জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। এই নিয়েই সুন্দরবন। জঙ্গল-নদীঘেরা এই অঞ্চলের প্রতি পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে বিপদ, রোমাঞ্চ। পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে, যখন আছড়ে পড়ে সাইক্লোন, তুমুল ঝড়বৃষ্টি। সমস্তকিছু তছনছ হয়ে যায়। তবু বাঁচে। সুন্দরবনের মানুষ বাঁচে। বাঁচে হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে। একে অপরের হাতে হাত রেখে।
আরও পড়ুন-দিনমজুরের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী। সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে ঘেরা এই দ্বীপেই বেড়ে উঠেছেন ইতি গায়েন। অভাব ছিল তাঁর পরিবারের নিত্যসঙ্গী। কম বয়সে মারা যান বাবা। তারপর থেকে দাদাদের সংসারে।
ছোটোবেলায় স্কুলে পড়তেন ইতি। তবে তাঁর মন চলে যেত ক্লাসের চার দেওয়ালের বাইরে, সবুজ মাঠে। কম বয়স থেকেই খেলাধূলার প্রতি ছিল তাঁর ঝোঁক। পাঁইপাঁই করে দৌড়োতেন। দিতেন লাফ। মেয়েদের পাশাপাশি টেক্কা দিতেন পাড়ার ছেলেদেরও। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রাইজ ছিল বাঁধা। দৌড়ে এবং লংজাম্ফে। বন্ধুরা বলতেন, ‘তোর সঙ্গে আমরা পেরে উঠবো না। তুই সবুজ মাঠের রানি।’
সহপাঠীদের পাশাপাশি তাঁর প্রশংসা করতেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। তাঁরা চাইতেন ইতি খেলাধূলা নিয়ে অনেক দূরে যাক।
তাঁদের উৎসাহে স্কুলের সীমা পেরিয়ে ইতি অংশগ্রহণ করেন জোনাল স্পোর্টশে। সেখানেও পান সাফল্য। তারপর হোগল এবং মাতলা নদী পেরিয়ে যান সাব ডিভিশনে। লংজাম্ফ এবং দৌড়ে ইতি মাঠে নামা মানেই প্রাইজ। কখনও ফার্স্ট, কখনও সেকেন্ড, কখনও থার্ড। গলায় ঝুলেছে মেডেল, হাতে সার্টিফিকেট। অল্প দিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ইতির নাম। ভেবেছিলেন, সুযোগ আসবে আরও বড়ো জায়গায়। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। তাঁর থেকে কম যোগ্যতার মেয়েরা তাঁকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তখন তিনি লাফাতেন ১৫ ফুট। পাশাপাশি ১৩ ফুট লাফিয়ে অনেকেই পেয়ে গেলেন সুযোগ। মন ভেঙে গেল ইতির। পাশাপাশি উপযুক্ত কোচিংয়ের অভাবও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছুদিনের জন্য সরে গিয়েছিলেন খেলাধূলা থেকে।
কিন্তু সবুজ মাঠের হাতছানি বেশিদিন উপেক্ষা করতে পারলেন না। ইতি নাম লেখালেন কাবাডি দলে। শক্তপোক্ত শরীরের জন্য সেখানেও পেলেন সাফল্য। অল্প দিনের মধ্যেই সুযোগ পেয়ে গেলেন জেলার কাবাডি দলে। খেলতে লাগলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, অবিভক্ত মেদিনীপুর সহ বিভিন্ন জেলার বিরুদ্ধে। টানা কয়েক বছর। কখনও জয়, কখনও পরাজয়। খেলার জন্য দলের সঙ্গে গেছেন বিভিন্ন জায়গায়। অর্জন করেছেন সুনাম, পেয়েছেন প্রচুর পুরষ্কার, সংবর্ধনা, নতুন বন্ধু।
এইভাবেই তিলে তিলে বেড়ে উঠলেন ইতি। একদিন হয়ে গেল তাঁর বিয়ে। জীবনে ঝড়ঝাপটা কম আসেনি। সবরকমের পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এগিয়ে গেছেন। এখন তিনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। কথা হল তাঁর সঙ্গে। ইতি জানালেন, ‘কোনো সময় হাল ছাড়িনি। ঘরে ছিল অভাব। তার মধ্যে লড়াই করে গেছি। দাঁতে দাঁত চেপে। বাসন্তী ব্লকের জয়গোপালপুর অঞ্চলের একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। করতাম শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের কাজ। বর্তমানে যুক্ত আছি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে। পঞ্চায়েত প্রধান পারুল মণ্ডল আমাদের নানারকম ভাবে সহযোগিতা করেন। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে। আমি বাসন্তী সৃষ্টি সংঘের দলনায়িকা।’
কী কাজ হয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে? ইতি জানালেন, ‘মহিলারা টাকা জমান। একটা সময় দশ টাকা করে জমাতেন। এখন পঞ্চাশ, একশো টাকা। জমানো সেই টাকা ব্যাঙ্কে রেখে আসা হয়। এর পাশাপাশি আমরা পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় টিউবওয়েল রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার, এলাকার নোংরা আবর্জনা দূর করা, গর্ভবতী মায়েদের পরিচর্যা ইত্যাদি কাজ করে থাকি।’
আরও পড়ুন-অসমে মৃতদেহের ওপর নৃশংস অত্যাচার, বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
এখন খেলাধূলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে? তিনি জানালেন, ‘আছে। খেলাধূলা ছেড়ে দিয়ে বাঁচতে পারব না। আমি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। বড়োদিন আমাদের প্রধান উৎসব। সেই উপলক্ষে আমাদের এখানে ২৮ ডিসেম্বর ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমি সেখানে সর্বসাধারণ বিভাগে দৌড় সহ বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করি। পাশাপাশি আমি খেলার ব্যাপারে ছোটদের এবং এলাকার মহিলাদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। খেলা শেখাই। আমার স্বামী প্রবীর জানা স্থানীয় পঞ্চায়েতে কাজ করেন। তিনি সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত। সমস্তরকমের কাজে তিনি আমাকে উৎসাহ দেন। তাঁর সঙ্গে আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই, গান গাই। আমার লক্ষ্য সুন্দরবনের বাসন্তী অঞ্চলের মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলা এবং পাশাপাশি ছোটদের খেলাধূলার ব্যাপারে আরও উৎসাহিত করা। আশাকরি একদিন আমার লক্ষ্য পূরণ হবে।’