কী নেই বাংলায়? মাথার উপর হিমালয় পর্বতমালা। আগলে রেখেছে অভিভাবকের মতো। পায়ের নিচে অশান্ত বঙ্গোপসাগর। উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে মাটির বুকে। এছাড়াও আছে ছোট-বড় পাহাড়, অসংখ্য নদনদী। বৈচিত্র রয়েছে জঙ্গলে। রাঢ় বাংলায় দেখা যায় মূলত শাল-পিয়ালের আলোকলো বন, সুন্দরবনে গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সেইসঙ্গে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি। এর পাশে ডুয়ার্সের জঙ্গল একেবারেই অন্যরকম। এগুলো সবই প্রাকৃতিক। পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য হেরিটেজ এবং ধর্মীয় স্থান। সবমিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বরাবর পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোকসংস্কৃতি। বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগা মাত্র আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ঘোরা এবং থাকার পাশাপাশি পাচ্ছেন সেই অঞ্চলের খাবারের অকল্পনীয় স্বাদ। পর্যটকদের আনন্দদানের জন্য আয়োজিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কাজে লাগানো হচ্ছে স্থানীয় লোকশিল্পীদের। তাঁরা পরিবেশন করছেন ছৌ নাচ, টুসু, ভাদু, ঝুমুর, বাউল গান ইত্যাদি। এর ফলে আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠছে সফর। হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি। এইভাবেই বাংলার পর্যটন (Bengal tourism) বিশেষভাবে নজর কেড়েছে সারা বিশ্বে।
স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুরস্কৃত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (Bengal tourism)। বিশ্বের বৃহত্তম পর্যটন মেলা আইটিবি বার্লিনের মঞ্চে। ছিলেন ১৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা। তাঁদের সামনে বিশ্বের সেরা সাংস্কৃতিক পর্যটন গন্তব্য হিসাবে রাজ্যের পুরস্কার গ্রহণ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী। রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলকে জার্মানি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন সচিবের হাতে পুরস্কার তুলে দেন জামাইকার পর্যটনমন্ত্রী অ্যাডমন্ড বার্টলেট এবং সেশেলসের পর্যটনমন্ত্রী অ্যালান এসটি এনজে।
বিশ্বমঞ্চে সাফল্য। স্বভাবতই খুশির হাওয়া রাজ্য জুড়ে। এই বিষয়ে কথা হল রাজ্যের পর্যটন সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘‘রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব ট্যুরিজম বিভাগ অনুমোদিত প্যাসিফিক এরিয়া রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন পশ্চিমবঙ্গকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক পর্যটন গন্তব্যের পুরস্কার তথা সম্মান দিয়েছে। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিশ্বের সেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলিকে পুরস্কৃত করে আসছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। আমরা যে স্বীকৃতিটা পেলাম সেটা বিশ্বের সেরা সাংস্কৃতিক পর্যটন গন্তব্য হিসাবে। একটা বিরাট মঞ্চে এতবড় পুরস্কার। খুবই আনন্দের। অন্য কোনও রাজ্য কিন্তু এই পুরস্কার পায়নি। ভারতের মধ্যে একমাত্র রাজ্য হিসেবে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ এই পুরস্কার পেয়েছে। অনুষ্ঠানে ছ’টা দেশের পর্যটনমন্ত্রীরা ছিলেন। ছিলেন প্রায় সাত হাজার সাংবাদিক, যাঁরা শুধুমাত্র পর্যটন সাংবাদিকতা করেন। ফলে জার্মানি সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলার পর্যটনের যথেষ্ট প্রচার হয়েছে। ফলে একটা নতুন পথ খুলল।’’
আরও পড়ুন: রাজধানীজুড়ে মোদিবিরোধী পোস্টার
তিনি আরও বলেন, ‘‘এই পুরস্কারের পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ ইউনেস্কো থেকে বাংলার দুর্গাপুজোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্মান পাওয়া। সারা পৃথিবী জেনেছে বাংলার দুর্গাপুজো সম্পর্কে। আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেকেই ঘুরে দেখছেন। আরেকটা কারণ, কোভিডের সময় বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। যাতায়াতের উপায় ছিল না। পর্যটকরা কী করবেন, সেই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছিল। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা চমৎকার আইডিয়া দেন। সেটা হল, আমাদের যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো আছে, সেখানে লোকপ্রসার প্রকল্পের শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান পরিবেশন করানো যেতে পারে। তাহলে বিনোদন হবে পর্যটকদের। পাশাপাশি উপার্জন হবে লোকপ্রসার প্রকল্পের শিল্পীদের। এই বিশেষ উদ্যোগে পর্যটন দফতরের সঙ্গে শামিল করা হয় তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগকে। ঠিক হয়, শিল্পীদের খরচ দেবে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, থাকার ব্যবস্থা করবে পর্যটন দফতর। এইভাবেই বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় বাংলার নিজস্ব লোকশিল্প। যেমন টুসু, ভাদু, ঝুমুর, বাউল, ছৌ ইত্যাদি। করোনা কালে পর্যটকদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয় অনুষ্ঠানগুলো। এখনও আমরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। একে বলা হয় কালচারাল ট্যুরিজম বা সাংস্কৃতিক পর্যটন। বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এত রকমের লোকশিল্প অন্য কোথাও নেই। স্থানীয় শিল্পীদের পাশাপাশি উন্নয়ন হচ্ছে গ্রামীণ পর্যটনের। এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে।’’
বিদেশি পর্যটকরা কতটা আগ্রহী? তিনি জানান, ‘‘খুবই আগ্রহী। বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসে হোটেলে বসে থাকতে চান না। তাঁরা বেরিয়ে পড়তে চান। নিজেদের খাবার সরিয়ে রেখে খেতে চান আমাদের লুচি-তরকারি। স্বাদ পেতে চান মাটির সংস্কৃতির। থাকতে চান হোমস্টেতে। ফলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গ্রামের হোমস্টেগুলো। হোমস্টেগুলোয় যদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়, হস্তশিল্পীদের কাজ দেখানো যায় তাহলেও বিষয়টা অন্য মাত্রা পাবে। এইভাবে আমরা গ্রামীণ পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। এর পাশাপাশি আমাদের হিমালয়, সমুদ্র, সুন্দরবন তো আছেই। এখন গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে আরতি হচ্ছে। টিকিট কেটে নৌকায় বসে আরতি দেখতে পারেন আগ্রহীরা। নৌকার মধ্যে চা, জলের ব্যবস্থা থাকছে। দুর্গাপুজোর সময় গঙ্গাবক্ষে পুজো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। টিকিট কেটে পর্যটকরা নৌকার সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। সঙ্গে থাকত খাওয়া- দাওয়ার সুব্যবস্থা। মাঝে বন্ধ ছিল। সেটা আবার চালু করা হবে। আরও অনেক পরিকল্পনা আছে। বাস্তবায়িত হবে ধীরে ধীরে। আশা করা যায়, এই পুরস্কারপ্রাপ্তির ফলে বাংলার পর্যটনে (Bengal tourism) নতুন জোয়ার আসবে।’’