‘‘সে আমার রক্তে ধোয়া দিন
চেতনায় হেনেছে আঘাত…
জাগো জনতা দুরন্ত সঙ্গীন
কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে।”
সত্যিই কি রক্তে ধোয়া দিনের কথা স্মরণে আছ? নাকি বিস্মরণই এখন অনৈতিক জোট-রসায়নে আসল অনুঘটক? সত্যিই কি স্মরণ আছে কারা সেদিন ভেঙেছিল ঘর? না কি সেটা ভুলে যাওয়াই নয়া মডেলের বাজারচলতি দস্তুর? কথাগুলো বলতেই হল, কারণ ৫৩ বছর আগেকার আজকের দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। স্মৃতিতে জাগরূক সাঁইবাড়ির (Sainbari murder) কথা।
১৭ মার্চ, ১৯৭০। বর্ধমান শহরের প্রতাপেশ্বর শিবতলা এলাকার সাঁইবাড়িতে সেদিন আনন্দের পরিবেশ। এ-বাড়ির আদরের মেয়ে স্বর্ণলতা। তাঁর ছেলে হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে অমৃত। সেই অমৃত যশের অন্নপ্রাশন।
আগের দিনই পতন হয়েছে রাজ্যের যুক্তফ্রন্ট সরকারের। অন্তর্দ্বন্দ্ব, অন্তর্কলহ আর হানাহানি— এই ছিল এই সরকারের রোজনামচা। অজয় মুখোপাধ্যায় বনাম জ্যোতি বসু, মুখ্যমন্ত্রী বনাম পুলিশমন্ত্রীর লড়াইয়ের কালো ছায়া তখন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। সেই নেতিবাচক অন্ধকারের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যে জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি না করে উপায়ও ছিল না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় নিজের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে ধর্নায় বসেছিলেন। এমতাবস্থায় সরকারের পতন ছিল অবধারিত। রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না কেন্দ্রের কাছে। তারই প্রতিবাদে ১৭ মার্চ বর্ধমানে চলছিল সিপিএম-এর বন্ধ।
সেই বন্ধের সমর্থনে সিপিএমের মিছিল ঢুকল প্রতাপেশ্বর শিবতলা এলাকায় সকাল ৮টা নাগাদ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বন্ধ সফল করার স্লোগান তুলে সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল তির-ধনুক, লাঠি, টাঙ্গি, বর্শা, বোমা। সাঁই পরিবারের ছেলেরা তখন আতশবাজি ফাটাচ্ছিল। আগের দিনও এ-বাড়ির মলয়, প্রণব, উদয়, বিজয়রা বাজি ফাটিয়েছিল জিটি রোড আর তেলমারুই রোডের মোড়ে। সেটা কিন্তু অমৃতের নামকরণ উৎসবের কারণে নয়। কংগ্রেস সমর্থক পরিবার তাঁদের। তাই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনে তারা উল্লসিত। তারই প্রকাশ আতশবাজি ফাটোনা। ১৭ মার্চ তারা বাজি ফাটাচ্ছিল ছোট্ট অমৃতের নামকরণ উৎসবের জন্য।
আচমকা মিছিল ঢুকল সাঁইদের (Sainbari murder) বাড়িতে।
তির ছুঁড়ে মারল প্রণব সাঁইকে।
জিতেন রায় এ-বাড়িতে আসতেন গৃহশিক্ষক হিসেবে। তাঁকেও মারল মিছিলের ছেলেরা। বল্লমের খোঁচা আর টাঙ্গির আঘাতে রক্তাক্ত হলেন অমল যশ। অমল আর স্বর্ণলতারই ছেলে অমৃত। হার্মাদদের আক্রমণের মুখে একে একে লুটিয়ে পড়লেন সুনীল পাল, প্রিয়রঞ্জন মল্লিক, মধু মণ্ডলরা। তাঁরা সাঁইবাড়িতে (Sainbari murder) এসেছিলেন নিমন্ত্রিত হিসেবে। তাঁরাও রেহাই পেলেন না হার্মাদদের নৃশংসতা থেকে। মলয় সাঁইয়ের গলায় দুদিক থেকে বল্লম ঢোকাল হার্মাদরা।
স্বর্ণলতার মা, অমৃতের ঠাকুমা মৃগনয়নাদেবী। তাঁরই কোলে শুয়েছিল ছোট্ট অমৃত। লাঠির বাড়ি নেমে এল মৃগনয়নাদেবীর মাথায়। জ্ঞান হারালেন তিনি। অমৃতকে তাঁর কোল থেকে ছিনিয়ে নিল হার্মাদরা। ছুঁড়ে দিল উনুনের আগুনে। মারের চোটে স্বর্ণলতার বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা ভেঙে গিয়েছিল। একটু আগেই দেখেছেন, তাঁর ভাই মলয় খুন হচ্ছে। এবার যখন দেখলেন, অমৃত পুড়ে মরতে বসেছে, তখন ভাঙা আঙুলের ব্যথা চেপে আগুনের লকলকে শিখা থেকে টেনে বের করে আনলেন অমৃতকে।
নবকুমার সাঁইয়ের চোখ দুটো উপড়ে নিয়ে অক্ষিকোটরে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছিল হার্মাদরা। নবকুমারের চোখদুটো তখন জ্বলছে। জ্বলছে তখন গোটা সাঁইবাড়ি। দাউ দাউ করে।
আরও পড়ুন: আজ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অখিলেশ যাদব
বন্ধের জন্য সাঁইবাড়ি (Sainbari murder) থেকে খানিকটা দূরে পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছিল। বাড়িটা যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে তখনই পুলিশের নজর পড়ল সেদিকে। সশস্ত্র পুলিশ পিকেটের দায়িত্বে ছিলেন এক নাগা পুলিশ অফিসার। তাঁর চোখে পড়ল, সাঁইবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন বর্ধমান জেলা সিপিএম-এর এক নেতা। তাঁর পোশাক রক্তে ভেজা। লোকটি যে খুনি তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে উদ্যত হলেন নাগা পুলিশ অফিসারটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিচারকের ক্ষমতাপ্রাপ্ত জনৈক ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি নাগা পুলিশ অফিসারকে গুলি চালাতে দিলেন না। যদি সেদিন ওই পুলিশ অফিসারটি গুলি চালানোর অনুমতি পেতেন, তাহলে সেদিন— লোকে বলে— পুলিশের গুলিতে মারা যেতেন বিনয় কোঙার, পরবর্তীকালে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। পুলিশের মোকর্দমা নং ৫০/১৭.০৩.১৯৭০। ৮৩ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ। এই মামলার ১১নং নামটাই হল বিনয় কোঙারের।
১৮ মার্চ, ১৯৭০। ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় একটা খবর প্রকাশিত হল। সেখানে স্টাফ রিপোর্টার লিখলেন, ‘… হঠাৎ সিপিআই (এম) মিছিলের উপর একটি পটকা বিস্ফোরণের ফলে একজন সিপিআই (এম) সমর্থক সামান্য আহত হয়। এরপরই ওই মিছিলের একটি অংশ টাঙ্গি, বল্লম ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের বাড়ি আক্রমণ করে। … আক্রমণকারীরা ওই বাড়ির ১৩ জন লোককে মারাত্মকভাবে জখম করে। তার মধ্যে মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই এবং জিতেন রায় ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে আক্রমণকারীরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।”
২১ মার্চ ‘বসুমতী’র প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘‘বড় ছেলে নবকুমারের চোখ ওরা উপড়ে ফেলে।” সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন নবকুমার। তাঁকে খুন করা হয় দু’বছর পর, ১৯৭২-এর ২২ জুন। আহ্লাদপুরের কাছে। সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী গুলি-বল্লমে তাঁকে খতম করেছিল। ১৮, ১৯ ও ২২ মার্চ, ১৯৭০-এর হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, দ্য স্টেটসম্যান আর অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান ও তাঁর স্ত্রীকে কাছে পেয়ে সাঁইবাড়ির জননী মৃগনয়নাদেবী জানিয়েছিলেন, ১৭ মার্চ সিপিএমের হার্মাদরা মলয় আর প্রণব সাঁইয়ের রক্তমাখা ভাত বেড়ে দিয়েছিল মা মৃগনয়নার সামনে। ছেলেদের রক্ত মায়ের গায়ে ছুঁড়ে মারতেও ইতস্তত করেনি সিপিএমের নরপিশাচরা।
কেস নং ৩(৭)৭৭/৫৭(১) ১৯৭৪। ১৯৭৭-এর ১৩ অগাস্ট চার্জশিট গঠিত হল ওই কেসের। অভিযুক্তদের টিআই প্যারেড করানো হল। সে-সময়েই স্বর্ণলতা যশ, অমৃতের মা, চিনে ফেলেন ভাই মলয়ের ঘাতককে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ওই ঘাতকদের একজনের চেহারা নিরুপম সেন ওরফে খোকনের মতো।” ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। বামফ্রন্ট জমানা শুরু হয়ে গিয়েছে ততদিনে। পাবলিক প্রসিকিউটর সাঁইবাড়ি মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। ৩০ সেপ্টেম্বর বিচারক গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য মাত্র চারজন আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দিলেন। কিন্তু বাকি ৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা বহাল থাকল। কিন্তু গীতেশরঞ্জন স্বপদে বহাল থাকলেন না। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন রবীন্দ্রকমল কর। ৬ মে, ১৯৭৮ তিনি মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দিলেন। রায়ে লিখলেন, ‘‘I don’t find sufficient reason to withhold consent for withdrawal…”
সেই সাঁইবাড়ির কথা আজ বোধহয় ভুলে গিয়েছেন ‘হাত’ পক্ষ। তাই হাতে ধরেছেন ‘কাস্তে হাতুড়ি’। জগাই-মাধাইয়ের অনৈতিক জোট পিশাচের মতো বাংলার আকাশে অশুভ ছায়া বিস্তার করে। আর সাঁইবাড়ির নিহত রক্তাক্ত মানুষগুলোর ন্যায় বিচার আত্মা কেঁদে কেঁদে বেড়ায়।
‘‘দিন এসে গেছে, ভাইরে
রক্তের দামে রক্তের ধার
শুধবার।”