এ আর-এক তেসরা অক্টোবরের কথা। সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে একটাও গুলি না ছুঁড়ে, একটা শত্রুকেও না মেরে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন এক ব্রিটিশ সৈনিক। জীবন সংহারের উৎসবে জীবনের বৃত্ত রক্ষার সেই বিচিত্র বৃত্তান্ত শোনাচ্ছেন দেবাশিস পাঠক
সেটাও ছিল ৩ অক্টোবর। তবে রবিবার নয়। বৃহস্পতি বার। সালটাও অবশ্য আজ থেকে ১০৩ বছর আগেকার। ১৯১৮।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষের মুখে, কিন্তু শেষ হয়নি। অন্তত পশ্চিমের রণাঙ্গনে গোলাবর্ষণ অব্যাহত। পিছু হটছে জার্মান সেনা। কিন্তু শেষ কামড় দিতে কসুর করছে না। দূরের কোনও প্রাসাদে কোনও কোনও নেতা-মন্ত্রীরা শান্তি চুক্তির আলোচনায় বসেছেন, যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা আর কত দূর, সেসব খবরে আগ্রহ নেই কারও। শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে কোনও আলোচনারই প্রবেশ নিষিদ্ধ এই বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে। ফলে যুদ্ধ অব্যাহত।
আরও পড়ুন-মৃত্যু নেই যে কণ্ঠস্বরের
এবং জার্মান বাহিনীর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মুখে পড়ে কিঞ্চিৎ নাজেহাল দশা ব্রিটিশ সেনাদের।
গোলার আঘাতে কাতরাচ্ছে একজন। রক্তাক্ত শরীর লুটিয়ে পড়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডে।
হঠাৎ উদয় হল এক যুবকের। বয়স ২৫-এর আশেপাশে। ছোটখাটো চেহারা। উচ্চতা বড়জোর ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল সে। কখনও কখনও মাথা নিচু করে একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মাটির ওপরে। উড়ে আসা গুলি আর অগ্নিপিণ্ডগুলো ছিটকে ছিটকে পড়ছিল তার দু পাশে।
যে-কোনও সময় ওই নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে থাকা রক্তমাখা শরীরটার মতো দশা হতে পারে তার। সেটা সে ভালমতোই জানে। তা-ও এগিয়ে চলে। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে। কখনও মাথাটা নিচু করে ছুটে। প্রাণ হাতে করে।
পৌঁছায় রক্তাক্ত সৈনিকের কাছে। সে তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। স্ট্রেচারে শরীরটা তোলে। তারপর একইভাবে, গোলাগুলির মধ্যে, প্রাণ হাতে করে, স্ট্রেচারের শরীরটাকেও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসে।
টানা ৪৮ ঘণ্টা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একের পর এক জীবন বাঁচিয়ে চলে সেই যুবক। ৩ অক্টোবর বিকেল থেকে ৫ অক্টোবর সন্ধে নামা অবধি। একনাগাড়ে একই কাজ। সেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোন। আহত যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা ব্রিটিশ সেনাদের এক এক করে নিয়ে আসা। ব্রিটিশ লাইনে এনে তাদের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। আহতের শরীরের কোনও জায়গা থেকে বারুদের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে সেখানে কষে পাক-তাগা বাঁধা। মরফিন ইনজেকশন দেওয়া। সব এক হাতে। বার বার। অক্লান্ত ভাবে। অথচ রণ-রক্ত-সফলতার সঙ্গে এই যুবকের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।
নাম উইলিয়াম হ্যারল্ড কোল্টম্যান। বন্ধুরা ডাকে বিল নামে। অফিসাররা ডাকেন বিল কোল্টম্যান। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একটি ছোট্ট গোষ্ঠী প্লাইমাউথ ব্রিদ্রেন। খ্রিস্টের শান্তির বাণী জীবনে ও প্রচারে ধারণ করে তারা। বিল এই গোষ্ঠীর সদস্য। শান্তি তার চোখের পাতায়। শান্তি তার বুকের কন্দরে। তবু সে রণাঙ্গনে। হিংসার উৎসবে। বিশ্বযুদ্ধের কালে সামরিক বাহিনীতে যোগদান ব্রিটিশ যুবকদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। সেই সূত্রে। পেশাদারিত্বের দায় বহন করে এমন টানা কাজ করতে হলে ক্লান্তি আসত। বিরক্তিও। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অনুরাগের প্রগাঢ়তা বিলের চোখে না নামতে দেয় ঘুম, বুকে না জমতে দেয় অবসন্নতা। মরণের যজ্ঞে বাঁচনের পৌরোহিত্যে এজন্যই সে অক্লান্ত। নিরলস। আলাদা কোনও উৎসাহভাতা ছাড়াই।
আরও পড়ুন-মৃত্যু নেই যে কণ্ঠস্বরের
স্ট্যাফোর্ডশায়ারের বহিঃপ্রান্তে ছোট একটা গাঁ রাঙ্গেমোর। সেখানেই বিলের জন্ম। নয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সে। উইনশিলের সানডে স্কুলে পড়াশোনা। ১৯১৫-র জানুয়ারিতে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগদান।
পদাতিক সেনাদের রাইফেল দেওয়া হয়। বিলকেও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনওদিন রাগের বশেও গুলি ছোঁড়েনি সে। প্লাইমাউথ ব্রিদ্রেনের শিক্ষা তাকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল।
এক রাতে ফেঁসে গেল গোলাগুলির মধ্যে। ট্রেঞ্চের মধ্যে আশ্রয়। সারাটা রাত তার কানে ভেসে এল আহত, মৃত্যুপথযাত্রীদের কান্না আর চিৎকার।
সকাল হতেই রাইফেল জমা দিল সেনা ছাউনিতে গিয়ে। সাফ জানিয়ে দিল, আর অস্ত্র ধরতে পারবে না সে। পারবে না মানুষ মারতে। তার বদলে স্বেছায় বেছে নিল স্ট্রেচার বাহকের কাজ।
কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। বরং সাধারণ সৈনিকের চেয়ে স্ট্রেচার বাহকের খাটনি অনেক বেশি। ঝুঁকিও। গোলাগুলির মধ্যে আহত সৈনিককে নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে গিয়ে যে কোনও সময় স্ট্রেচার বাহক লাশ হয়ে যেতে পারে।
আর খাটুনি? ১৬টা ব্যাটেলিয়ন। প্রতি ব্যাটেলিয়নে কম করে হাজার জন করে সৈনিক। এদের মধ্যে কেউ আহত হয়ে ভূমিশয্যা নেওয়ামাত্র তাকে ফার্স্ট এড দেওয়াটা স্ট্রেচার বাহকের প্রাথমিক কর্তব্য। আর সৈনিকের যদি মৃত্যু হয় তবে সমস্যা বাড়ে। সৈনিকের শরীর প্রাণহীন হলে তার ওজন আরও বেড়ে যায়। জল-কাদা মাড়িয়ে কাঁধে করে সেটা বয়ে আনা আরও মুশকিলের কাজ।
ছ’সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং চলল বিলের। শিখল, কীভাবে রক্তক্ষরণ থামাতে হয়। জুড়তে হয় ভাঙা হাড়। রণাঙ্গন থেকে আহত সৈনিককে সরিয়ে আনার সময় কীভাবে কথায় কথায় তাকে জোগাতে হয় মানসিক শক্তি, জাগিয়ে রাখতে হয় তাকে যাতে না সে চিরঘুমে ঢলে পড়ে।
সব শিখেছিল বিল। আর অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করেছিল টানা দু দিন ধরে। নিরস্ত্র অবস্থায়। মৃত্যুর নিঃশ্বাস ঘাড়ের কাছে পেতে পেতে।
আরও পড়ুন-৫০ থেকে ৮০ হাজার ভোটে জিততে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, ভবানীপুরের গণনা কেন্দ্রে এসে দাবি ফিরহাদের
যুদ্ধ শেষ হল। সরল সাদাসিধে বিল জানতে পারল তাকে নাকি সাহসিকতার জন্য ভিক্টোরিয়া ক্রস দেওয়া হবে। সে তো সামরিক শৌর্যের স্বীকৃতি! সে কেন তা পাবে? মনের কোনে সন্দেহ ছিল। ঘুচে গেল যখন ১৯১৯-এ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাকিংহ্যাম প্রাসাদে রাজা পঞ্চম জর্জ স্বয়ং বিলের জামায় পিন পরিয়ে আটকে দিলেন সেই ক্রস। সেই সঙ্গে দু-দুটো কন্ডাক্ট মেডেল, সদাচরণের জন্য পদক। আরও দুটো মিলিটারি পদক, সমরকর্মী হিসেবে সম্মাননা।
পদকে পদকে শোভিত ল্যান্স কর্পোরাল বিল কোল্টম্যান মুহূর্তে হয়ে উঠল ব্রিটেনের সে সময়ের সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধে সর্বাধিক সাহসিকতা প্রদর্শনকারী হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপক সেনাকর্মী। অথচ সেই হিংসার উৎসবে সে না ছুঁড়েছিল একটাও গুলি, না মেরেছিল একটাও মানুষ।
সেনা হিসেবে পদক পেয়েও মাথা ঘুরে যায়নি বিলের।
যুদ্ধের পর সে ছেড়েছিল সেনাবাহিনী। নিয়েছিল মালির কাজ।
রক্তঝরানোর চেয়ে ফুল ফোটানোতেই যে তার বেশি আনন্দ। কাঙ্ক্ষিত শান্তিও। প্রভু যিশুর বাণী যে তাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছিল।