আজ প্রকাশিত হবে ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল। ভবানীপুর ইতিহাসের পাতায় বহু অধ্যায়ের সাক্ষী থেকেছে। আর আজ তার ইতিহাসে নবতর সংযোজন। ভবানীপুরের হিজলডালে এখন ভারতজয়ের আকাশী হাতছানি। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়
“পিশাচেরা আর পিশাচসিদ্ধ দলে উদ্বায়ু সন্ত্রাসে/ ছেয়ে গেল দেশ…/এই প্রেতলোক ভাঙতে তো হবে স্বপ্নের হলাহলে/সেই সূর্যোদয়ে তুমিই তো ফুল।” __ বিষ্ণু দে
প্রেতলোকে অতিজীবিতের উচ্ছ্বাস চুরমার করে দিয়ে যে তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে দেশের বুকে আগামীতে, আজ ভবানীপুর তার বোধন মন্ত্র উচ্চারণ করবে।
পিশাচ আর পিশাচসিদ্ধ দলের উদ্বায়ু সন্ত্রাসকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে যে সূর্যোদয়ের ফুল ফোটার অপেক্ষা করছে আসমুদ্র হিমাচল, ভবানীপুর আজ তার পাপড়ি ছোঁবে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিকই বলেছিলেন, ‘ভ’-এ ‘ভবানীপুর’, ‘ভ’-এ ‘ভারত’ও। ভবানীপুরের জয় আজ হিম্মৎ হ্রেষায় ঘোষণা করবে, আগামীতে ভারত জয়ের ইঙ্গিত।
আরও পড়ুন-মানবজনম
এ হল সেই ভবানীপুর, যার ইতিহাসের পরতে পরতে যুগসন্ধির ইশারা।
এ হল সেই ভবানীপুর যার রাস্তায় রাস্তায় দেওয়ালে পাঁচিলে ইতিহাসের আলপনা।
আবুল কাশেম রহিমুদ্দিনের ‘হে নগর, হে মহানগর’ বইটিতে ভবানীপুর নিয়ে একটি আলাদা অধ্যায় আছে। তাতে চোখ বোলালে দেখতে পাই, একদা আদি গঙ্গার তীরে এই পল্লীতে বাস ছিল কুমোর, তাঁতি আর চাষিদের। এই জনবিন্যাস অটুট ছিল ষোড়শ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পাদে এসে বদলে গেল ছবিটা। এখানে থাকতে শুরু করলেন কালীঘাটের আদি সেবায়েত ভুবনেশ্বর চক্রবর্তীর জামাই ভবানীদাস ভট্টাচার্য। তাঁরই উদ্যোগে উৎসাহে বদলে গেল ভবানীপুর গ্রামের চালচিত্র। গড়ে উঠল এক অভিজাত জনপদ। ভবানীদাসের নামানুসারে সেই জনপদ পরিচিতি পেল ভবানীপুর হিসেবে।
কেয়া দাসগুপ্ত তাঁর বইতে এই বদলের বিন্যাস আঁকতে বসে লিখেছেন আজকের ভবানীপুর এখনও ধরে রেখেছে সেই প্রাচীন জনবিন্যাসের ছবি। বইয়ের নাম ‘জেনেসিস অব আ নেবারহুড ঃ দ্য ম্যাপিং অব ভবানীপুর’। সেখানে লেখিকা দেখিয়েছেন, আদি গঙ্গার তীরে জনবসতি গড়ে ওঠার কারণ ছিল বাণিজ্য সহায়ক পরিবহণের সুবিধা। সেই সূত্রে এখানে গড়ে ওঠে কাঁসারিপাড়া, তেলিয়াপাড়া, শাঁখারিপাড়া, পটুয়াপাড়া। কংসবণিক, তৈল ব্যাবসায়ী, শঙ্খবণিক ও মৃৎশিল্পীদের বাস স্থান। সেই সঙ্গে এখানকার মানচিত্রে ঘাটের বাহার। কত নামের ঘাট! বাবু মাধবের ঘাট থেকে শুরু করে রাসমণির নামাঙ্কিত ঘাট। ১৮২৫-এর মানচিত্রে এল বাজারের বাহার। সীতারাম ঘোষের বাজার, গঙ্গারাম সরকারের বাজার, সুলতান মিস্ত্রীর বাজার এবং যদুবাবুর বাজার।
আরও পড়ুন-Bhawanipur making history for Mamara
১৭৭৪-এ কলকাতাতে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। তখন সেখানে যোগ দেন স্যার রবার্ট চেম্বারস। আইনজীবী হিসেবে। তাঁর কাছ থেকে বিশাল জমি কিনে তাতে বাজার বসান জনৈক যোগেশ্বর লাহা। এই যোগেশ্বরের কাছে থেকে বাজারটি কিনে নেন রানি রাসমণি। তিনি সেটি দেন তাঁর নাতি যদুনাথ চৌধুরীকে। সেই থেকে এই বাজারের নাম যদুবাবুর বাজার।
কৃষক, তন্তুবায় এবং মৃৎশিল্পী অধ্যুষিত পল্লীতে এভাবে বড় বাজার বসার ইতিবৃত্ত স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয় একটাই কথা। কৃষিজীবী সভ্যতার থেকে বাণিজ্যমুখী জীবন চর্যার উদ্বর্তন আত্মস্থ করেছে ভবানীপুর। আর্থসামাজিক ইতিহাসের পট পরিবর্তনের চিহ্ন ধরেছে নিজের বুকে।
রাজনৈতিক ইতিহাসেরও। এখানকার মাটিতে সমাধিস্থ হয়েছেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজির আলি খান, ১৮১৭তে, ১৭ বছর কলকাতায় নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর। অযোধ্যায় তাঁর স্মৃতিবাহিত সব স্মারক নিজ দায়িত্বে ধ্বংস করেন জন উডবার্ন। কলকাতায় এলেন তিনি লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে। ওয়াজির আলি শাহের সমাধি খুঁজে পেলেন কাসিয়াবাগান গোরস্থানে। মুসলমান সম্প্রদায়ের গোরস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন উডবার্ন ১৯১৫-তে। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের উডবার্ন পার্ক।
উনিশ শতক থেকে ভবানীপুর বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ীদের বাসভূমি থেকে হয়ে উঠল শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নানা পেশার বঙ্গজনের আবাসস্থল। বহু ইতিহাস-পুরুষের বাসভূমি।
তাঁদের মধ্যে আছেন আইনজীবী থেকে চিকিৎসক, সম্পাদক থেকে অভিনেতা, সর্বপ্রকার দিকপাল বাঙালি।
শম্ভুনাথ পণ্ডিত, ১৮৬৩তে কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় বিচারপতি থাকতেন এখানে। আবার ১৮৬০-এর দশকেই এখানে বাড়ি বানান স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সেযুগের নামকরা ডাক্তার। বকুলবাগানে থাকতেন জগদানন্দ চট্টোপাধ্যায়। নামী উকিল। ১৮৭৬-এ কলকাতায় এসেছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস। তিনি স্বয়ং হাজির হয়েছিলেন জগদানন্দের বকুলবাগানের বাড়িতে। সেখানে অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। চা খান। তা নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ কম করেনি পরদানশিন বাঙালি সমাজ। অর্থ্যাৎ, পরদা সরিয়ে বঙ্গললনার বৈপ্লবিক বিবর্তনেও জড়িয়ে থেকেছে ভবানীপুর।
এই ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডে থাকতেন বাঙালির একমাত্র মহানায়ক উত্তমকুমার। আরও আগে থেকে এই ভবানীপুরের বাসিন্দা অহীন্দ্র চৌধুরী। এবং রঞ্জিত মল্লিক, কোয়েল মল্লিকদের আদিবাড়ি এখানকারই মল্লিক বাড়ি।
রাজনৈতিক পরিচয়েও এখানকার স্বনামধন্য অধিবাসীদের নানা বর্ণের আলোকচ্ছটা। পটলডাঙা থেকে উঠে এসে এখানকার পিপুলপট্টি রোডে (আজকের এলগিন রোডে) বাড়ি বানান দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা, বিধুমোহন। এখানকার লন্ডন মিশনারি সোসাইটির স্কুলেই দেশবন্ধুর পড়াশোনা। ১৯১৫সালের ক্যালকাটা স্ট্রিট ডিরেক্টরি দেখাচ্ছে, ৪নং এলগিন রোডের বাসিন্দা ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের ভাইপো। চিন্তাধারায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট। আরসিপিআই-এর প্রতিষ্ঠাতা। মুঙ্গেরের রাজা থাকতেন ৩৮/১ নং এলগিন স্টিটের বাড়িটিতে। পাশের বাড়িতেই থাকতেন আইনজীবী জানকীনাথ বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও দেশনায়ক শরৎচন্দ্র বসুর বাবা। এখান থেকেই ১৯৪১-এর জানুয়ারির এক রাতে দেশ ছাড়েন সুভাষ। ভারত ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় সূচিত হয়।
বেদিনীপাড়া রোডে থাকতেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক, নীল চাষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। সেই রাস্তাটাই আজ তাঁর নামাঙ্কিত। আর অন্য এক হরিশ, হরিশ চ্যাটার্জির নামাঙ্কিত রাস্তায় বাড়ি আজকের ভারতের একমাত্র প্রতিবাদী কন্ঠের, জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
যুগে যুগে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে ভবানীপুর। আজকের উপনির্বাচনের ঐতিহাসিক ফলের সূত্র ধরে এই ভূমি আরও এক বার ইতিহাসের প্রহরে।
২০২১-এ এই উপনির্বাচনের ফল ঘোষণায় আগমনীর আবহে আজ খুঁটি পুজো শেষ হবে।
অসুরবধের পর দশমীর উৎসব ২০২৪-এ।
হবে। হবেই।