বিজ্ঞান যত এগোচ্ছে মানুষ ততই যন্ত্র-নির্ভর হচ্ছে। পুরাতন যন্ত্রকে বিদায় ও নতুন যন্ত্রকে আমন্ত্রণ— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কিছু যন্ত্র আছে যেগুলোকে আজও বিদায় জানানো সম্ভব হয়নি, যেগুলোর নিপুণতা, সহনশীলতা ও বলিষ্ঠতা আজও অনবদ্য। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে স্টেথোস্কোপ (আবিষ্কারক রেনে থিওফিলে হায়াসিন্থে লাইনেস, ১৮১৬), আবহাওয়া বিজ্ঞানে মানুষের চুলের সাহায্যে আর্দ্রতামাপক যন্ত্র (হেয়ার হাইগ্রোমিটার (Hair Hygrometer), আবিষ্কারক হ্রাসে বেনেডিক্ট ডে সুসসুরে, ১৭৮৩), স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিপাতমাপক যন্ত্র (সেলফ রেকর্ডিং রেইন গেজ, শতাধিক বৎসর পুরানো), ক্যাম্পবেল-স্টোকস সানশাইন রেকর্ডার (১৮৭৯) ইত্যাদি অতুলনীয় যন্ত্রগুলি আজও গর্বের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবহাওয়ার যন্ত্রের একটি বিশেষ ক্ষমতা হল সহনশীলতা। প্রখর রোদ, বৃষ্টি যে-কোনও অবস্থাতেই এটি ঘরের বাইরে রাখা থাকবে। যা আধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে খুবই ব্যয়বহুল।
হেয়ার হাইগ্রোমিটার (Hair Hygrometer)
নামের সঙ্গেই কাজের সম্পর্ক বলে দিচ্ছে। মানুষের মাথার চুলের একটি বিশেষ গুণ হল বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতার সঙ্গে এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনশীলতা। আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়, আর আর্দ্রতা কমলে দৈর্ঘ্য সংক্ষিপ্ত হয়। যন্ত্রের বিবরণ চিত্র দিয়ে দেখানো হল। একগুচ্ছ চুল একটি স্প্রিং-এর সঙ্গে আটকানো হয়। স্প্রিং ও চুলের সংযোগের জায়গায় একটি লিভার বা নির্দেশক লাগানো হয়। এই নির্দেশকটি ঘড়ির (পুরানো দিনের) কাঁটার মতো আর্দ্রতা-স্কেল বা আর্দ্রতামান বলে দেয়। আর্দ্রতার লেখচিত্র খুব প্রয়োজনীয়। একে হাইগ্রোগ্রাফ বলে। এর জন্য ২৪ ঘণ্টার ডিভিশন করা একটি চার্ট ক্লক (ঘড়ি) ড্রামের ওপর বসানো হয়, যা ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরবে। নির্দেশকটি তখন আর্দ্রতার মান চার্টের ওপর চিহ্নিত করে যায়। এই পদ্ধতিকে ক্লক-ড্রাম পদ্ধতি বলে। এই চার্ট প্রতিদিন ৩ জিএমটি-তে পরিবর্তন করা হয়। ব্যবহারের দিক থেকে একবারে ফুলপ্রুফ বলা যায়। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও বিশেষভাবে অনুশীলনপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। বিগত দিনে কোন সময়ে কত আর্দ্রতা ছিল জানা যায়। কৃষি, আবহাওয়া, জলবায়ুর গবেষণায় খুব প্রয়োজন। এমনকী আধুনিক ডিজিটাল হাইগ্রোমিটারকে (Hair Hygrometer) ব্যবহারযোগ্যতা প্রমাণ করতে হেয়ার হাইগ্রোগ্রাফের সঙ্গে তুলনামূলক পরীক্ষায় বসতে হয়।
সেলফ রেকর্ডিং রেইন গেজ
বস্তুত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বলতে, বৃষ্টিপাতের ফলে ওই স্থানে বৃষ্টির জল যদি প্রবাহিত, শোষিত অথবা বাষ্পায়িত না হয় তবে জলের যে উচ্চতা বৃদ্ধি হল, সেটাই ওই সময়ের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। তাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মিলিমিটার অথবা সেন্টিমিটারে প্রকাশ করা হয়। কোনও কোনও দেশে ইঞ্চিতেও প্রকাশ করা হয়। বৃষ্টিপাত মাপার প্রয়োজনীয়তা ২-৩ হাজার বছর আগের মানুষেরও জানা ছিল। নানা পদ্ধতিতে বৃষ্টিপাত মাপা হয়। বর্তমানে, এফআরপি (ফাইবারে রিইনফোর্সড পলিমার) বৃষ্টিপাতমাপক যন্ত্র ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। দৈনিক বৃষ্টিপাত লেখচিত্রের লিপিবদ্ধ করার জন্য সেলফ রেকর্ডিং রেইন গেজ (এসআরআরজি) ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে বৃষ্টির জল ফানেলের মধ্যে দিয়ে সংগ্রহকক্ষে যাচ্ছে। সংগ্রহকক্ষে একটি ভাসমান (ফ্লোট) বস্তু থাকছে। বৃষ্টি হলে এই ফ্লোট ভাসতে ভাসতে ওপরের দিকে উঠবে। ফ্লোটের উপর একটি দণ্ডের সঙ্গে একটি পেন (ছোট কালির পাত্র) লাগানো থাকে। বৃষ্টি হলে এই পেন আগের মতো ক্লক-ড্রামের ওপর উলম্ব দিকে রেখা টেনে যাবে। আবার সময়ের সঙ্গে চার্টও ঘুরতে থাকবে। বৃষ্টির জল বাড়তে বাড়তে যখনই সর্বোচ্চ উচ্চতায় (১০ মিলিমিটার বৃষ্টি) চলে যাবে, তখনই সাইফোন-ক্রিয়া শুরু হবে এবং পেনদণ্ডটি আবার ০ মিলিমিটার অবস্থায় চলে আসবে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে যতক্ষণ বৃষ্টি হতে থাকবে। ছবি দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। একবারে দেশি প্রযুক্তি, ফুলপ্রুফ ও স্থানীয়ভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। তবে যেখানে অহরহ তুষারপাত হয়, সেখানে এই যন্ত্র অচল বলাই ভাল। উপযোগিতা, এককথায় অতুলনীয়। বৃষ্টির গতি (রেইন রেট) দৃষ্টিনন্দন ভাবে দেখিয়ে দেয়। তবে বৃষ্টিপাত খুব কম হলে (২, ১ মিলিমিটার) অতটা ভাল বোঝা যায় না। বৃষ্টিপাতের তথ্য কার যে দরকার নেই বলা খুব মুশকিল! কৃষিকাজ, আবহাওয়া, জলবায়ু, বনবিভাগ, মৎস্যবিভাগ, চর্মশিল্প, সিভিল কন্সট্রাকশন, মিউনিসিপাল কর্পোরেশন, রেল, বিমান, ইন্সু্রেন্স, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সকলেরই বৃষ্টিপাতের তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশ-আদানি চুক্তি: প্রশ্ন তুলে চিঠি জহরের
ক্যাম্পবেল-স্টোকস সানশাইন রেকর্ডার
ছোটবেলায় শীতকালে লেন্স নিয়ে কাগজ পোড়ানো একটা খেলা ছিল। ঠিক এই পদ্ধিতেই ক্যাম্পবেল-স্টোকস সানশাইন রেকর্ডার কাজ করে। এক্ষেত্রে গোলক আকৃতি লেন্স ব্যবহার করা হয়। সূর্যের আলোতে লেন্সের যে জায়গায় কাগজ রাখলে পুড়ে যায়, সেখানে সময় চিহ্নিত করা একটু মোটা কাগজের কার্ড রাখা হয়। সূর্যের আলোর তীব্রতা অনুযায়ী কার্ড পুড়ে যাবে। এটাই মেঘ, বৃষ্টি বা দৈনিক উজ্জ্বল সূর্যালোকের সময় বলে দেবে। এত সহজ পদ্ধতিতে, এত কম খরচে, এত দামি লিপিবদ্ধ-তথ্য অন্য কোনও যন্ত্র দিতে পারে না। তাই এই যন্ত্র অতুলনীয়। বিশেষ করে মেঘের উপস্থিতি জানার যন্ত্র এখনও বের হয়নি।
স্টেথোস্কোপ
আবিষ্কারক রেনে থিওফিলে হায়াসিন্থে লাইনেস, ১৮১৬, ফ্রান্স। এই যন্ত্রটিকে আগের যন্ত্রগুলির সঙ্গে তুলনা করা অনুচিত। আগের যন্ত্রগুলি তথ্য লিপিবদ্ধ করে অথবা তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু স্টেথোস্কোপের সাহায্যে কোন তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় না, কেবল অনুভব করা হয়। এর সাহায্যে চিকিৎসকেরা মানুষের শরীরের ভেতরে সচল অংশের মৃদু শব্দ অনুভব করতে পারেন এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী চিকিৎসা করেন। মূলত স্টেথোস্কোপের তিনটি অংশ, পর্দা যেটি শরীরে স্পর্শ করানো হয়, রবার নল ও কানে লাগানোর অংশ। পর্দা মৃদু শব্দ শরীর থেকে গ্রহণ করে তা নলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিফলিত হয়ে বর্ধিত হয় এবং কানে পৌঁছয়। অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার শব্দও স্টেথোস্কোপ দিয়ে সহজেই অনুভব করা যায়। নলহীন ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ পাওয়া গেলেও চিকিৎসকেরা আজও পুরোনো আমলের নলযুক্ত স্টেথোস্কোপ পছন্দ করেন।