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের কুমিল্লায় চিন্ময় রায়ের জন্ম। পিতার নাম অমিয়প্রসাদ রায়। কাশীপুর ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন ১৯৫৯ সালে। চাকরি করেছেন দিল্লির একটি প্রকাশন সংস্থায়। কিন্তু নাটক পাগল মানুষ ছিলেন চিন্ময় রায়। গ্রুপ থিয়েটার করতেন। নান্দীকার গোষ্ঠীর ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ নাটকে তাঁর অভিনয় অনেকের মনেই দাগ কাটে। বিশেষত যেখানে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো ডাকসাইটে শিল্পীরা রয়েছেন; সেখানে দর্শকদের নজর কাড়লেন চিন্ময়। নজরে পড়লেন পরিচালক তপন সিংহের। ১৯৬৬ সালে নির্মীয়মাণ ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্র চিন্ময় রায়কে (Chinmoy Roy) সুযোগ দিলেন তপন সিংহ। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি চিন্ময় রায়। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯৭৫ সালে। এই শিল্পী দম্পতির এক পুত্র, এক কন্যা।

ছবির জগতে বিস্তার
প্রথমে ছোট ছোট চরিত্রে সুযোগ পেয়েছিলেন। তপন সিংহের ‘হাটে বাজারে’, সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’য় ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে তৈরি করলেন চিন্ময় রায় (Chinmoy Roy)। বড় ব্রেক পেলেন তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবিতে। সাগিনারূপী দিলীপ কুমারের প্রেমিকা হলেন সায়রা বানু। সায়রা বানুর স্বামীর চরিত্রে চিন্ময় রায় দর্শকদের মাতিয়ে দিলেন। দিলীপ কুমার, সায়রা বানু মুগ্ধ হলেন চিন্ময়ের অভিনয়ে। ‘আপনজন’ ছবিতে ছেনোদের দলের শাগরেদ চিন্ময়ের আরেক কীর্তি। ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে সৌমিত্রের বন্ধুর এক বখাটে চরিত্রে তিনি, যারা সুন্দরীদের দেখলেই গেয়ে ওঠে ‘‘জীবনে কী পাব না ভুলেছি সে ভাবনা” গান। সত্যজিৎ রায়ের থেকে ডাক পেলেন। ছবির নাম ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। সেখানে মন্ত্রীমশাইয়ের (জহর রায় ) শাগরেদ গুপ্তচরের চরিত্রে চিন্ময় অসাধারণ। আমাদের অবাক করে দিলেন যখন তিনি কাজ পেলেন ‘ননীগোপালের বিয়ে’ ছবিতে। দ্বৈত চরিত্রে অসামান্য অভিনয়। পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়। সেখানে তাঁর বিপরীতে নায়িকা জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন চিন্ময় রায়। ‘এখনই’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের সূত্রে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিচারে শ্রেষ্ঠ সহ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন চিন্ময় রায়। ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে যখন তিনি তাঁর প্রেমিকা শিবানী বসুকে বলেন, ‘‘একবার বলো উত্তম কুমার” তখন হাসতে হাসতে দর্শকদের পেটে খিল ধরে যায়।

আরও পড়ুন-স্বামী বিবেকানন্দ ও ওঁরা দু’জন

বিশিষ্ট পরিচালকদের ছবিতে কাজ
সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহই নন, বাংলার সেই সময়ের বড় বড় সব পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন চিন্ময় রায়। সেই তালিকায় রয়েছেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় (ধন্যি মেয়ে, মৌচাক), তরুণ মজুমদার (শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী, ঠগিনি), দীনেন গুপ্ত (বসন্ত বিলাপ, রাগ অনুরাগ), অরুন্ধতী দেবী (পদি পিসির বর্মী বাক্স), মানু সেন (মোহনবাগানের মেয়ে), সুধীর মুখোপাধ্যায় (ননীগোপালের বিয়ে), পীযূষ বসু (ব্রজবুলি), রবি ঘোষ (সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা, নিধিরাম সরদার), অমল দত্ত (সন্ধি), দিলীপ রায়(অমৃতকুম্ভের সন্ধানে), সুজিত গুহ (দোলনচাঁপা), অজয় কর (মধুবন), অঞ্জন চৌধুরী (বিধিলিপি) প্রমুখ পরিচালক।

পেশাদারি মঞ্চে অভিনয়
পেশাদারি মঞ্চের ডাক কখনও উপেক্ষা করতে পারেননি। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘বাঘিনী’ নাটকে তাঁর অভিনয় প্রতিটি দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। চরিত্রটি চলচ্চিত্রে করেছিলেন রবি ঘোষ। বিজন থিয়েটারে ‘আগন্তুক’ নাটকে দর্শকদের প্রচুর হাসিয়েছেন। তিনি রঙ্গনা থিয়েটারে নিজের পরিচালনায় ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’ নাটকেও প্রচুর হাসিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই নাটকে জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন।

শিল্পীর অবস্থান
ছবির সংখ্যা অসংখ্য তবু দাগ কেটে যাওয়ার মতো চরিত্র তেমন করে জোটে না। যখন চিন্ময় রায় ছবির জগতে এলেন তখন বাংলা ছবিতে হাসির স্থান ভরাট করে রেখেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার, রবি ঘোষ, শ্যাম লাহা, তরুণ কুমার সহ দিকপাল অভিনেতারা। তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিন্তু আজ এঁরা কেউ নেই। হাসির নামে যা হচ্ছে তা লোক হাসানো ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। এই পরিস্থিতির শিকার একসময় হয়েছিলেন চিন্ময়ও। এমন বহু ছবিতে তিনি কাজ করেছেন যেখানে অভিনয় দেখানোর সুযোগ নেই। তবু টিকে থাকার জন্য অভিনয় তো করতেই হবে। মনের শান্তি পেতে চিন্ময় রায় কখনও যাত্রায় গেছেন কখনও বা দূরদর্শন ধারাবাহিকে। তিনি নিজে একটি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। ‘চারমূর্তি’ ছবির রিমেক। সেখানে টেনিদার ভূমিকায় তিনি নিয়েছিলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে। ছবিটি একদম চলেনি।

শেষের ক’টি দিন
চিন্ময় রায়ের (Chinmoy Roy) মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তাঁর স্ত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। তিনি একাকিত্বে ভুগছিলেন। নাটকও তেমন জমাতে পারছিলেন না। শেষে একদিন তাঁর নিজের ফ্ল্যাট বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে অচৈতন্য অবস্থায় উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রায় এক বছর তিনি ভুগলেন। শেষে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাত ১০:৪৫ মিনিটে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। ননীগোপালের বিয়ে, চারমূর্তি, বসন্ত বিলাপ, ধন্যি মেয়ে প্রভৃতি ছবির মধ্য দিয়ে তিনি অনন্য কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আমাদের মনের মধ্যে স্থান করে রেখেছেন।

Latest article