তাঁর জন্মদিনে কোথাও হয় না তেমন কোনও অনুষ্ঠান, কোথাও মালা দেওয়া হয় না তাঁর ছবিতে। চণ্ডীপাঠের মাধ্যমেই তাঁকে মনে রেখেছে আপামর বাঙালি। তিনি রেডিও নাটকের পথিকৃৎ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার প্রাক্কালে তাঁকে স্মরণ করলেন মৌসম মজুমদার
তাঁর জন্মদিনে কোথাও হয় না তেমন কোনও অনুষ্ঠান, কোথাও মালা দেওয়া হয় না তাঁর ছবিতে। তাঁকে নিয়ে হয় না কোনও আলোচনা সভাও। তাঁকে নিয়ে গবেষণা হয়নি তেমনভাবে। তবে প্রতি বছর মহালয়ার দিনটিতে আমরা কিছু বাঙালিরা তাঁকে স্মরণ করি কিছুটা নস্টালজিক হয়েই বা কিছুটা নিজেদের অন্তরের তাগিদেই। যদিও স্মরণের মাধ্যমটি অর্থাৎ রেডিওই আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে দুর্গাপূজা ছাড়াও কালী, সরস্বতী, লক্ষ্মী থেকে বিশ্বকর্মা যে-কোনো পূজোতেই এখনও পুজোমণ্ডপে পুজোর দিনগুলোতে ভোরবেলায় মাইকম্যানেরা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ চালিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেন, আর সেইসকল মাইকম্যানের জন্যই হয়তো রেডিও প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেলেও তাঁর কন্ঠস্বর বিস্তৃতির অন্তরালে হারিয়ে যায়নি। চণ্ডীপাঠের মাধ্যমেই যে তাঁকে মনে রেখেছে আপামর বাঙালি। কখনো কখনো পুজোমণ্ডপে স্থানীয় ব্রাহ্মণের চণ্ডীপাঠ শুনলে বীরেন ভদ্রের সাথে তুলনাটা অবশ্যম্ভাবী। যদিও সেটাই স্বাভাবিক, যে কণ্ঠস্বরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বয়ং মহানায়ক উত্তমকুমারও গো-হারান হেরেছিলেন সেখানে এখনকার পুরোহিত মশাই তো কোন ছার। কিন্তু ওইটুকুই। এর বেশি কিন্তু বাঙালিরা এই নাটকপাগল মানুষটিকে নিয়ে তেমন জানার চেষ্টা করেন না। অথচ রেডিও-নাটকের পথিকৃৎ ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কলকাতা রেডিওতে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ ছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। শিশির ভাদুড়ী, দুর্গা ব্যানার্জি, ছবি বিশ্বাস প্রমুখকে প্রায় জোর করেই রেডিওতে আমন্ত্রণ করে এনে তিনি একের পর এক নাটক করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-সেজে উঠেছে কলেজ স্ট্রিট
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছরেই ৪ আগস্ট কলকাতার আহিরিটোলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই নাটকপাগল মানুষটি। তাঁর পিতা ‘রায়বাহাদুর’ কালীকৃষ্ণ এবং মা সরলাবালাদেবী। তাঁর জন্মের সময় পিতা তাঁর আহিরিটোলার ভাড়া বাড়িতে থাকলেও, পরবর্তীকালে তিনি সপরিবারে ৭ নং রামধন মিত্র লেনে তাঁর মাতা যোগমায়াদেবীর নিজস্ব বাড়িতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। যোগমায়াদেবী, তাঁর উপার্জিত অর্থে বাড়িটি কিনেছিলেন। পাঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সময়ের নিরিখে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন বীরেন্দ্রর। বীরেন্দ্রর পিতা কালীকৃষ্ণবাবু ছিলেন তিনি লোয়ার কোর্টের এক সামান্য কর্মচারী। এর বাইরে তিনি ছিলেন প্রখ্যাত এক ভাষাবিদ এবং তিনি প্রায় চোদ্দোটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সরলাদেবীর পিতা কালীচরণ ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত পুলিশ কোর্টের এক নামকরা উকিল। ১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পিতা কালীকৃষ্ণ ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণেরা দুই ভাই ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এবং ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ।
আরও পড়ুন-৫০ থেকে ৮০ হাজার ভোটে জিততে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, ভবানীপুরের গণনা কেন্দ্রে এসে দাবি ফিরহাদের
বাড়ির কাছেই তেলিপাড়া লেনে কয়েক জন ছাত্রকে নিয়ে একটি প্রাইভেট স্কুল শুরু করেছিলেন শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ দে। তিনি সাত্ত্বিক মানুষ, মাছ-মাংস খেতেন না। তাঁর কাছেই পড়তেন বীরেন্দ্র। পুত্রের মতোই তাঁকে স্নেহ করতেন তাঁর মাস্টারমশাই রাজেন্দ্রনাথ। রাজেন্দ্রবাবুই তাঁকে আবৃত্তির ব্যাপারে শুধু যথেষ্ট উৎসাহই দিতেন না, মাত্র আট বছরের বীরেন্দ্রকে প্রায়ই নিয়ে তিনি যেতেন বেলুড়মঠে। ওখানে সন্ন্যাসী ভক্তেরা ছোট্ট বীরেন্দ্রর আবৃত্তি শুনতেন। বেতারে যে চণ্ডীপাঠের জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ইতিহাস গড়েছেন সেই চণ্ডীপাঠও ছোটবেলাতেই তিনি তাঁর মাস্টারমশাই রাজেনবাবুর কাছে শিখেছিলেন। ওঁর বাড়িতেই দশ বছর বয়সে প্রথম চণ্ডীপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এর পরে টাউন স্কুলে ভর্তি হন। তবে তাঁর প্রিয় শিক্ষক রাজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। স্কুলে দুষ্টুমিও ছিল তাঁর অভিনব। একবার নকল টিকি চুলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। আর গরু লেজ দিয়ে যে ভাবে মাছি তাড়ায়, সে ভাবেই ছটফট করছিলেন ক্লাসে। বাকি ছাত্ররা হেসে লুটোপুটি। কিন্তু স্যরের চোখে পড়তেই সমূহ বিপদ। বেশ কয়েকটা চড়-চাপড় খেতে হয়েছিল তাঁকে। আবার ক্লাসে নতুন কেউ এলে তাকে ল্যাং মেরে ফেলেও দিতেন। তবে সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, টেনিস কোনও খেলাধুলোয় একেবারেই উৎসাহ পেতেন না কিশোর বীরেন। নিজেই লিখেছেন, ‘ঘুড়ি পর্যন্ত ওড়াতে গিয়ে দেখেছি আমি অন্য কারও ঘুড়ি কাটতেই পারতুম না। একবার ফুটবল খেলতে গিয়েছিলুম গড়ের মাঠে। বাবা বললেন, ও সব খেলাটেলা ছেড়ে দাও। ব্যস, সেখানেই ওই খেলাতেও ইতি।’ অঙ্কে মন ছিল না বীরেন্দ্রর। ম্যাট্রিক পাশ করেই জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটিগণিতের যত বই ছিল, সব গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এতদিনের বোঝা লঘু করতে পেরে তাঁর সে কী আনন্দ! তবে ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিশক্তি প্রখর। ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। একবার রাজেনবাবু এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বীরেন্দ্রর নাম লিখিয়ে দেন। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ছিল আবৃত্তির বিষয়। মাঝেমাঝেই তাগাদা দিতেন, মুখস্থ কত দূর হয়েছে জানার জন্য। তবে ‘আজ করছি, কাল করছি’ বলে বীরেন্দ্র কাটিয়ে দিতেন। প্রতিযোগিতার তিন-চার দিন আগে হুঁশ হল তাঁর। চল্লিশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস ছিল একটু বেশি। শিখেও ফেললেন নির্দিষ্ট দিনের আগেই। প্রতিযোগিতায় দু’-চার পৃষ্ঠা বলার পরেই থামতে বলা হয় বীরেন্দ্রকে। তবে তাঁর উচ্চারণ শুনেই হোক বা মুখস্থ শক্তির পারদর্শিতা দেখে— এক বিচারক আরও কিছুটা অংশ শোনাতে বলেন তাঁকে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন বীরেন্দ্র। কলকাতাতেই স্কুলের পড়াশোনা পড়াশুনা শেষ করে ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি।
আরও পড়ুন-আজ জিতলেই প্লে-অফ পাকা বিরাট-বাহিনীর
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় ১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসে তৎকালীন বোম্বাইয়ের ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। যদিও এর আগেও কলকাতায় ছোট ছোট দু’টি বেতারকেন্দ্র ছিল। তবে সেগুলি থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি শ্রোতাদের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি ক্লাবের সদস্য ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। গান-বাজনা, অভিনয়ের চর্চা হত সেখানে। সেই দলেই ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, সত্য দত্ত, বিজন বসু প্রমুখ। নাট্যপরিচালনার সূত্রে আলাপ হয় মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে, যিনি পরে ‘চিত্রগুপ্ত’ নামে লিখতেন। বীরেন্দ্র তাঁকেও নিয়ে এসেছিলেন ওই ক্লাবে।
নতুন স্থাপিত বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হল নৃপেন মজুমদারের ওপর। সহকারী হিসেবে রইলেন রাইচাঁদ বড়াল ও রাজেন্দ্রনাথ সেন। বেতারের নিজস্ব নাটকের দল থাকলেও বাইরের কয়েকটি দলও তখন রেডিওয় অনুষ্ঠান করত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও চিত্রা সংসদের অন্য সদস্যরা ভাবলেন, তাঁরাও তো একটা নাটক করতে পারেন। পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ দিয়ে যোগাযোগ করলেন রেডিয়োর সঙ্গে। নৃপেনবাবু রাজি হলেন। ১৯২৮ সালের ২১ অগাস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় রেডিয়োয় পরিবেশিত হল সেই নাটক। অংশগ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও অন্য সদস্যরা। কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম যোগাযোগ।
আরও পড়ুন-তৃতীয় দিন উজ্জ্বল ঝুলন ও দীপ্তি
১৯২৮ সালে বিএ পাশ করে বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে যোগ দিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে’র ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে রেডিও অফিসে গিয়ে আসর বসিয়ে জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে নৃপেনবাবু তাঁকে আহ্বান জানালেন একদিন। কলকাতার ‘বেতারবাড়ি’র প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ চাকরি ছেড়ে রেডিওয় যোগ দিলেন ১৯২৮-এর শেষের দিকে।
মজার ব্যাপার হল যে ভাঙা-ভাঙা ‘হাস্কি’ বৈশিষ্ট্যের জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর একদম স্বতন্ত্র, তার আসল কারণ ছিল ডিপথেরিয়া। তিনি তখন খুব ছোট। সাহেব ডাক্তার তাঁকে প্রাণে বাঁচালেও ভেঙে গিয়েছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। ফলে বড় হয়ে রেডিওর অডিশনে ব্যর্থ হলেও কিন্তু ওই অদ্ভুত গলার জন্যই রেডিওতে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। একটা বেতার নাটকে ‘রাক্ষস’-এর কন্ঠস্বর চাই, কিন্তু প্রযোজকের কাউকেই মনে ধরে না। অবশেষে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অদ্ভুত গলার দৌলতেই ‘রাক্ষস’ হয়ে প্রবেশ করলেন বেতারকেন্দ্রে। পরবর্তীকালে আকাশবাণীতে প্রাণপাত করেছিলেন এই মানুষটি। কখনও গায়ক না এলে তিনি অর্গান বাজিয়ে গান করেছেন, আবার কখনও বাচিকশিল্পীর অনুপস্থিতিতে কথিকাও পাঠ করেছেন অবলীলায়।
১৯২৯ সালে রাইচাঁদ বড়াল রেডিও অফিসের চাকরি ছাড়লে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেইসময় তাঁর পোস্ট ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অফ ইন্ডিয়ান প্রোগ্রামস। ১৯৪৩ সালে সরকারি আইনকানুনের অবস্থা দেখে প্রতিবাদী মন থেকে তিনি চাকরি ছাড়েন এবং চুক্তির ভিত্তিতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ‘রেডিও বাড়ি’ তাঁর কাছে ক্রমেই হয়ে ওঠে এক পবিত্র তীর্থভূমি। সেখানে তিনি এক আড্ডার অনুষ্ঠান করতেন, যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, বিজ্ঞানী সি ভি রমন, হাফিজ আলি, এনায়েৎ খান, গায়ক কে এল সায়গল সাহেব, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, বদ্রীনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমার, যোগেশচন্দ্র বসু, চলচ্চিত্র পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পিতা সৌরীন্দ্রমোহন মুখার্জি প্রমুখ। শোনা যায় অভিনেতা কমল মিত্র তাঁর কাছে আসতেন ভয়েস ট্রেনিংয়ের জন্যে। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও যথেষ্ট সখ্য ছিল তাঁর।
এসবের পাশাপাশি ‘মেঘদূত’ ছদ্মনাম নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র লেখালিখি করতে শুরু করেন। কিন্তু একবার কবি পশুপতি চট্টোপাধ্যায় ‘মেঘদুত’ ছদ্মনাম নিয়েই একটি ছড়া প্রকাশ করায় তিনি তা দেখে ভীষণ রেগে যান। এরপর তিনি ‘বিষ্ণু শর্মা’ ছদ্মনামেও লেখালেখি করতে শুরু করেন। বস্তুত সাতটি ছদ্মনাম নিয়ে তিনি লেখালেখি করতেন এবং রেডিওতে একটার পর একটা অনুষ্ঠান করে গেছেন। ‘মেঘদূত’, ‘অরূপ’, ‘বিষ্ণুশর্মা’, ‘বিরূপাক্ষ’, ‘বই-বাহিক’, ‘বাঞ্ছারাম’, ‘মহাকালী চট্টোপাধ্যায়’। তবে এতগুলি ছদ্মনামের মধ্যে ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামটি অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিহার সাহিত্য ভবন-সহ বিভিন্ন প্রকাশনা বিরূপাক্ষ সিরিজ়ের একটার পর একটা বই প্রকাশ করেছিল। ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের অযাচিত উপদেশ’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ‘বিরূপাক্ষের কেলেঙ্কারি’ প্রভৃতি বইগুলির ভূমিকা লিখেছেন সজনীকান্ত দাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন খালেদ চৌধুরি, আশু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ব্যঙ্গচিত্রে রেবতীভূষণ, শৈল চক্রবর্তী, প্রমথ সমাদ্দারের মতো যশস্বী শিল্পীবৃন্দ। প্রথম বইটি প্রকাশের পর ‘বনফুল’ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় চিঠিতে লিখেছেন: ‘বাংলা সাহিত্যে তুমি একটা নতুন স্টাইল সৃষ্টি ক’রে গেলে।’ অর্ধশতক পরে এগুলির পুনঃপ্রকাশের আয়োজনে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন ছিল এরকম ‘…তাঁর কণ্ঠে ছিল সতেজ ‘শক্তিমন্ত্র’। কলমে ছিল অতি উচ্চাঙ্গ ‘হিউমার’। বাংলা সাহিত্যে এখন যার বড়োই অভাব।’
তাঁর ডাক নাম ছিল ‘বুশী’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর ‘আমার ছেলেবেলা’ রচনায় লিখেছেন— ‘এককালে পুরো নামেই পরিচিত ছিলাম, কটমট গম্ভীর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পরে সবাই বলতে শুরু করল বীরেন ভদ্র। ‘বুশী’ নাম খুব অন্তরঙ্গ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না।’
‘বেতার জগৎ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হলে তিনি তা নিজ কাঁধে নিয়ে বিক্রি করে বেড়িয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’, শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’, তারাশঙ্করের ‘কবি’, শচীন সেনগুপ্তের ‘গৈরিক পতাকা’ প্রভৃতির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন বীরেনবাবু।
তাঁর মৌলিক নাটক ‘ব্ল্যাকআউট’, ‘৪৯ নং মেস’ দারুণভাবে মঞ্চে সফল হয়েছিল। নিউ এম্পায়ারে নিয়মিতভাবে ‘দেবতার গ্রাস’ অনুষ্ঠিত হত। সেখানে তিনি নিয়মিত আবৃত্তি করতেন এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিতেন ভি বালসারা, আলোকসজ্জায় থাকতেন তাপস সেন প্রমুখ। এই বিশেষ প্রযোজনাটি বঙ্গসংস্কৃতির একটি মাইলফলক।
গ্রামোফোন রেকর্ড, ছায়াছবি, পেশাদার রঙ্গমঞ্চ— সবখানেই রেখেছেন নিজস্বতার স্পর্শ। কমবেশি পঁয়তাল্লিশটি গ্রামোফোন রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একাধিক ছবির চিত্রনাট্য রচনার পাশাপাশি অনেকগুলি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ‘ভোট ভন্ডুল’, ‘স্বামীর ঘর’। রংমহলে একাধিক নাটক পরিচালনা করেছিলেন বিরূপাক্ষ। উৎকৃষ্ট সাহিত্য থেকে তৈরি করেছেন মঞ্চসফল নাটক। তাঁর পরিচালনায় নাটকে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, নবদ্বীপ হালদার, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ‘মমতা ব্যানার্জি’ নামের এক অভিনেত্রী বীরেনবাবুর অনেকগুলি নাটকে পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় চুটিয়ে অভিনয় করতেন! তার শেষ নাটক ‘অভিষেক’। নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন দুর্গাদাস, জহর গাঙ্গুলি, বিপিন গুপ্ত প্রমুখ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রায় ২৯ থেকে ৩০টি পালার রেকর্ড রয়েছে ৭২ আরএমপি রেকর্ডে, যেগুলির মধ্যে ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘তরণীসেন বধ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এই বেতারে ‘ভূত’ও হয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি রেডিও অফিসের প্রধান। ‘পঞ্চভূতের আসর’ নামে একটি হাস্যকৌতুক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। অভিনব এই ভূত-আড্ডায় ‘দাদাঠাকুর’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত হতেন ‘পণ্ডিতভূত’, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হতেন ‘ভদ্রভূত’, আর এক জনপ্রিয় গায়ক হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হতেন ‘বিপ্রভূত’, কৌতুক গানের শিল্পী সারদা গুপ্ত হতেন ‘গুপ্তভূত’, এবং নানা বিষয়ে দক্ষ নলিনীকান্ত সরকার হতেন ‘অদ্ভুত’। এঁরা পাঁচজন খোনা খোনা কণ্ঠস্বরে হাসির কথা বলে যেতেন, পুরোটাই তাৎক্ষণিক; পূর্বলিখিত কোনও স্ক্রিপ্টের প্রয়োজন হত না এই পঞ্চ-সুরসিকের। তাছাড়াও এখানে ভূতের গল্পের আসরও বসত, যেখানে গল্প বলতেন যোগেন চৌধুরী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
আর এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘সবিনয় নিবেদন’-এ রসসিক্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অদ্ভুত সরসতায় শ্রোতাদের চিঠিপত্রের উত্তর দিতেন। এই অনুষ্ঠানে একবার এক শ্রোতার প্রশ্ন কীর্তন গানের অনুষ্ঠান রেডিওতে কমে যাচ্ছে কেন— এই অভিযোগের উত্তরে বলেছিলেন : ‘অন্য শ্রোতারা খুব অভিযোগ করছেন, আমরা নাকি সকাল-বিকাল-রাত্তির কীর্তন চালিয়ে তাঁদের বাড়িগুলোকে শ্রাদ্ধবাড়ি করে তুলছি।’ এমন নির্মল রম্যতায় ভরে থাকত সেই চিঠিপত্রের আসর। পাশাপাশি অনেকগুলি হাসির ছড়া-নাটিকাও রচনা করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।
মৃত্যুঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি শুরু করলেন ‘রূপ-অপরূপ’ নামের এক অনুষ্ঠান। শরৎচন্দ্রের জন্মদিনেও একটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন, নাম দিয়েছিলেন ‘শরৎশর্বরী’। বিখ্যাত সাহিত্যিকরা এতে অংশ নিতেন। শেষবার অসুস্থ শরৎচন্দ্র স্বয়ং বলেছিলেন ‘আমি এখনো বেঁচে আছি এইটুকুই বলি…’।
বেতারের আদিযুগে তাঁরই উদ্যোগে শারদ পূজান্তে গঙ্গার ঘাট থেকে দুর্গাপ্রতিমার নিরঞ্জনের ধারাবিবরণী প্রচার করা হত। একবার এমন হয়েছে, কোনও প্রতিমাই আসছে না। তিনি তখন প্রতিমা বিসর্জনের মনগড়া কাল্পনিক ধারাভাষ্য চালিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় যেকোনও ঘটনার বেতার ধারাবিবরণী মানেই তাঁর কণ্ঠস্বর থাকতই, তা সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর শেষযাত্রার ধারাবিবরণী হোক, বা ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, হেমন্ত বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী। মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর তাঁর শেষযাত্রার ধারাবিবরণীও দিয়েছিলেন তিনি। এমনকী ক্রুশ্চেভ, বুলগানিনের কলকাতায় আগমনের ধারাবিবরণী সবক্ষেত্রেই তাঁর কন্ঠস্বর শুনেছেন সারা বাংলার মানুষ। তিনিই বেতারে ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী দেওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৪১-এর ৭ অগাস্ট। বিশ্বকবি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দুপুরেই রেডিও অফিসে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন সজনীকান্ত দাস, বারোটা দশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। খবর পেয়েই ১নং গারস্টিন প্লেসের বেতার দফতর থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যন্ত্রপাতি-সহ সদলবলে ছুটলেন জোড়াসাঁকো অভিমুখে। প্রায় অপরাহ্নে কবির মরদেহ যখন নিমতলা শ্মশানঘাটে নিয়ে আসা হল, লোকের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা নেই। শ্মশানঘাটের একটা চূড়া লাগোয়া ভাঙা আলসেয় উঠতে হবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। দলের একজন কোথা থেকে একটা মই জোগাড় করে নিয়ে এলেন। হাত দিয়ে কিছু ধরে ভারসাম্য রাখার উপায় পর্যন্ত নেই। যে-কোনও সময় ভাঙা আলিসা থেকে পা হড়কে পড়ে যেতেই পারতেন। এক হাতে মাইক্রোফোন ধরে, জীবন বাজি রেখে সেই আলসে থেকে ধারাবিবরণী দিতে শুরু করলেন। তবে তাঁর শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছিল যে তিনি এসব নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ধারাভাষ্য শুরু করলেন—“সুমুখে দেখছি অপরাহ্নের সূর্য শেষ বিদায়ের পাঠ নিচ্ছে,…. ভাগীরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুণ তাপ… বাতাসে হাহাকার… বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ যে আর নেই…।” অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের কাছে রক্ষিত আছে মিথ হয়ে যাওয়া এই শোকভাষ্য।
১৯৬৪ সালে রেডিওতে অনুষ্ঠান নির্মাতাদের নির্দিষ্ট বেতনের কোনও পে-স্কেল ছিল না। তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় পরিদর্শনে এলে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর কাছে প্রথমেই দাবি পেশ করে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দাবি মেনে সেই বছর থেকেই বেতার শিল্পীদের পে-স্কেল চালু করেছিলেন। সতীর্থদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি এভাবেই বারবার নিঃস্বার্থভাবে সোচ্চার হতেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়েই পড়ার টেবিলে চলে যেতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। মূলত নিজের লেখাপড়া, গান, নাটক লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। বাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসব দিকে বিশেষ মাথা ব্যথা কোনওদিনই তাঁর ছিল না। সর্বদা পরিষ্কার ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন, কাঁধে থাকত একটা উড়নি, চোখে চশমা, হাতে খুব ছোট একটা থলে। পাঞ্জাবির দু’পকেটে দু’রকমের রুমাল— একটি নস্যিরঞ্জিত এবং আর একটি পরিষ্কার। কথা বলতে বলতে নস্যির টিপ-ধরা-হাতের সামনে কেউ থাকলে তাকে ঠেলা দেওয়া ছিল তাঁর অভ্যেস। সহকর্মীরা তাই এই নস্যপর্বে তাঁর হাতের নাগালের মধ্যে কিছুতেই আসতে চাইতেন না। তাঁরই এক সহকর্মী, ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার এক সময়ের সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার একবার বলেছিলেন ‘রেডিওতে বীরেন ভদ্র আসলে আলুবিশেষ। ঝালে, ঝোলে, চচ্চড়িতে, কালিয়ায়, এমনকি ভাতে, সিদ্ধতেও উপাদেয়।’
এহেন মানুষটিরও শেষ জীবন কেটে ছিল চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে। সেই সময় তার পাশে দাঁড়ায়নি কেউই। না সরকার না তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব। তখন রেডিওর স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে রবীন্দ্র ভারতীতে বেতার-নাটক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কিছুদিন। শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে কলকাতা ও অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান করতেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন, প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতে যেতেন।
একবার কিংবদন্তি গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায় না-বলে-কয়ে বীরেনবাবুকে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি শীতলা মন্দির উদ্বোধন করাতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ খানিক অপ্রস্তুত, কিন্তু আয়োজকেরা তাঁর বক্তব্য শুনতে চান। তবে কথা বলাই যাঁর কাজ, তাঁকে কি আর আলাদা করে প্রস্তুতি নিতে হয়! পুরো আসরে একটু গুম মেরে ছিলেন, কিন্তু মাইক্রোফোনে বলে দিলেন : ‘‘এমন এক মায়ের মন্দির উদ্বোধন করতে এসেছি, যাঁর কাছে দয়া চাইলেই বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে মশারি খাটিয়ে, সর্বাঙ্গে গুটি বেরিয়ে যাবে। মায়ের দয়ায় এক মাস কাত।’’
১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শোনা যায় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহের কয়েক হাজার বই তাঁর পুত্র কলেজ স্ট্রিটে বিক্রি করে দিয়েছিলেন খুবই স্বল্প মূল্যে। মৃত্যুর প্রায় পনেরো বছর পর ২০০৬ সালে তাঁর কন্যা সুজাতা ভদ্র অবশ্য ‘সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেড’ থেকে ৫০,৯১৭ টাকার একটি চেক পান মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির রয়্যালটি হিসেবে।
সম্প্রতি পরিচালক সৌমিক সেন তাঁর একটি বায়োপিক তৈরি করেছেন। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন যিশু সেনগুপ্ত। বাণিজ্যিকভাবে তেমন না চললেও চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল।
আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মানেই অমর কণ্ঠস্বরের অধিকারী এক বাঙালি। বাণীকুমারের ‘বসন্তেশ্বরী’ নামের অনুষ্ঠানটির সূত্রপাত আসলে চৈত্র মাসের বাসন্তী পুজোর সময়। সেটাকেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে পরবর্তীকালে তৈরি হয় কালজয়ী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
‘কায়েতের ছেলে হয়ে চণ্ডীপাঠ করবে! এ কেমন কথা? এ তো কানে শোনাও পাপ। সমাজ কী বলবে? লোকে ছিঃ ছিঃ করবে যে’, মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী থেকে সরাসরি চণ্ডীপাঠ করবেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, এমনটা ঠিক হতেই রেডিও অফিসের আনাচেকানাচে এই ধরনের মন্তব্য হতেই থাকল। আত্মবিশ্বাস তেমন ছিল না স্বয়ং বীরেনবাবুরও। মুখ কাঁচুমাচু করে, হাত কচলে তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে আবেদন নিবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পঙ্কজবাবু না-ছোড়। তাঁর একটিই কথা, মহালয়ার সূর্য উঠবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রোত্রপাঠ শুনতে শুনতে। সম্প্রচারিত হবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমারের গ্রন্থনায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, ইলা বসু, পঙ্কজ মল্লিক, সুপ্রীতি ঘোষের গানে। একবার বাংলাদেশে গিয়ে সেখানকার মুসলমান শ্রোতাদের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রতি আবেগ দেখে বিস্মিত ভদ্রমশাই বলেছিলেন: “আমি কায়েতের ছেলে হয়ে মাতৃবন্দনার সুযোগ পেয়েছি। আর ওই অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজায় খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী এঁরা। এর থেকে সম্প্রীতির পূজার্চনা আর কী হতে পারে!”
যাঁর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ এত বিখ্যাত, তিনি আবার ব্যক্তিগত জীবনে কোনওদিন ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতেন না। কোনওদিনই পুজো পার্বণের দিকে বা ঠাকুরঘরের ছায়াও মাড়াতেন না। অথচ প্রতিবছর লাইভ চণ্ডীপাঠের পূর্বে গঙ্গায় স্নান করে পট্টবস্ত্র পরেই চণ্ডীপাঠ করতেন এবং স্বয়ং ব্রাহ্মণ রূপে অনুষ্ঠানের দিন বিয়ের জোড়টা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, স্তোত্র পাঠের সময় তোমার গলা ধরে আসে কেন? উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘মা চণ্ডীকে তখন আমি যে আমার সামনেই দেখতে পাই।’
নাতনি মন্দিরা ভদ্র চক্রবর্তীর কথায়, ‘দাদু বেঁচে থাকতে রেডিওর তথাকথিত শিল্পীদের সমাগম ঘটত এই দিনে। জমিয়ে হত খাওয়াদাওয়া। যতদিন না শয্যাশায়ী হয়েছেন নিজের ঘরে সকলের সাথে বসেই শুনতেন অনুষ্ঠান। কখনো বা চলে যেতেন আকাশবাণীর অফিসে। তবে এখনো তাঁর ঘরে আগের মতোই সকলে মিলে বসে শোনা না হলেও, প্রত্যেকের ঘরে স্তোত্রপাঠ শোনা হয় । তাঁর ঘরও সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঠিক আগের মতোই। তাঁর খাট, ব্যবহৃত আসবাব, টেবিল এমনকী যে রেডিওতে তিনি নিজের সৃষ্টি শুনতেন, সেটাও রাখা আছে একই ভাবে। অনেকেই তাঁর মূর্তিতে মহালয়ার দিন মাল্যদান করতে আসেন।’
শেষ বয়সের একাধিক সাক্ষাৎকারে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে একরাশ অভিমান, হতাশা। বার বার বলতেন ‘ভাবতেই পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে…’ তবে নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘আমাকে ভুলে গেলেও বছরে একবার সেই দিনটিতে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’ ১৯৭৬ সালে মহালয়ার ভোরে বীরেন বাবুর মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে উত্তমকুমারের স্তোত্র পাঠে ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ নামক অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেই নিয়ে বীরেনবাবুর প্রতিক্রিয়া কী ছিল জানতে চাওয়া হলে, নাতনি মন্দিরা ভদ্র জানান, দাদু বরাবরই খুব শান্ত, ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি রেগে যাননি বা উত্তেজিত হননি। শুধু জানিয়েছিলেন ভালই তো, নতুন কিছু হল। মানুষের পছন্দ হলে তো ভালোই। এমনকী স্বয়ং উত্তমকুমার নিজে এসে দাদুকে অনুষ্ঠান শোনার জন্য অনুরোধ করে গিয়েছিলেন। যদিও সেই অনুষ্ঠান মানুষ মেনে নেননি, তুমুল বিক্ষোভ প্রতিবাদের ফলে সেই বছর মহাষষ্ঠীর দিন সকালবেলায় পুনরায় সম্প্রচারিত হয়েছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুধু যে একটা বাঙালির নাম বা অনুষ্ঠানের নাম নয়, একটা আবেগের নাম। যার কোনও মৃত্যু নেই, অমর।