প্রতিবেদন : দেশ এগিয়েছে, যুগ এগিয়েছে, দ্রুত ধাবমান সময়ও৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও বদলায়নি মানুষের মানসিকতা। কিছু স্তরে, কিছু ক্ষেত্রে, কিছু সমষ্টিতে আজও তাঁরা পশ্চাদপদ। কিছু সমাজ এখনও ছেলেদের পড়াশুনার চেয়ে উপার্জনকে এবং মেয়েদের বিয়ে–শাদিকেই অনেক বেশি মূল্য দেয়। তাই বহু পরিবারের বহু প্রতিভা সঠিক দিশার এবং সাহায্যর অভাবে হারিয়ে যায় জীবনের স্রোতে। আমাদের পশ্চিমবাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পুরুষসন্তানটি এইট পাশ করেই কাজে নেমে পড়ুক আর কন্যাসন্তানটি একটি সচ্ছল পরিবারে পাত্রস্থ হোক কারণ তাঁদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই বড়। কন্যাদায় ঘাড় থেকে নেমে যাওয়া তাঁদের কাছে পরম নিশ্চিন্ততা। তাই এখনও অনেক অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারে ছেলেমেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরোয় না, বিশেষ করে মেয়েরা। কারণ মেয়েদের পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাই যেন ভবিতব্য।
তবে এমনটা বুঝি সবাই ভাবেন না৷ ভাবেননি আমাদের রাজ্য সরকার এবং এই বাংলার মেয়ে আসিফা। তাই নারী এগোচ্ছে, সেই সঙ্গে এগোচ্ছে আমাদের বাংলাও। সেই প্রচেষ্টাকে একশো শতাংশ ফলপ্রসূ করতে উদ্যোগী হয়েছেন আমাদের রাজ্য সরকার। তাই বদলাচ্ছে সমাজ এবং বদলে যাচ্ছে অপূর্ণ স্বপ্ন বুকে লুকিয়ে নিয়ে চুপ করে বিয়ের আসরে বসে পড়া মেয়েটির ভাগ্যও। আমাদেরই বাংলার মেয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মগরাহাট ২ ব্লকের ডিহিকলস গ্রামের আসিফা খাতুন। আসিফা হল এই বাংলার ঐক্যের মুখ, ঐক্যশ্রীর মুখ। আসিফা সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু সবার কাছেই উদাহরণ। সেই সঙ্গে উদাহরণীয় তাঁর বাবা–মা। সম্প্রতি শেষ হওয়া দুয়ারে সরকার প্রকল্পে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘ঐক্যশ্রী’–র প্রচার ও প্রসারের মুখ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে মগরাহাট এলাকার অতিসাধারণ পরিবারের এক গ্রাম্য মেয়ে আসিফাকে৷ উন্নততর বাংলার স্বপ্ন পূরণে আমাদের রাজ্য সরকার ছেলে ও মেয়ে বিশেষ করে মেয়েদের কথা ভেবে চালু করেছেন একের পর এক প্রকল্প। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী, শিক্ষাশ্রী, গতিধারা, যুবশ্রী, ঐক্যশ্রীও আরও অনেক প্রকল্প। দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে এইসব প্রকল্পগুলোকে ঘরের দরজাতেও নিয়ে হাজির করেছে রাজ্য সরকার। যাতে পরিষেবা পেতে কোনও অসুবিধা না হয় মানুষের৷
আরও প্রতিবেদন : তৃণমূলনেত্রীর জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা কঠোর নিরাপত্তায় গণনার প্রস্তুতি
এই প্রকল্পগুলিরই মধ্যে অন্যতম হল ‘ঐকশ্রী’। ‘ঐক্যশ্রী’ রাজ্যের সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি বৃত্তিযোজনা বা স্কলারশিপ স্কিম। যার মাধ্যমে মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, পার্সি প্রত্যেক সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরা আর্থিক অভাবের কারণে যাতে পড়াশুনোয় পিছিয়ে না পড়ে অথবা পড়াশুনো বন্ধ না হয়ে যায় সেই বিষয়ে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে রাজ্য সরকার। এই ঐক্যশ্রী প্রকল্পের সফলতম মুখ হলেন আসিফা খাতুন। যিনি নিজে তো স্কলারশিপ পেলেনই সেই সঙ্গে যাতে আপামর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা এই স্কলারশিপ পেতে পারে তারই প্রচারমূলক কর্মে শামিলও হলেন। ঐক্যবদ্ধ করলেন বাংলার ছেলেমেয়েদের। ডিহিকলস গ্রামের আসিফা খাতুনের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রথমদিকে একটু ভাল হলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। বাবার ছোট্ট কাপড়ের ব্যবসা। মা সাধারণ গৃহবধূ। দুইভাই এবং বাবা–মাকে নিয়ে আসিফার নিম্নবিত্ত সংসার। যে সংসারে তাঁর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারা হয়ত এক অলীক স্বপ্ন ছিল।
আরও প্রতিবেদন : অন্য মহাত্মা অনন্যা কস্তুরবা
অবস্থা বেশ খারাপ ছিল ক্লাস ফোর পর্যন্ত। তারপর একটু স্বাচ্ছল্য এলেও আবার করোনাকালে বেশ দূরাবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের এবং সেই অবস্থান বিশেষ বদল হয়নি এখনও। করোনার গ্রাসে বহু মানুষের রুজিরুটি। প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়া শেষ করে কলস হাইস্কুলে আবার শুরু হয় আসিফার উচু ক্লাসে ওঠবার প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতিতে প্রবল উৎসাহ এবং সমর্থন ছিল তাঁর বাবা–মায়ের। বাবা চাইতেন মেয়ে অনেক দূর যাক। সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। সমাজের সেবায় নিয়োজিত হোক। সেই কারণে মেয়েকে বুঝতে দেননি তার আর্থিক অসুবিধার কথা। যদিও মেয়ে বুঝতে পেরেছিল বাবার সমস্যা, কিন্তু বাবা–মার সেই স্বপ্নকে ফলপ্রসূ করতে তৎপরও ছিল আসিফা সব সময়। পড়াশুনোকে ভালবেসেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ইচ্ছে ছিল পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়বার। এমতাবস্থায় ক্লাস নাইনে একদিন স্কুলের হেডমাস্টার্স–এর কাছে জানতে পারে এই ঐক্যশ্রী প্রকল্পের কথা, যা সে পেতে পারে। শুধু তাই নয় দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে এই প্রকল্পের সুবিধা সে নিতে পারে খুব সহজেই। কারণ স্বপ্ন যে তাকে পূরণ করতেই হবে। এরপর মগরাহাটের বিডিও–র অফিসে যায় সে। সেখানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা প্রশাসনের অফিসের আধিকারিকরা বেশ কিছু ছাত্রীদের সঙ্গে তাকেও নির্বাচিত করে এবং প্রশ্ন করা হয় ঐক্যশ্রী সহ, নানা বিষয়। তার স্বপ্ন, ভবিষ্যতের কথা জানতে চন তাঁরা। আসিফার সাবলীল উত্তরে খুশি হন বিডিও এবং জেলা প্রশাসনের সদস্যদলটি। তখনও আসিফা জানত না সরকার পক্ষ থেকে ঐক্যশ্রীর প্রসার এবং প্রচারের উদ্দেশ্যে ডকুমেন্টারি তৈরির করা হবে যাঁর জন্য একটি মুখ খুঁজছেন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই আসিফা নির্বাচিত হয়। সেই হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা ঐক্যশ্রী কন্যা আসিফা খাতুন। ইতিমধ্যেই আসিফা মাধ্যমিকে প্রায় ৮২ শতাংশর উপর নম্বর পেয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়। পিওর সায়েন্স নিয়ে আরও অনেক পড়াশুনা করতে চায় সে। সেই প্রস্তুতি তাঁর শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। পিওর সায়েন্স নিয়ে উচ্চশিক্ষা বেশ খরচসাপেক্ষ বিষয়। এক্ষেত্রে ঐক্যশ্রীর স্কলারশিপ তাকে অনেকটা এগিয়ে দিল সেই পথে। ঐক্যশ্রী প্রকল্পের প্রচারের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের সচেতন করে তোলা, তাঁদের পড়াশুনোয় আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি মনযোগ দিয়ে পড়ে চলেছে সে। এখন ক্লাস ইলেভেন। পড়ার বাইরে গান শুনতে, ছবি আঁকতে আর বই পড়তে ভালবাসে আসিফা। যদিও পড়াশুনো আর টিউশন নিয়ে অর্ধেক সময় পেরিয়ে যায় তার। পরিবারের অকুন্ঠ সহযোগিতা পেয়েছে। তাই সংসারের কাজে তাকে ঢুকতে হয়নি কখনও বড় একটা। মন দিয়ে পড়াশুনোই করেছে। বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায় আসিফা খাতুন। সমাজের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চায়। অসুবিধা হবে না কারণ উচ্চশিক্ষার জন্য, পেশাদার হওয়ার জন্য ঐক্যশ্রী স্কিমে ভাল অর্থমূল্যের স্কলারশিপ দিচ্ছে রাজ্য সরকার। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তাই দ্রুত অগ্রসরমান আসিফা। তাকে আমাদের শুভেচ্ছা।
তথ্য সহায়তা: নাজির হোসেন লস্কর