ভারতীয় দর্শনের উত্তরাধিকার বহন করছে এদেশের সংবিধান। বহুস্বরের স্বীকৃতি তাতে স্পষ্ট। কিন্তু মোদি-শাহের দল একমাত্রিক ভারত গড়তে উঠেপড়ে লেগেছে। সংবিধানকে তোয়াক্কা করছে না এই দল। সুকৌশলে ভারতাত্মার চারিত্র বদলের খেলায় নেমেছে ওরা। লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের দেশের গণপরিষদ তৈরি হয়েছিল একটি বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। সেটি শুধুমাত্র একটি স্বাধীন দেশের শাসনব্যবস্থার পরিচালন পদ্ধতি নির্ধারণ নয় অর্থাৎ সরকার পরিচালনা নয়, গুণগতভাবে উন্নত একটি রাজনীতি গড়াও তার অভীষ্ট ছিল। ভারতের সংবিধান হল সর্ববৃহৎ এবং জটিলতম। এর কারণ এই নয় যে আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। সংবিধান রচনার মূল লক্ষ্য ছিল একটি স্থায়ী রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্মাণ করা। সংবিধান নির্মাতারা জানতেন যে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান নিয়ে যে ভারতবর্ষ, তাকে একটি নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। কালের নিয়মে সামাজিক জীবন সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা না থাকলে সমস্যা। এ দেশের সমস্যা অধিকতর জটিল। এখানে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে সুরটি রয়েছে তাকে আঘাত করলে হারিয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মানুষের আয়ু সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারী
ভারতের বেদান্ত দর্শন অদ্বৈতবাদকে গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ কোথাও কোন বিভাজন নেই, সবই ব্রহ্মস্বরূপ। এই দর্শনের থেকে সরে আসার চেষ্টা করা উচিত নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও তো মানা চলে না। সারা বিশ্বেই তো মানুষ ‘অমৃতের সন্তান ‘। সেখানে কোথায় শ্রেণি বিভাজন, কোথায়ই বা গোষ্ঠী বিরোধ! পার্টিগত ঝগড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ভারতীয় দর্শন সর্বদাই এই আপ্তবাক্যটিকেও মনে রেখেছে যে ‘নানা মুনির নানা মত’। তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আমাদের দার্শনিক ঐতিহ্য ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে।
অদ্বৈতবাদ কে বিশেষায়িত করার চেষ্টা হ’ল বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ। অর্থাৎ অভিন্ন মানবসত্তাকে মান্যতা দিয়ে, বিশ্বশান্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েই একটি বিশেষ রূপে রাষ্ট্রীয় অবস্থান নির্মাণ করা সম্ভব। ঠিক তেমনি দেশের ঐক্য এবং অখন্ডতাকে অগ্রাধিকার দিয়েই আমরা কতগুলো বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতিগত অবস্থান নিতে পারি। এখানে সার্বিক সত্তার সাথে বিশেষ সত্তার মতবিরোধ থাকতে পারে কিন্তু ভেদভাব নেই।
অথচ ভক্তি আন্দোলন বা সুফি সাধনার এই ধাত্রীভূমিতেই একটি আশ্চর্য ভেদভাব বা মানবিক বিভাজনের জন্ম দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংবিধান যে দর্শন ও সমাজ বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে নির্মিত হয়েছিল তা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এই পর্বের দেশের রাজনীতি। যেভাবে গত সাত বছর ধরে ধীরে ধীরে আমাদের দেশের মূল বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত হানা হয়েছে তা অভূতপূর্ব।
আরও পড়ুন-লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে টাকা দেওয়া শুরু রাজ্য সরকারের
সংবিধানের উপর আঘাত হানা আমাদের মৌলিক অধিকারগুলি ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রটিকে সংকুচিত করছে। একটি মত, একটি বিচারধারাকে প্রাধান্য দেওয়ার যে রাজনৈতিক দখলদারি তা রাষ্ট্রীয় জীবনকেও বাতাহত করে রেখেছে।
১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় অনুযায়ী সংবিধানের মূল কাঠামোকে কখনো পরিবর্তন করা যাবে না। এই মূল কাঠামো কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করে তা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা , নির্বাচন ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থার কাঠামো প্রভৃতি নিয়ে কোন মতভেদ নেই। এইগুলি যে আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোকে চিহ্নিত করে তা সার্বিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে এই মৌলিক কাঠামোকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করা হয়েছে। একটিই তার উদ্দেশ্য। সংবিধান প্রণেতারা যে রাজনৈতিক ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েছিলেন তাকে পাল্টে দেওয়া। একটি একমাত্রিক, অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দেওয়া, যেখানে নাগরিকেরা মুক্ত জীবন যাপনের সব উপাদানগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। এমনকি তাঁদের নাগরিক সত্তা, যা সার্বিকভাবে এদেশের বসবাসকারী হিসেবে তাঁদের অভিন্ন পরিচয়, তাই প্রশ্নের মুখে পড়বে। পিতৃপুরুষের জন্ম পরিচয়ের নথি খুঁজতে খুঁজতেই তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন-উন্নয়নে সমর্থন, ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা
ভাষা বা সংস্কৃতিগত একমাত্রিকতাও অত্যন্ত আপত্তিকর। শুধুমাত্র গোরক্ষার নামে মানুষের জীবন বিপন্ন করাই নয়, একটি বিশেষ উত্তরভারতীয় সংস্কৃতি কে সারা দেশের সংস্কৃতি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেও আছে আধিপত্যবাদের অমোঘ প্রচেষ্টা। আমরা অবশ্যই হিন্দি ভাষার বিরোধী নই, হিন্দি সাহিত্য বা সংস্কৃতি নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এবং থাকবে। কিন্তু তা আমার নিজের ভাষার বিকল্প নয়। আজ আঘাত আসছে আমার প্রাণের ভাষার উপর। বিজেপি শাসিত অসমে বাঙালিদের একটি বড় অংশ শুধুমাত্র নাগরিকপঞ্জি থেকেই বাদ পড়েন নি, তাঁদের উপর আঘাতও নেমে আসছে।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়েও তেমন গভীর কোন ভাবনা নেই। নীতি আয়োগ তৈরি হল হাজারটা কথা বলে। বলা হল যে এটি সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা কে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু কোথায় কী? যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রায় অস্বীকার করা হচ্ছে । অথচ সংবিধান শুরুই হচ্ছে India, that is Bharat, shall be a union of states বলে।
আরও পড়ুন-আইন ভেঙে উল্টে তৃণমূলকেই হেনস্তা
সমস্যাগুলি প্রাসঙ্গিক। লড়াইয়ের পথও দীর্ঘ। কোনো সহজ সমাধান নেই। মনে রাখতে হবে যে একমাত্রিকতার বাতাবরণ সৃষ্টিকারীরা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রয়োজন পাল্টা প্রস্তুতি এবং অবশ্যই কৌশল। সংবিধানের মৌলিক অবস্থানের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কৌশল।